সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া (Socialization Process) এমন যেটি শিশুর জন্মমুহূর্ত থেকে শুরু হয় এবং সারা জীবন পর্যন্ত চলতে থাকে। সমাজের সঙ্গে শিশুর পারস্পরিক মেলবন্ধনই হল সামাজিকীকরণ।
তাই সামাজিকীকরণ হল সমাজের সঙ্গে বা পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা। এই সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিশু সমাজ ও সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক যেমন – সামাজিক রীতিনীতি, সামাজিক নিয়ম-শৃঙ্খলা, মূল্যবোধ, প্রভৃতি বিষয় সহজে আয়ত্ত করার মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণ মানুষ হিসাবে গড়ে ওঠে।
সামাজিকীকরণ pdf (Socialization)
সামাজিকীকরণ বলতে বোঝায় শিশুকে সমাজের সঙ্গে মানিয়ে চলতে সাহায্য করা। এটি পরিবর্তনশীল সমাজের সঙ্গে সার্থক অভিযোজনের মাধ্যমে শিশুকে উপযুক্ত হিসেবে গড়ে তোলে। অর্থাৎ সামাজিকীকরণ হল শিশুকে সতত পরিবর্তনশীল সমাজের সঙ্গে অভিযোজনে বিশেষভাবে সহায়তা করা।
সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়ে শিশুকে সমাজের উপযুক্ত হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভবপর হয়। শিশু জন্ম মুহূর্তে সামাজিক হয়ে জন্মগ্রহণ করে না। শিশু যে পরিবেশে বা যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করে সেই পরিবেশ ও পরিবার শিশুকে সমাজ উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলে।
অর্থাৎ সমাজের নিয়ম কানুন, আচার-আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ, নৈতিকতা প্রভৃতির উপযুক্ত বিকাশের মধ্য দিয়ে শিশুকে সমাজ উপযোগী বা সামাজিকীকরণে বিশেষভাবে সাহায্য করে।
সামাজিকীকরণের সংজ্ঞা (Definition of Socialization Process)
বিভিন্ন সমাজতাত্ত্বিক বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সামাজিকীকরণকে সংজ্ঞায়িত করেছেন, এখানে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা উল্লেখ করা হল –
1. সামাজিকীকরণের সংজ্ঞা হিসেবে বিশিষ্ট সমাজবিদ কিংসলে ডেভিসের (Kingsley Device) বলেছেন – সামাজিকীকরণ হল এমন পদ্ধতি যার মাধ্যমে মানব শিশু ক্রমশ সামাজিক মানুষে পরিণত হয়ে ওঠে।
2. আবার, পিটার ওরস্লে (Peter Worsley) – এর মতে, “Socialization as the process of trans mission of culture the process whereby men learn the rules and practices of social group.” অর্থাৎ সামাজিকীকরণ হল সংস্কৃতির আদান-প্রদানের প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে শিশুরা সামাজিক গোষ্ঠীর নিয়ম-কানুন এবং অনুশীলনগুলি আয়ত্ত করে।
শিশুর সামাজিকীকরণে বিদ্যালয়ের ভূমিকা (Role of School in Socialization Process)
সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে শিশুকে বিশেষভাবে সাহায্য করে পরিবার (Family), বিদ্যালয় (School) বন্ধু দল, প্রতিবেশী প্রভৃতি। শিশুর সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
শিশুর সামাজিকীকরণে বিদ্যালয়ের ভূমিকা (Role of School in Socialization Process) যে সমস্ত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলি আলোচনা করা হল –
1. বিদ্যালয় পরিবেশে অভিযোজন
শিশুর সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের অন্যতম ভূমিকা (Role of School in Socialization Process) পালন করে থাকে। শিশুরা যখন বাড়ির পরিবেশ থেকে বিদ্যালয়ের পরিবেশে পদার্পন করে তখন এক নতুন পরিবেশ শিশুরা উপলব্ধি করতে থাকে।
আর বিদ্যালয় শিশুকে এই নতুন পরিবেশে সহজে শিশুকে মানিয়ে নিতে বা সামাজিকীকরণে বিশেষভাবে সাহায্য করে থাকে। বিদ্যালয়ের পরিবেশে অভিযোজন এর মাধ্যমে শিশুর মধ্যে মানিয়ে নেয়ার প্রবণতা গঠন হয়ে থাকে।
2. ব্যক্তিত্ত্বের বিকাশসাধন
বিদ্যালয় শিশুকে সার্থক সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনে বিশেষভাবে সাহায্য করে থাকে। শিক্ষার্থীর চারিত্রিক, নৈতিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক প্রভৃতির বিকাশ সাধন করে থাকে।
