সামাজিকীকরণ কাকে বলে | সামাজিকীকরণের বৈশিষ্ট্য (10 Characteristics of Socialization)

মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সমাজের ব্যক্তিবর্গের মধ্যে মিলেমিশে মানুষ বসবাস করে থাকে। এইভাবে সমাজের মধ্যে সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। এই সামাজিকীকরণের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Socialization) বিভিন্ন দিক থেকে পরিলক্ষিত হয়।

জন্ম মুহূর্তে শিশু থাকে অসহায় অর্থাৎ শিশু সামাজিক হয়ে জন্মগ্রহণ করে না। জন্মের পরবর্তী সময়ে পরিবেশের সঙ্গে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া মাধ্যমে সে সামাজিক হয়ে ওঠে এবং সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। এই প্রক্রিয়ায় শিশুকে সমাজের উপযোগী করে গড়ে তোলে। এখানে সামাজিকীকরণ কাকে বলে ও সামাজিকীকরণের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো।

সামাজিকীকরণ কাকে বলে (Socialization)

সামাজিকীকরণ হল সমাজের সঙ্গে একাত্ম বা পরিবর্তনশীল সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা। অর্থাৎ সামাজিকীকরণ এমন একটি প্রক্রিয়া যেটি শিশুর জন্মমুহূর্ত থেকে শুরু হয় এবং সারা জীবন পর্যন্ত চলতে থাকে। শিশুর সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে পরিবারবিদ্যালয় বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।

সমাজতাত্ত্বিকগণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সামাজিকীকরণকে সংজ্ঞায়িত করেছেন, সেগুলি হল –

1. ডুর্খহেইম বলেছেন – শিক্ষা প্রক্রিয়া মূলত সমাজায়ন প্রক্রিয়া। তিনি আরো বলেন – শিক্ষা প্রক্রিয়া শিশুকে সার্বিকভাবে সমাজ উপযোগী করে গড়ে তোলে।

2. সমাজতাত্ত্বিক জনসন (H. M. Johnson) তাঁর ‘Sociology’ শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন – “সামাজিকীকরণ হল শিখন, যেটি শিক্ষার্থীর সামাজিক ভূমিকা পালনে সক্ষম করে তোলে।”

3. বিশিষ্ট সমাজতাত্ত্বিক Bogardus বলেছেন – “সামাজিকীকরণ হল এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে ব্যক্তি ব্যক্তিকল্যাণের জন্য একত্রে নির্ভরযোগ্য আচরণ করতে শেখে।”

4. সমাজবিদ্‌ রস্‌ (J. S. Ross) বলেন – “সামাজিকীকরণ হল আমরা বোধ অনুভূতির সাংগঠনিক বিকাশ এবং তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং একসঙ্গে কাজ করার ক্ষমতা অর্জন।”

5. সমাজতাত্ত্বিক Kingsley Davis তাঁর লেখা Human Society নামক শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন – “যে প্রক্রিয়ায় মানব শিশু ক্রমশ সামাজিক মানুষে পরিণত হয় তাই সামাজিকীকরণ”।

6. অধ্যাপক Ogburn and Nimkoff বলেছেন – “সামাজিকীকরণ হল এমন এক প্রক্রিয়া যেটি ব্যক্তিকে তার গোষ্ঠীর নির্দিষ্ট নিয়ম কানুনের সঙ্গে পরিচিত লাভ করে।”

তাই যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানব শিশু নিজেকে সমাজ অনুযায়ী মানিয়ে নিতে পারে এবং যেটি তার ব্যক্তিত্ব বিকাশে সাহায্য করে তাকে সামাজিকীকরণ বলে।

সামাজিকীকরণের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Socialization)

সামাজিকীকরণের বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন দিক থেকে পরিলক্ষিত হয়। সামাজিকীকরণের যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়, সেগুলি হল নিম্নলিখিত –

1. পারস্পরিক সুসম্পর্ক

সামাজিকীকরণের বৈশিষ্ট্য হল এটি দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্কের প্রক্রিয়া। অর্থাৎ সামাজিকীকরণ পারস্পরিক সুসম্পর্কের উপর ভিত্তি করে গঠিত হয়।

2. পরিবর্তনশীলতা

পরিবর্তনশীলতা সামাজিকীকরণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে সীমাবদ্ধ নয়। সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়া পরিবর্তিত হতে থাকে।

3. গতিশীলতা

সামাজিকীকরণ গতিশীল প্রকৃতির। এটি স্থির বা অপরিবর্তন প্রকৃতির নয়। পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিকীকরণ গতিশীল প্রকৃতির হয়ে থাকে। তাই গতিশীলতা সামাজিকীকরণের বৈশিষ্ট্য গুলির মধ্যে অন্যতম।

