আধুনিক শিক্ষার বিভিন্ন লক্ষ্য বর্তমান, যেমন – সামাজিক লক্ষ্য, ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্য, সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য ও বৃত্তিমূলক লক্ষ্য। এদের মধ্যে বৃত্তিমূলক শিক্ষা (Vocational Education) আধুনিক শিক্ষার একটি অন্যতম লক্ষ্য।
শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীন বিকাশ সাধন করা। প্রাচীন শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীর প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হতো না। ফলে বৃত্তিমূলক শিক্ষা সেখানে থাকতো অবহেলিত। কিন্তু আধুনিক শিক্ষাবিদগণ শিক্ষার বিভিন্ন লক্ষ্যের মধ্যে বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রদান করে থাকে। কারণ বৃত্তিমূলক শিক্ষা (Vocational Education) -য় এমন শিক্ষা যেখানে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারে।
বৃত্তিমূলক শিক্ষা কি
প্রতিটি ব্যক্তির কিছু প্রাথমিক চাহিদা থাকে, যেমন – খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান। আর এই তিনের এর সংস্থানের জন্য দরকার বৃত্তি বা কাজ। শিক্ষাক্ষেত্রে এই বৃত্তি শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কারণ এই বৃত্তিমূলক শিক্ষা শিশুকে ভবিষ্যৎ জীবনের উপযোগী করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে।
বৃত্তিমূলক শিক্ষা হল শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবনের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দান করা। এর ফলে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যৎ জীবনে যে কোন কর্মজগতে সহজে প্রবেশ করতে পারবে। বৃত্তিমূলক শিক্ষা আবার ভোকেশনাল শিক্ষা নামে পরিচিত।
বৃত্তিমূলক শিক্ষার সংজ্ঞা প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ হার্টস্রোন (Hartshrone) বলেছেন – বৃত্তিমূলক শিক্ষা হল এমন একটি প্রয়োজনীয় শিক্ষাব্যবস্থা, যার অভাবে শিক্ষার্থীরা সারাজীবন পিছিয়ে থাকবে।
বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা | Needs of Vocational Education)
বৃত্তিমূলক শিক্ষা (Vocational Education) আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় একটি প্রয়োজনীয় শিক্ষা ব্যবস্থা। তাই এই শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন প্রয়োজনীয়তা (Needs of Vocational Education) বর্তমান, সেগুলি হল –
1. দক্ষতার উন্নয়ন (Skill Development)
বৃত্তিমূলক শিক্ষা এমন ব্যবহারিক দক্ষতার উপর গুরুত্ব আরোপ করে। যা নির্দিষ্ট শিল্প বা পেশার জন্য সরাসরি প্রযোজ্য। তাই দক্ষতার উন্নয়নে বৃত্তিমূলক শিক্ষা অপরিহার্য।
2. কর্মসংস্থান (Employment)
বৃত্তিমূলক শিক্ষা ব্যক্তিদের চাকরির জন্য প্রস্তুতির দক্ষতা বৃদ্ধি করে। ফলে তাদের কর্মসংস্থান খোঁজার সম্ভাবনা অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তাই বৃত্তিমূলক শিক্ষা কর্মসংস্থানের জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজন।
3. শিল্পের প্রাসঙ্গিকতা (Industry Relevance)
বৃত্তিমূলক শিক্ষার সাথে শিল্পের সংযোগ সাধন রয়েছে। অর্থাৎ বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে শিল্পের প্রাসঙ্গিকতার উপর গুরুত্ব আরোপ করা বিশেষ প্রয়োজন।
4. বিভিন্ন কর্মজীবনের পথ (Diverse Career Paths)
বৃত্তিমূলক শিক্ষা আধুনিক প্রযুক্তির বিভিন্ন দিকে বিস্তৃত ও প্রসারিত। তাই বৃত্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন কর্মজীবনের পথকে শুগম করা সহজসাধ্য হয়।
5. বেকারত্ব হ্রাস (Reduction of unemployment)
বৃত্তিমূলক শিক্ষা বেকারত্ব হ্রাস করার ক্ষেত্রে বিশেষ প্রয়োজনীয়তা বর্তমান। শিক্ষার্থীরা শুধু প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত হলে হবে না বরং তাদেরকে বিভিন্ন বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দান করার মধ্য দিয়ে পেশাগত জগতে প্রবেশের পথকে সুগম করতে হবে। তাই বৃত্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে যত বেশি কর্মসংস্থান হবে তত বেকারত্ব কমে যাবে।
