শিক্ষা হল ব্যক্তির সর্বাঙ্গিন বিকাশ সাধনের প্রক্রিয়া স্বরূপ। শিশু জন্মগ্রহণ করার পর থেকে আমৃত্যু পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। তাই শিক্ষার পরিধি ব্যাপক ও বিস্তৃত। অর্থাৎ শিক্ষার পরিধি (Scope of Education) নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে সীমাবদ্ধ নয়।
শিক্ষার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থী সামাজিক বিকাশ, চারিত্রিক বিকাশ, আধ্যাত্মিক বিকাশ, নৈতিক বিকাশ, মূল্যবোধের বিকাশ প্রভৃতি সম্ভব পর হয়ে থাকে। শিক্ষার সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে শিক্ষার পরিধির একটি সম্যক ধারণা পাওয়া যায়।
শিক্ষার পরিধি | Scope of Education
একটি শিশুর জীবনচক্রে শিক্ষার জন্য যা কিছু প্রয়োজন তা সবকিছু শিক্ষা পরিধির মধ্যেই অন্তর্গত। শিক্ষার পরিধি যে সমস্ত দিক থেকে পরিলক্ষিত হয়ে থাকে, সেগুলি হল নিম্নলিখিত –
1. শিক্ষায় দর্শন
শিক্ষাক্ষেত্র দর্শনের অবদান অনস্বীকার্য। তাই শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে দর্শনের বিশেষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ভাববাদ, প্রকৃতিবাদ, প্রয়োগবাদ ও বস্তুবাদ প্রকৃতি দার্শনিক ভিত্তিতে শিক্ষার লক্ষ্য, পাঠক্রম, শিক্ষাদান পদ্ধতি প্রভৃতি নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।
2. শিক্ষায় মনোবিজ্ঞান
আধুনিক শিক্ষা মনোবিজ্ঞান সম্মত। তাই শিক্ষায় মনোবিজ্ঞানের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। অর্থাৎ মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন নীতি ও পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে আধুনিককালের শিক্ষাদান পদ্ধতি সহজভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
তাই শিক্ষার্থীর আচার-আচরণের মনোবিজ্ঞান সম্মত বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে শিক্ষার মনোবিজ্ঞান বিশেষভাবে প্রযোজ্য। তাই মনোবিজ্ঞানের সাহায্যে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ, প্রবণতা, সমর্থ্য প্রভৃতির উপর গুরুত্ব আরোপ করার মধ্য দিয়ে শিক্ষাদান কার্য সহজে সম্পন্ন করা যায়। তাই শিক্ষায় মনোবিজ্ঞান শিক্ষার পরিধির মধ্যে অন্যতম ভূমিকা পালন করে।
3. শিক্ষায় সমাজবিজ্ঞান
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সমাজের বাইরে মানুষের একক কোনো অস্তিত্ব নেই। শিক্ষার লক্ষ্য হল সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়ে সমাজ উপযোগী করে গড়ে তোলা। তাই শিক্ষার সমাজবিজ্ঞান শিক্ষার পরিধির মধ্যে অন্তর্গত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
তাই শিক্ষার মধ্য দিয়ে সামাজিক রীতিনীতি, আচার অনুষ্ঠান, সামাজিক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ এবং সঞ্চালন করা সম্ভবপর হয়ে থাকে। অর্থাৎ সমাজ অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাই শিক্ষার একটি অন্যতম বিষয় সমাজবিজ্ঞান।
4. শিক্ষায় পাঠক্রম
শিক্ষার লক্ষ্যকে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পাঠক্রমের ভূমিকা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। পাঠক্রম ছাড়া শিক্ষার কাজ সুসম্পন্ন করা সম্ভবপর নয়। তাই শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথ হল পাঠক্রম।
তাই কানিংহাম বলেছেন – পাঠক্রম হলো শিক্ষকের হাতিয়ার, যা দিয়ে তিনি বিদ্যালয়ের আদর্শ অনুযায়ী শিশুকে গঠন করেন।
5. শিক্ষার রাশিবিজ্ঞান
শিক্ষার্থীরা কতটা জ্ঞান অর্জন করেছে বা পারদর্শিতা অর্জন করেছে তার মূল্যায়নের জন্য শিক্ষায় রাশিবিজ্ঞানের প্রভাব পরিলক্ষিত। অর্থাৎ রাশিবিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিকভাবে পারদর্শিতার মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। রাশিবিজ্ঞান ছাড়া এই কাজটি কখনোই সংরক্ষণ নয়। রাশিবিজ্ঞান শিক্ষার একটি অন্যতম বিষয় যার শিক্ষার পরিধির মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
6. শিক্ষায় প্রযুক্তিবিজ্ঞান