4. সহযোগিতার মনোভাব

সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় সমাজে অবস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব পরিলক্ষিত হয়। কোন ব্যক্তি সমাজ ছাড়া বা একাকী বেঁচে থাকতে পারে না। তাই সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় সমাজের সাথে অভিযোজন করার ক্ষেত্রে ব্যক্তির সহযোগিতার মনোভাব বিশেষ প্রাধান্য পায়।

5. ‘আমরা বোধ’ অনুভুতি

সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া হলো ‘আমরা বোধ’ অনুভূতি জাগ্রত করা। অর্থাৎ সামাজিকীকরণ একটি পারস্পরিক সুসম্পর্কের ভিত্তিতে গঠিত হয়। ফলে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া সমাজে অবস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে আমরা বোধ অনুভূতি পরিলক্ষিত হয়।

6. নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যমুখি

সামাজিকীকরণ নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যমুখী প্রক্রিয়া। অর্থাৎ সামাজিকীকরণে ব্যক্তিকে সমাজের সঙ্গে সুষ্ঠ অভিযোজন এর সহায়তা করে থাকে। তাই নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

7. জীবনব্যাপি প্রক্রিয়া

সামাজিকীকরণ সারা জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। শিশু জন্মের পর থেকে বড় হওয়ার সাথে সাথে সমাজের সাথে সুষ্ঠুভাবে অভিযোজন এর মাধ্যমে সামাজিক জীব হিসেবে গড়ে ওঠে ও সামাজিকীকরণে অংশগ্রহণ করে। সামাজিকীকরণের নির্দিষ্ট কোন বয়স বা সময় থাকে না এটি সারা জীবন ধরে চলতে থাকে।

8. ধারাবাহিক প্রক্রিয়া

সামাজিকীকরণ ব্যক্তির মধ্যে ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে। এটি কখনো থেমে থাকে না। সততা পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে ব্যক্তিকে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার জন্য সামাজিকীকরণ ধারাবাহিকভাবে সংঘটিত হয়ে থাকে।

আরোও পোস্ট পড়ুন – Click Here Now

উপসংহার (Conclusion)

পরিশেষে বলা যায়, সামাজিকীকরণ ব্যক্তি বা শিশুর একটি অপরিহার্য দিক। কারণ সামাজিকীকরণ ছাড়া কোন ব্যক্তির অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। তাই সমাজের মধ্যে ব্যক্তির যাবতীয় কর্মকাণ্ড প্রতিফলিত হয়। পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে বিশেষ করে পরিবর্তনশীল সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেয়াই হলো সামাজিকীকরণ। আর এর বিপরীত হলো অসামাজিকীকরণ। অর্থাৎ পরিবর্তনশীল সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে ব্যক্তি যদি সুষ্ঠুভাবে মানিয়ে নিতে না পারে তখন সে অসামাজিক প্রকৃতি হয়ে থাকে ও সেই অনুযায়ী আচার-আচরণ সম্পন্ন করে থাকে।

প্রাথমিক গোষ্ঠীর ধারণা, সংজ্ঞা, বৈশিষ্ঠ্য ও শিক্ষাগত তাৎপর্যসামাজিক গোষ্ঠীর ধারণা, সংজ্ঞা ও শ্রেণীবিভাগ
শিশুর সামাজিকীকরণে পরিবারের ভূমিকাশিশুর সামাজিকীকরণে বিদ্যালয়ের ভূমিকা

তথ্যসূত্র (Reference)

  • Brown, F. J. (1954). Educational Sociology. New York: Prentice-Hall.
  • Bhattacharjee, Srinivas. (1996). Philosophical & Sociological Foundation of Education. Herald book service.
  • Das, P. (2007). Sociological Foundation of Education. New Delhi: Authorspress
  • Shukla, S & K Kumar. (1985). Sociological Perspective in Education. New Delhi, Chanakya
    Publications
  • Sodhi, T.S & Suri, Aruna. (1998). Philosophical & Sociological Foundations of Education, H.P Bhargav Book House, Agra,

প্রশ্ন – শিশুর সামাজিকীকরণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম কোনটি?

উত্তর – শিশুর সামাজিকীকরণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো পরিবার। কারণ পরিবার শিশুর জন্ম মুহূর্ত থেকে লালন পালনের মাধ্যমে সামাজিকীকরণে সহায়তা করে এবং সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

আরোও পড়ুন

1 thought on “সামাজিকীকরণ কাকে বলে | সামাজিকীকরণের বৈশিষ্ট্য (10 Characteristics of Socialization)”

Leave a Comment

close