6. শ্রম চাহিদা মেটানো (Meeting Labor Demand)
শিল্পগুলো প্রায়ই দক্ষ শ্রমিকের অভাবের সম্মুখীন হয়। বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রয়োজনীয় দক্ষতা সম্পন্ন কর্মী তৈরি করে এই ব্যবধান পূরণে সহায়তা করে। অর্থাৎ বৃত্তিমূলক শিক্ষা দক্ষ শ্রমিকের চাহিদাকে হ্রাস করতে বিশেষভাবে সহায়তা করে।
7. হাতে কলমে শিক্ষা (Hands-on learning)
বৃত্তিমূলক শিক্ষার মূল ভিত্তি হল হাতে-কলমে শিক্ষা। এই শিক্ষার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা বাস্তবে বিভিন্ন কাজের সঙ্গে ওতপ্রতভাবে যুক্ত হতে পারবে। ফলে তারা আরো বেশি দক্ষতা সম্পন্ন হতে পারবে। তাই হাতে কলমে শিক্ষা দানের শিক্ষার্থীরা আরো বেশি দক্ষ হতে পারবে।
8. পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া (Adapting to change)
বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দ্রুত চাকরির বাজারে পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। যা কর্মীদের প্রযুক্তিগত অগ্রগতির কারণে ক্রমাগত বিকশিত শিল্পগুলিতে প্রাসঙ্গিক থাকতে সাহায্য করে। তাই বলা যায় দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে ও নতুন নতুন কাজের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা বর্তমান।
9. ব্যক্তিগত বৃদ্ধি ( Personal Growth)
বৃত্তিমূলক শিক্ষা শৃঙ্খলা, দলবদ্ধ কাজ, এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, সামগ্রিক জীবন দক্ষতা বৃদ্ধি করে ব্যক্তিগত বিকাশকে উৎসাহিত করে।
10. বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলকতা (Global Competitiveness)
একটি শক্তিশালী বৃত্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা বিশ্বমঞ্চে একটি দেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ায়, উচ্চ স্তরের দক্ষতার সাথে কর্মী তৈরি করে। তাই যে দেশ যত বেশি দক্ষ কর্মীর ব্যবস্থা করতে পারবে সেই দেশের উন্নতি তত বেশি পরিলক্ষিত হয়। তাই প্রতিটি সমাজ ব্যবস্থায় বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বর্তমান।
11. উপযোগী শিক্ষা (Tailored education)
ভোকেশনাল প্রোগ্রামগুলি ব্যক্তিগত প্রয়োজন অনুসারে তৈরি করা হয়। যা ছাত্রদের তাদের আগ্রহ এবং শক্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নির্বাচন করতে সাহায্য করে। তাই বৃত্তিমূলক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের কাছে উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা হিসাবে গণ্য করা হয়ে থাকে।
12. আঞ্চলিক চাহিদা পূরণ (Catering to regional needs)
বিভিন্ন অঞ্চলের নির্দিষ্ট শিল্প চাহিদা থাকতে পারে। এই অনন্য প্রয়োজনীয়তাগুলি পূরণ করার জন্য বৃত্তিমূলক শিক্ষা (Vocational Education) বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
13. কাজের সন্তুষ্টি (Job satisfaction)
বৃত্তিমূলক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের কাজের সন্তুষ্টি বজায় রাখার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সাহায্য করে। তাই বলা যায় বৃত্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে উপযুক্ত জব পাওয়ার মধ্য দিয়ে কাজের সন্তুষ্টি বজায় রাখে।
14. অর্থনৈতিক বিকাশ (Economic Growth)
বৃত্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে তৈরি একটি দক্ষ কর্মশক্তি বিভিন্ন খাতে উৎপাদনশীলতা এবং উদ্ভাবনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি বা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই বৃত্তিমূলক শিক্ষা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সাথে সাথে দেশের অর্থনৈতিক বিকাশ বা সমৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে।
