ব্রিটিশ ভারতের শিক্ষা বিস্তারে জন্য ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিভিন্ন কর্মসূচি ও শিক্ষানীতি গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হল উডের ডেসপ্যাচ (Wood Despatch)।
ব্রিটিশ কোম্পানি বুঝতে পেরেছিল যে শিক্ষার মত একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ক্ষেত্রে শিক্ষা নীতি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলির নিয়ন্ত্রণে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সেই কারণে ১৮৫৩ সালে সনদ নবীকরণের সময় ভারতের শিক্ষা ক্ষেত্রে সার্বিক অনুসন্ধান করে উডের ডেসপ্যাচ এর কথা বলেন।
উডের ডেসপ্যাচ কি | Wood Despatch
উডের ডেসপ্যাচ হল ভারতীয় শিক্ষার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দলিল। যেটি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক ভারতীয় শিক্ষা ক্ষেত্রে সার্বিক অনুসন্ধান করে লিখিত একটি শিক্ষা সংক্রান্ত প্রথম দলিল।
ভারতবর্ষের শিক্ষা বিস্তার এর ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকার একটি শিক্ষা কমিটি গঠন করেন। কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে ১৮৫৪ সালে স্যার চার্লস উডের সভাপতিত্বে যে মূল্যবান শিক্ষা সনদ রচিত হয় সেটিকে উডের ডেসপ্যাচ বলা হয়ে থাকে।
এই উডের ডেসপ্যাচ বা নির্দেশনামাটি ১৮৫৪ সালের উনিশে জুলাই ভারতের ব্রিটিশ কোম্পানির কাছে প্রেরণ করা হয়। এই ডেসপ্যাচের সদস্যদের মধ্যে অন্যতম হলেন – মিস্টার ট্রাভেলিয়ন, ক্লার্ক মার্সম্যান, আলেকজান্ডার ডাফ প্রমূখ।
আরোও পোস্ট পড়ুন – Click Here Now |
উডের ডেসপ্যাচ সুপারিশ
ইংরেজ শাসনকালে ভারতে শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে উড ডেসপ্যাচ অন্যতম শিক্ষা দলিল। উডের ডেসপ্যাচ সুপারিশ গুলি যে সমস্ত দিক থেকে পরিলক্ষিত হয় সেগুলি হল নিম্নলিখিত –
1. শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
উডের ডেসপ্যাচ সুপারিশ গুলির মধ্যে অন্যতম হলো শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সংক্রান্ত সুপারিশ। এই শিক্ষা দলিল অনুযায়ী শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য গুলি হল –
i) ভারতীয়দের মধ্যে পাশ্চাত্য জ্ঞান বিস্তার করাই হবে শিক্ষার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
ii) এই পাশ্চাত্য শিক্ষা ভারতবাসী নৈতিক চরিত্র গঠনে সহায়ক হবে।
iii) এই পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্রিটিশ কোম্পানিকে বিশ্বস্ত ও দক্ষ ভারতীয় কর্মচারী সরকারি সরবরাহ করবে।
iv) পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ফলে ভারতবাসীরা পুঁজি ও শ্রম বিনিয়োগের ফলাফল বুঝতে পারবে। ফলে ইংল্যান্ডের শিল্পের জন্য এদেশ থেকে পাবে কাঁচা মাল এবং বিনিময়ে ইংল্যান্ড ভারতবর্ষে তার শিল্পজাত সম্পদ বিক্রি করবে।
2. শিক্ষা বিভাগ প্রতিষ্ঠা
উডের ডেসপ্যাচ সুপারিশ হল কোম্পানির অন্তর্ভুক্ত পাঁচটি প্রদেশে একটি করে শিক্ষা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা। এই পাঁচটি প্রদেশ হল – বাংলা, মুম্বাই, মাদ্রাজ, পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ। এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে যথাযথভাবে পরামর্শদান ও শিক্ষার সার্বিক উন্নয়ন সম্পর্কে সরকারের কাছে বার্ষিক রিপোর্ট পেশ করতে হবে।
3. বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা
উডের ডেসপ্যাচ সুপারিশ গুলির মধ্যে এটি দ্বিতীয় সুপারিশ। এই সুপারিশ অনুযায়ী লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বেতে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম হবে আইন, চিকিৎসাবিদ্যা, ইঞ্জিনিয়ারিং প্রভৃতি। যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যৎ জীবনের উপযোগী হয়ে গড়ে উঠবে।
4. স্তরবিন্যাস শিক্ষাব্যবস্থা
উডের ডেসপ্যাচে স্তরবিন্যাস শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। এই স্তর বিন্যস্ত শিক্ষা ব্যবস্থার সর্বোচ্চ স্থানে থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়, তারপরে মহাবিদ্যালয় এবং তারপরে মাধ্যমিক শিক্ষা ও সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে প্রাথমিক স্তর।
5. প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা
উডের ডেসপ্যাচ সুপারিশ হল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাকে উন্নত সাধন ও বিস্তার সাধন করা। এর জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্য করার সুপারিশ করা হয়েছে।
6. Grant-in-Aid Syatems বা অনুদান প্রথা