বর্তমান যুগ প্রযুক্তিনির্ভর। শিক্ষার ক্ষেত্রেও প্রযুক্তির অনুপ্রবেশ ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। তাই প্রযুক্তির সাহায্যে ব্যতীত আধুনিক শিক্ষা কার্যক্রম সুসম্পন্ন করা সম্ভবপর নয়। প্রযুক্তি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে শিক্ষাকে অধিক বেশি শিক্ষার্থীদের কাছে কার্যকরী করা সম্ভবপর হচ্ছে।
শিক্ষার প্রযুক্তি শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা করে তা নয় এটি শিক্ষক, গবেষক ও অন্যান্য শিক্ষা অনুরাগী ব্যক্তিবর্গকে বিশেষভাবে সহায়তা করে থাকেন। যা শিক্ষার অগ্রগতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই বর্তমানে প্রযুক্তিবিদ্যা শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় – বর্তমানে শিক্ষাকে আকর্ষণীয় করার জন্য বিভিন্ন অডিও ভিজুয়াল মাধ্যম বা কম্পিউটারের সাহায্য নিয়ে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মধ্য দিয়ে শিক্ষাদান কার্য সম্পন্ন করা হচ্ছে। যার ফলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষার অধিক বেশি আগ্রহী ও মনোযোগী হয়ে উঠছে।
7. শিক্ষায় মানসিক স্বাস্থ্য
শিক্ষা ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি বর্তমানে অধিক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সুস্থ মন সুস্থ শরীরের পরিচয়। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য যদি সঠিক না থাকে তাহলে তারা সঠিকভাবে শিক্ষা গ্রহণ করতে ব্যর্থ।
তাই শিক্ষার্থীদের দৈহিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের যাতে আধুনিক শিক্ষায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে। কিভাবে মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখা যায় বা মানসিক স্বাস্থ্য গঠনে শিক্ষক, অভিভাবকদের ভূমিকা কি সেই সম্পর্কে আলোচনা বর্তমানে শিক্ষার পরিধির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।
এগুলি ছাড়াও শিক্ষার পরিধির মধ্যে আর যে সমস্ত বিষয় গুরুত্বপূর্ণ সেগুলি হল –
- শিক্ষায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র
- শিক্ষায় ইতিহাস
- শিক্ষায় অর্থনীতি
- তুলনামূলক শিক্ষা
- শিক্ষায় মূল্যায়ন ব্যবস্থা প্রভৃতি।
উপসংহার (Conclusion)
পরিশেষে বলা যায়, শিক্ষার পরিধির মধ্যে দর্শন, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, মানসিক স্বাস্থ্য, রাশিবিজ্ঞান, মূল্যায়ন ব্যবস্থা প্রভৃতি বিশেষভাবে অন্তর্ভুক্ত। তাই শিক্ষার পরিধি একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধকরণ করা সম্ভবপর নয়। উপরে উল্লেখিত সমস্ত বিষয়গুলির সম্মিলিত প্রচেষ্টা শিক্ষার পরিধির অন্তর্গত।
তথ্যসূত্র (References)
- Aggarwal, J. C., Theory and Principles of Education. 13th Ed. Vikas Publishing House Pvt. Ltd.
- V.R. Taneja, Educational Thoughts & Practice. Sterling Publication Pvt. Ltd. New Delhi
- Nayak, B.K, Text Book of Foundation of Education. Cuttack, Odisha: KitabMhal
- Ravi, S. Samuel, A Comprehensive Study of Education, Fourth Printing-May 2016, Delhi – 110092, ISBN – 978-81-203-4182-1,
- Internet sources
আরোও পড়ুন
- শিক্ষা কি | শিক্ষার 15 টি সংজ্ঞা | Concept and Best Definition of Education
- Role of Television: গণমাধ্যম হিসেবে টেলিভিশনের ভূমিকা
- সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষা বলতে কী বোঝো | 2 টি সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য | Narrow Meaning of Education
- ব্যাপক অর্থে শিক্ষা কি | সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য | Broader Meaning of Education
- ডেলর কমিশনের শিক্ষার চারটি স্তম্ভ | Delors Commission in Bengali
- শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা কি (Child Centered Education) : ধারণা, সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য