রাজা রামমোহন রায় ভারতীয় সমাজের সংস্কারের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা (Raja Rammohan Roy in Western Education) ছিল অন্যতম। তাঁর হাত ধরে সমাজে নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল।
রাজা রামমোহন রায়ের সময়ে সমাজ ব্যবস্থা ছিল বিভিন্ন কুসংস্কারের ও অন্ধবিশ্বাসের দ্বারা নিমজ্জিত। যেমন – গঙ্গায় সন্তান বিসর্জন, সতীদাহ প্রথা, নারীদের রক্ষণশীলতা, মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা না করা প্রভৃতি। রাজা রামমোহন রায় প্রথম এই অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। তিনি দেখেছিলেন শিক্ষার উন্নতি না হলে সমাজের উন্নতি করা সম্ভবপর নয়। তাই ভারতীয় শিক্ষার উন্নতির সাথে সাথে ভারতীয়দের মধ্যে বিজ্ঞান চেতনার উন্মেষ ঘটানোর জন্য রামমোহন রায় পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের পক্ষপাতি ছিলেন।
রাজা রামমোহন রায়ের জীবনী (Biography of Raja Rammohan Roy)
ভারতবর্ষ তথা ঊনবিংশ শতকের প্রধান প্রাণপুরুষ ও সমাজ সংস্কারক ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। তিনি 1772 সালের 22শে মে হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামে ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন রামকান্ত রায় এবং মা ছিলেন তারিনী দেবী।
স্কুল জীবনের শিক্ষা শেষ করে রামমোহন রায় পাটনা ও কাশিতে গিয়ে সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি ভাষায় উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন। তিনি মোট 10 টি ভাষায় বিশেষভাবে পারদর্শী ছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সংস্কৃত, ফারসি, আরবি, বাংলা, ইংরেজি, ল্যাটিন প্রভৃতি।
1833 সালের 27 শে সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের বিস্টল শহরে এই মহামানবের জীবনাবসান হয় এবং সেখানেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়।
পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা (Role of Raja Rammohan Roy in Western Education)
শিক্ষার বিস্তার ও প্রসার সাধনের জন্য রাজা রামমোহন রায় সারাজীবন কঠোর সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বিভিন্ন সমাজ সংস্কারকমূলক কাজের মধ্য দিয়ে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কল্যাণ সাধন করতে বিশেষ সচেষ্ট ছিলেন। অর্থাৎ রামমোহন রায় শিক্ষার জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন।
তাই রামমোহন রায় কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসে নিমজ্জিত সমাজকে শিক্ষার আলোর মাধ্যমে জাগ্রত করতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা যে সমস্ত দিক থেকে বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়, সেগুলি হল –
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষার সমন্বয় সাধন
পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা ছিল অনবদ্য। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষার মধ্যে সমন্বয় সাধনের কথা বলেন। তার মতে ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যর মূল্য যেমন অপরসীম তেমনি ভারতীয় শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থাকে গ্রহণ করতে হবে। এর ফলে একদিকে যেমন ভারতীয় প্রাচীন সংস্কৃতির সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে, অপরদিকে তেমনি পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষা হবে বিজ্ঞান সম্মত।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষার সমন্বয়ের ফলে ভারতীয় শিক্ষার অগ্রগতি সম্ভব হবে বলে রাজা রামমোহন রায় আশাবাদী ছিলেন। পাশ্চাত্য শিক্ষার গ্রহণের ফলে ভারতীয় সমাজ থেকে কুসংস্কারের অবসান ঘটবে।
তাই রাজা রামমোহন পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ভারতীয়দের উদারমনা দৃষ্টিভঙ্গি গঠনের সহায়ক হবে বলে মনে করেন। তাই প্রাচ্যও পাশ্চাত্য শিক্ষার সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য।
ইংরেজি ভাষার চর্চা ও প্রসার
পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায় ইংরেজি ভাষার চর্চা ও প্রসারের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি দেখেছিলেন ইউরোপের নবজাগরণের প্রধান দিক হল ইংরেজি শিক্ষা। অর্থাৎ ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে ইংল্যান্ড আমেরিকা সহ পাশ্চাত্য দেশের উন্নতি দ্রুত অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়। এই কারণে তিনি বাংলাদেশ ইংরেজি শিক্ষার পক্ষপাতী ছিলেন।
রামমোহন রায় বুঝতে পেরেছিলেন বিজ্ঞান শিক্ষা ছাড়া ভারতবর্ষ কেন, কোন দেশের অগ্রগতি সম্ভব নয়। এইজন্য 1823 সালে রামমোহন লর্ড আমহাস্টের কাছে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের জন্য আর্থিক সাহায্য চেয়েছিলেন।
বিজ্ঞান চেতনার মনোভাব গঠন
রামমোহন রায় পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান চর্চার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। কারণ বিজ্ঞান চর্চার মধ্য দিয়ে ভারতীয় কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাস দূর করা সম্ভবপর হবে। ফলস্বরূপ সমাজ গঠনকেও দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভবপর হবে।
রামমোহন রায় চেয়েছিলেন যে ভারতীয়রা গণিত, দর্শন, রসায়ন প্রভৃতি বিজ্ঞানের অন্যতম শাখা গুলির প্রতি আগ্রহী হবে। তাই তিনি ভারতীয়দের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা প্রসারের জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। সুতরাং বিজ্ঞান চেতনার মনোভাব গঠনের মধ্য দিয়ে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা বিশেষ স্মরণীয়।
আরোও পোস্ট পড়ুন – Click Here Now
উপসংহার (Conclusion)
সর্বোপরি বলা যায়, ভারতীয় সমাজের যাবতীয় কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস থেকে মুক্তির পথ প্রদর্শন করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে ভারতীয় শিক্ষার পাশাপাশি ভারতীয়দের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি সাধনের জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষা বিশেষভাবে প্রয়োজন।
এইজন্য তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষার সমন্বয় সাধনা করেছিলেন। তাই পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য ছিল একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
রাজা রামমোহন রায় প্রসঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন – ” তিনি (রামমোহন) কি না করিয়াছিলেন? শিক্ষা বল, রাজনীতি বল, বঙ্গভাষা বল, বঙ্গসাহিত্য বল, ধর্ম বল, সমাজ বল, বঙ্গসমাজের যে-কোনো বিভাগে উত্তরোত্তর যতই উন্নতি হইতেছে, সে সকল কেবল তাঁহারই হস্তাক্ষর নতুন নতুন পৃষ্ঠায় উত্তরোত্তর পরিস্ফুততর হইয়া উঠিতেছে মাত্র”।
তথ্যসূত্র (References)
- Ravi, S. Samuel, A Comprehensive Study of Education, Fourth Printing-May 2016, Delhi – 110092, ISBN – 978-81-203-4182-1
- Internet Sources
প্রশ্ন – রাজা রামমোহন রায় কেন বিখ্যাত?
উত্তর – রাজা রামমোহন রায় ভারতীয় সমাজের একটি জঘন্য ও কঠোর প্রথা বিলোপ সাধন করেছিলেন। সেটি হল সতীদাহ প্রথা। এই অমানবিক প্রথা রামমোহন ভারতীয় সমাজ থেকে মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। এছাড়া নারী শিক্ষার বিস্তার সাধন, নারীর স্বাধীনতা প্রদান, বিদ্যালয়ের স্থাপন, ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা, পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার প্রভৃতি ক্ষেত্রে রামমোহন রায়অসামান্য অবদান রেখেছেন। এই কারণগুলি জন্য রাজা রামমোহন রায় বিখ্যাত।
আরোও পড়ুন
- একজন আদর্শ শিক্ষকের গুণাবলী | 7 Qualities of a Good Teacher
- নারী শিক্ষায় বেগম রোকেয়ার অবদান | Contribution of Begum Rokeya on Women Education
- শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য | Individual and Social Aims of Education
- শিক্ষা শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ কি | Etymological Meaning of Education
- নারী শিক্ষায় বিবেকানন্দের অবদান | Vivekananda on Women’s Education
- নারী শিক্ষায় জাতীয় শিক্ষানীতি 1986 এর সুপারিশ | National Education Policy 1986 on Women Education