উড ডেসপ্যাচ এর অন্যতম সুপারিশ হল Grant-in-Aid Syatems বা অনুদান প্রথা। অর্থাৎ সরকারি অনুদান পেলে বেসরকারি সংস্থাগুলি নতুন নতুন বিদ্যালয় স্থাপনে আগ্রহী হবে। তাই এটি শর্তসাপেক্ষে আরোপ করতে হবে। এই শর্তগুলি হল –
i) বিদ্যালয়ের ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখা,
ii) শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে খুবই সামান্য পরিমাণ বেতন নেওয়া। অর্থাৎ অতিরিক্ত বেতন না নেওয়া।
iii) শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটানো প্রভৃতি।
7. শিক্ষক শিক্ষণ
শিক্ষক শিক্ষণের ক্ষেত্রে উডের ডেসপ্যাচ এ বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কারণ শিক্ষার মান নির্ভর করে শিক্ষকের উপর। তাই উডের ডেসপ্যাচ এর সুপারিশ হল শিক্ষককে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
8. নারী শিক্ষা
নারী শিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে উড ডেসপ্যাচ এর সুপারিশ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এখানে বলা হয়েছে – এদেশে, অর্থাৎ ভারতবর্ষে নারী শিক্ষার প্রসার ঘটেনি। অথচ উপযুক্ত নারী শিক্ষার প্রসার ছাড়া জনশিক্ষা কখনোই সম্ভব নয়। তাই তাই নারী শিক্ষার প্রসারের জন্য অধিক সংখ্যক বিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করা হয়।
9. বৃত্তি শিক্ষার প্রসার
উডের ডেসপ্যাচ সুপারিশ গুলির মধ্যে অন্যতম হল বৃত্তি শিক্ষার প্রসার ঘটানো। অর্থাৎ এই ডেসপ্যাচ এ সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবনের উপযোগী করে তোলার জন্য চিকিৎসা, আইন, ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রযুক্তিবিদ্যা প্রভৃতি বৃত্তিমূলক শিক্ষাদানের সুপারিশ করা হয়েছে।
উপসংহার (Conclusion)
সর্বোপরি বলা যায়, তবে উডের ডেসপ্যাচ ব্রিটিশ কোম্পানি দ্বারা রচিত এমন শিক্ষানীতি যেটি ব্রিটিশদের স্বার্থে রচিত হয়েছিল। সেই কারণে এই ডেসপ্যাচ এর কমিটির সদস্যরা বলেন – “ভারতের শিক্ষা বিস্তার হলে সরকারের আশঙ্কার কোনো কারণ নেই। বরং শিক্ষিত সম্প্রদায় ইংরেজ রাজত্বের সহায়ক হবে”।
সুতরাং এই শিক্ষা দলিল যতটা না ভারতীয়দের শিক্ষার জন্য রচিত হয়েছিল তার পশ্চাতে ছিল ব্রিটিশ সরকারের স্বার্থ। তাই এই শিক্ষা দলিল পরবর্তীকালে বিভিন্নভাবে সমালোচিত হয়।
তথ্যসূত্র (References)
- Education in India-Past-Present-Future, Vol. I and II, J. P. Banerjee
- Landmarks in the History of Modern Indian Education, J. C. Aggarwal
- History of Education in India, Dr. R N Sharma and R K Sharma
- Report of Commissions – Radhakrishnan, Mudaliar, Kothari.
- National Policy on Education, 1986. Policy perspective.
- Internet Sources
প্রশ্ন – উডের ডেসপ্যাচ কত সালে হয়
উত্তর – ইংরেজ সরকারের প্রচেষ্টায় ১৮৫৪ সালে স্যার চার্লস উডের সভাপতিত্বে ভারতের শিক্ষার ইতিহাসে উডের ডেসপ্যাচ রচিত হয়।
প্রশ্ন – উডের ডেসপ্যাচ এর গুরুত্ব কি
উত্তর – ভারতের শিক্ষার ইতিহাসে ১৮৫৪ সালের উডের ডেসপ্যাচ এর গুরুত্ব যে সমস্ত দিক থেকে পরিলক্ষিত হয় তা হল –
i) এটি ভারতীয় শিক্ষার বৃটিশদের দ্বারা প্রথম শিক্ষা দলিল।
ii) শিক্ষার বিভিন্ন দিকে এটির ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। যেমন – নারী শিক্ষা, বৃত্তি শিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রভৃতি।
প্রশ্ন – উডের ডেসপ্যাচ কে ম্যাগনাকার্টা বলা হয় কেন
উত্তর – ভারতীয় শিক্ষার ইতিহাসে সমকালীন শিক্ষা পরিস্থিতিতে ১৮৫৪ সালের উড ডেসপ্যাচকে অনেকে ম্যাগনাকার্টা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ম্যাগনাকার্টা একটি অধিকার পত্র বা সনদপত্র হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। কিন্তু নিরপেক্ষ বিচারে এটিকে কোনভাবেই এই আখ্যা দেওয়া যায় না। কারণ এই নির্দেশনামার মাধ্যমে শিক্ষা ক্ষেত্রে আংশিক দায়িত্ব পালন করার সুপারিশ করা হয়েছে মাত্র। অর্থাৎ এটি সরকারের অঙ্গীকার পত্র নয়। তাই উডের ডেসপ্যাচ কে ম্যাগনাকার্টা বলা যুক্তিযুক্ত নয়।
আরোও পড়ুন
- শিখনের উপাদান গুলি কি কি | Factors Affecting Learning
- শিক্ষার অধিকার আইন 2009 | Right to Education Act | RTE Act 2009
- মনোযোগ কাকে বলে | শিক্ষাক্ষেত্রে মনোযোগের ভূমিকা | Attention in Psychology
- শিখন সঞ্চালনের তত্ত্ব | Theory of Transfer of Learning
- শিখন সঞ্চালনের প্রকারভেদ | Types of Transfer of Learning
- আগ্রহ কাকে বলে | শিক্ষাক্ষেত্রে আগ্রহের গুরুত্ব লেখ | Interest in Psychology