এগুলি ছাড়াও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা (Needs of Vocational Education) যে সমস্ত দিক থেকে বর্তমান, সেগুলি হল –
- শিক্ষার্থীদের সমাজ উপযোগী করে গড়ে তোলা।
- অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটানো।
- সামাজিক মর্যাদার বিকাশ সাধন।
- নিম্ন বুদ্ধি সম্পন্ন শিশুদের সহায়তা প্রদান।
- প্রতিবন্ধী শিশুদের বিভিন্ন কর্মমুখী প্রকল্পের মাধ্যমে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলা।
- সামাজিক শৃঙ্খলা স্থাপন।
- উৎপাদন মুখী বিনিয়োগে উৎসাহিত করা।
- দারিদ্রতা হ্রাস করা।
- বৃত্তিমূলক দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করা।
- নৈতিকতাবোধের বিকাশ সাধন করা।
- ব্যক্তি স্বতন্ত্র নির্ভর শিক্ষার ব্যবস্থা করা প্রভৃতি।
উপসংহার (Conclusion)
পরিশেষে বলা যায়, বর্তমানে পৃথিবীর সব দেশেই শিক্ষাক্ষেত্রে বৃত্তিমূলক শিক্ষা (Vocational Education)-র প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ফলে বিভিন্ন বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে। যেখান থেকে শিক্ষার্থীরা সহজেই বিভিন্ন বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ লাভের মধ্য দিয়ে কর্মজীবনে সহজে প্রবেশ করতে পারবে। তাই বৃত্তিমূলক শিক্ষা আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় একজন ব্যক্তির কাছে একটি প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
তথ্যসূত্র (References)
- V.R. Taneja, Educational Thoughts & Practice. Sterling Publication Pvt. Ltd. New Delhi
- Nayak, B.K, Text Book of Foundation of Education. Cuttack, Odisha: KitabMhal
- Ravi, S. Samuel, A Comprehensive Study of Education, Fourth Printing-May 2016, Delhi – 110092, ISBN – 978-81-203-4182-1,
- Internet sources
প্রশ্ন – বৃত্তিমূলক শিক্ষা কাকে বলে?
উত্তর – যে শিক্ষা ব্যবস্থায় বৃত্তিমূলক শিক্ষার যাবতীয় উপাদান বর্তমান, শিক্ষার্থীর জীবন বিকাশের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয় এবং শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ উপযোগী করে গড়ে তোলা হয় তাকে বৃত্তিমূলক শিক্ষা বলে।
প্রশ্ন – বৃত্তিমূলক শিক্ষার উদ্দেশ্য লেখো।
উত্তর – বৃত্তিমূলক শিক্ষার উদ্দেশ্য হল – শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবনের উপযোগী করে গড়ে তোলা, শিক্ষার্থীদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, কাজের সন্তুষ্টি অর্জন, পরিবর্তনশীল পরিবেশের সাথে অভিযোজন, শিক্ষার্থীকে স্বনির্ভর হিসেবে গড়ে তোলা, সামাজিক মর্যাদার উন্নয়ন, আর্থসামাজিক বিকাশ সাধন প্রভৃতি।
প্রশ্ন – বৃত্তিমূলক শিক্ষার গুরুত্ব লেখো।
উত্তর – বৃত্তিমূলক শিক্ষার গুরুত্ব হল এটি শিশুকে ভবিষ্যৎ জীবনের উপযোগী করে গড়ে তোলে, অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটায় এবং সমাজ উপযোগী করে গড়ে তোলে।
আরোও পড়ুন
- শিক্ষা কি | শিক্ষার 15 টি সংজ্ঞা | Concept and Best Definition of Education
- Role of Television: গণমাধ্যম হিসেবে টেলিভিশনের ভূমিকা
- সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষা বলতে কী বোঝো | 2 টি সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য | Narrow Meaning of Education
- ব্যাপক অর্থে শিক্ষা কি | সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য | Broader Meaning of Education
- ডেলর কমিশনের শিক্ষার চারটি স্তম্ভ | Delors Commission in Bengali
- শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা কি (Child Centered Education) : ধারণা, সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য
1 thought on “বৃত্তিমূলক শিক্ষা কি | বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা | 14 Needs of Vocational Education”