অর্থাৎ বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের মাধ্যমে ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশে বিশেষভাবে সহায়তা করে থাকে। ফলে শিশুরা সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে সহজে মিলেমিশে থাকতে পারে বা সামাজিকীকরণ করতে পারে।
3. সামাজিক ঐতিহ্যের সংরক্ষন ও সঞ্চালন
শিশুর সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের অন্যতম ভূমিকা (Role of School in Socialization Process) হল সামাজিক ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও সঞ্চালন করা। এর ফলে প্রাচীন ঐতিহ্যগুলি সহজে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চালিত হয়।
4. বৃত্তিমুখী নির্দেশনাদান
শিশুর সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের অন্যতম ভূমিকা (Role of School in Socialization Process) হল বৃত্তিমুখী নির্দেশনা দান করা। এর ফলে শিশুরা ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য উপযোগী হয়ে গড়ে উঠতে পারে।
অর্থাৎ ভবিষ্যৎ জীবনের কোন বৃত্তি বা পেশা গ্রহণের মধ্য দিয়ে জীবিকা অর্জন করবে তা সহজে বিদ্যালয় শিশুকে নির্দেশনা দিয়ে থাকে। তাই শিশুরা ভবিষ্যতে কি ধরনের বৃত্তি বা পেশা গ্রহণ করবে সে বিষয়ে বিদ্যালয় বিশেষভাবে সহায়তা করে থাকে।
আরোও পোস্ট পড়ুন – Click Here Now |
5. অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার বর্জন
শিক্ষার মাধ্যমে জ্ঞানের আলো জ্বালানোর মধ্য দিয়ে সমাজের কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাস দূরীকরণ করা সম্ভব হয়। এক্ষেত্রে বিদ্যালয় শিশুকে সমাজের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার বর্জন করতে সহায়তা করে। ফলে শিশু আধুনিক যুক্তি নির্ভর, বিজ্ঞান চেতনাসম্পন্ন সামাজিক মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে।
তাই বিদ্যালয় শিশুকে যাবতীয় অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার বর্জনের মধ্য দিয়ে সামাজিকীকরণে (Role of School in Socialization Process) বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
6. গণতান্ত্রিক চেতনার সঞ্চার
বিদ্যালয় শিশুকে গণতান্ত্রিক চেতনার সঞ্চার ঘটাতে বিশেষভাবে সাহায্য করে থাকে। গণতন্ত্র হল সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা। তাই বিদ্যালয় গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক। গণতান্ত্রিক চেতনা সঞ্চারের মধ্য দিয়ে বিদ্যালয় শিশুকে সামাজিকীকরণে বিশেষভাবে সাহায্য করে থাকে।
7. আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন
সামাজিকীকরণের মাধ্যম হিসেবে বিদ্যালয় শিশুকে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করতে সহায়তা করে। অর্থাৎ বিদ্যালয় পরিবারের গণ্ডি থেকে বের করে নিয়ে এসে শিশুকে মুক্ত সমাজের মধ্যে বিশেষ করে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে সেতু হিসাবে কাজ করে।
তাই দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজের সঙ্গে বা আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে শিশুকে পরিচিতিকরণের মাধ্যমে বিদ্যালয় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে শিশু সামাজিকীকরণের উপযুক্ত হয়ে গড়ে ওঠে।
উপসংহার (Conclusion)
পরিশেষে কথা বলা যায়, শিশুর সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের ভূমিকা অনবদ্য। তাই বিদ্যালয়কে শিক্ষাবিদ ফ্রয়েবেল – সমাজের ক্ষুদ্র সংস্করণ (School is a miniature society) হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। তাই বিদ্যালয় হল এমন একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে শিশুর সর্বাঙ্গীণ বিকাশের সাথে সাথে সামাজিকীকরণ সহজে সম্ভবপর হয়।
আবার, বিদ্যালয় সম্পর্কে জন ডিউই (John Dewey) বলেছেন – “The school is to be a reflection of the larger society outside its walls, in which life can be learnt by living. But it is to be a purified, simplified and better balanced society.” অর্থাৎ বিদ্যালয় হল সরলীকৃত, বিশুদ্ধকৃত এবং আদর্শ সমাজ।
তথ্যসূত্র (Reference)
- Brown, F. J. (1954). Educational Sociology. New York: Prentice-Hall.
- Bhattacharjee, Srinivas. (1996). Philosophical & Sociological Foundation of Education. Herald book service.
- Das, P. (2007). Sociological Foundation of Education. New Delhi: Authorspress
- Shukla, S & K Kumar. (1985). Sociological Perspective in Education. New Delhi, Chanakya
Publications - Sodhi, T.S & Suri, Aruna. (1998). Philosophical & Sociological Foundations of Education, H.P Bhargav Book House, Agra,
প্রশ্ন – সামাজিকীকরণ কাকে বলে?
উত্তর – সমাজবিদ কিংসলে ডেভিসের (Kingsley Device) বলেছেন – সামাজিকীকরণ হল এমন পদ্ধতি যার মাধ্যমে মানব শিশু ক্রমশ সামাজিক মানুষে পরিণত হয়ে ওঠে।
প্রশ্ন – সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া কখন থেকে শুরু হয়?
উত্তর – সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া শিশুর জন্মের পর থেকে শুরু হয় এবং এটি সারাজীবন চলতে থাকে। অর্থাৎ সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া জন্মের পর থেকে শুরু হয়ে জীবনকাল ব্যাপী পর্যন্ত চলতে থাকে।
প্রশ্ন – সামাজিকীকরণের চারটি প্রধান এজেন্ট কি কি?
উত্তর – সামাজিকীকরণের চারটি প্রধান এজেন্ট বা সংস্থা হল পরিবার (Family), বিদ্যালয় (School), বন্ধু দল (Peer Groups), এবং গণমাধ্যম (Mass Media)
প্রশ্ন – শিশুর বিকাশে বিদ্যালয়ের ভূমিকা
উত্তর – শিশুর বিকাশে বিদ্যালয়ের ভূমিকা অনবদ্য। কারণ একটি শিশু পরিবার থেকে শিক্ষা অর্জনের পর বিদ্যালয়ে পদার্পণ করে। তাই বিদ্যালয় শিশুকে সমাজ উপযোগী করে গড়ে তোলে। অর্থাৎ শিশুর বিকাশে বিদ্যালয়ের ভূমিকা হল – শিশুর সর্বাঙ্গীন বিকাশ সাধন, মূল্যবোধ গঠন, চারিত্রিক বিকাশ, সামাজিক বিকাশ সাধন, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দান ও সমাজের একজন আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা।
আরোও পড়ুন
- যোগাযোগ কাকে বলে | যোগাযোগ প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য | What is Definition of Communication
- যোগাযোগ প্রক্রিয়ার উপাদান | 8 Essential Components of Communication
- শিক্ষার সমাজতত্ত্বের পরিধি | Scope of Sociology of Education
- সামাজিক স্তরবিন্যাস কি | সামাজিক স্তরবিন্যাসের ধরন | Types of Social Stratification
- Social Mobility: সামাজিক সচলতা কাকে বলে | সামাজিক সচলতার বৈশিষ্ট্য
- Types of Social Mobility: সামাজিক সচলতার প্রকারভেদ
1 thought on “শিশুর সামাজিকীকরণে বিদ্যালয়ের ভূমিকা | Socialization Process”