প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে অন্যতম ছিল ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থা (Brahmanic Education System)। এই শিক্ষা ব্যবস্থা মূলত ব্রাহ্মণদের দ্বারা পরিচালিত হতো এবং এটি ছিল ধর্মীয় আচার সর্বস্ব শিক্ষা ব্যবস্থা।
ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থা | Brahmanic Education System
আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার বছর থেকে ৩০০ বছর পর্যন্ত প্রাচীন ভারতে আর্য সভ্যতার যুগে বেদ নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার সূচনা হয়। এই শিক্ষাব্যবস্থা ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থা নামে পরিচিত ছিল। বিদ্যা সমাজের মানুষকে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে এই ছিল প্রাচীন ঋষিদের বিশ্বাস। ফলে জাগতিক ও পারমাণবিক দিক থেকে বিদ্যার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার জন্য যে সুপ্রাচীন, সুসংবদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল সেটি হল ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থা।
ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য | Brahmanic Education System Features
বাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল বৈদিক শিক্ষা ব্যবস্থার একটি উন্নত রূপ। এই শিক্ষার সঙ্গে জীবনের যোগ ছিল ঘনিষ্ঠ। ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য যে সমস্ত দিক থেকে পরিলক্ষিত হয়, সেগুলি হল নিম্নলিখিত –
শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
প্রাচীন ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষ্য ছিল মূলত ধর্মকেন্দ্রীক। এই শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে সুনির্দিষ্ট নিয়ম-শৃঙ্খলা ছিল। এই ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থার শিক্ষার লক্ষ্য গুলি হল –
i) আত্মার মুক্তি সাধন,
ii) পরাবিদ্যার অনুশীলন.
iii) দেহ ও মনের বিকাশ সাধন। অর্থাৎ ধ্যান ও মননের মাধ্যমে ব্যক্তির দেহ ও মনের বিকাশ সাধন করা।
iv) ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন
v) আত্মশৃঙ্খলা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ করা।
শিক্ষার পাঠক্রম
ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থার পাঠক্রম ছিল বর্ণ কেন্দ্রিক। অর্থাৎ সমাজে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্রদের জন্য আলাদা আলাদা পাঠক্রমের ব্যবস্থা ছিল। তাছাড়া এই শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের যে সমস্ত বিষয় পাঠক্রমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল সেগুলি হল – অনুশাসন, বিদ্যা, ইতিহাস পুরাণ, বাকবাক্রম, আখ্যান, অনুআখ্যান, অনুব্যাখ্যান, নক্ষত্রবিদ্যা, ব্রহ্মবিদ্যা প্রভৃতি।
শিক্ষণ পদ্ধতি
প্রাচীন ব্রাহ্মণ্য যুগে শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার মতো ব্রাহ্মণ্য যুগের শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ব্রাহ্মণ্য যুগের শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষাদান পদ্ধতির মধ্যে যে সমস্ত দিক বর্তমান সেগুলি হল –
i) শিক্ষাদান পদ্ধতি স্তর – ব্রাহ্মণ্য যুগে শিক্ষাদান পদ্ধতির কয়েকটি স্তর ছিল। যথা – উপক্রম, অভ্যাস, অপূর্বতা, ফল, অর্থাবাদ ও উপপত্তি।
ii) গল্পের ছলে শিক্ষা – ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থায় গল্পের ছলে বা গল্পের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। তাই পঞ্চতন্ত্র ও হিতোপ্রদেশের কথা প্রথমেই বলা হয়েছে। জটিল ও নিরস বিষয়কে সহজ করে বোঝানোর জন্য এই পদ্ধতি ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
তাছাড়া প্রশ্নোত্তর পদ্ধতি, পাদপূরণ পদ্ধতি প্রভৃতি শিক্ষাদান পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক
ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষক শিক্ষার্থী বা গুরু শিষ্যের মধ্যে সম্পর্ক ছিল পিতা পুত্রের ন্যায় অতি নিবিড় ও মধুর। শিক্ষার্থীরা গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ভালোবাসা দেখাতেন। আবার গুরু বা শিক্ষক শিশুদের আপন সন্তানের মত দেখতেন। এর ফলে উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক অতি নিবিড় হয়ে উঠতো।
তাছাড়া ‘আদিত্যদর্শন’ নামক অনুষ্ঠানে আচার্য (গুরু বা শিক্ষক) ব্রহ্মচারীকে (শিক্ষার্থী বা শিষ্য) সঙ্গে নিয়ে বস্তুদেবতা অগ্নিকে প্রদক্ষিণ করে ‘গুরু শিষ্যের মধ্যে সম্পর্ক অচ্ছেদ্য হোক’ এই প্রার্থনা করতেন।
শিক্ষায় শৃঙ্খলা
ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে শৃঙ্খলা ছিল একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কারণ শৃঙ্খলা সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাকে সুশৃংখল করে গড়ে তোলে। তাই ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার পরিবেশ ছিল শান্ত এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিল একাগ্রতা। তাছাড়া ব্রাহ্মণ্য শিক্ষায় শৃঙ্খলা ছিল কঠোর প্রকৃতির। তাই শিক্ষার্থীদের কঠোর আচরণবিধি মেনে চলতে হতো। যেমন স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়ম কানুন, ধর্মীয় অনুশাসন, নৈতিক অনুশাসন প্রভৃতি।
তাছাড়া মিথ্যা কথা বলা, গুরুকে নিন্দা করা, পঠন পাঠনে অবহেলা করা, আরাম করে বসা, হাই তোলা, গুরুর সামনে থুতু ফেলা প্রভৃতি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল।
মূল্যায়ন ব্যবস্থা
ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে মূল্যায়ন ব্যবস্থা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থায় আধুনিক শিক্ষার মতো কোনো প্রথাগত মূল্যায়ন ব্যবস্থা বা পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু ছিল না। এই যুগের শিক্ষায় শিষ্যদের বা শিক্ষার্থীদের কেবলমাত্র বিতর্ক সভার মধ্য দিয়ে যোগ্যতা বিচার করে বৃ বিদ্যাস্নাতক, ব্রতস্নাতক, বিদ্যাব্রতস্নাতক উপাধি দেওয়া হত। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থার মূল্যায়ন পদ্ধতি ছিল মৌখিক পদ্ধতি।
শিখনের কেন্দ্র
ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থায় শিখনের কেন্দ্র বা বিদ্যালয় ছিল গুরু গৃহ। তাছাড়া ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থায় টোল, পরিষদ, চরণ, কুল প্রভৃতি নানা ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। তাছাড়া জনসাধারণের দানে উত্তর ভারতের কনৌজ, বারানসি, নবদ্বীপ, দক্ষিণ ভারতের কল্যাণী, নাসিক প্রভৃতি স্থানে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল।
গুরুকুল পদ্ধতি (Gurukul System)
ব্রাহ্মণ্য শিক্ষায় ছাত্ররা গুরুগৃহে থেকে শিক্ষা গ্রহণ করত। এটি আবাসিক শিক্ষাপদ্ধতি ছিল এবং শিক্ষককে গুরুদক্ষিণা দেওয়া হতো। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি ছিল মূলত আবাসিক প্রকৃতির। এখানে শিক্ষার্থীদের গুরু গৃহে থেকে শিক্ষা লাভ করতে হতো।
নারী শিক্ষা
ব্রাহ্মণ যুগে পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শ প্রচলিত ছিল। সেই কারণে ব্রাহ্মণ্য যুগে নারী শিক্ষা কিছুটা অবহেলিত হয়েছিল। তবে মেয়েরা কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষা লাভ করতে পারত। অর্থাৎ মেয়েরা বেদ অধ্যাপনার পাশাপাশি পুস্তক রচনা করেছিলেন। আবার নৃত্য, গীত ও বাদ্যে বৈদিক যুগের মেয়েদের পারদর্শিতার কথা জানা যায়।
উপসংহার (Conclusion)
সর্বোপরি বলা যায়, ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রাচীন ভারতে একটি ধর্মভিত্তিক ও নিয়ন্ত্রিত সমাজ কাঠামোর ভিত্তি গড়ে তোলা হয়েছিল। এটি জ্ঞান ও নৈতিকতার উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছিল। এই শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ছিল। যেমন – নারী ও নিম্নবর্ণের মানুষদের বঞ্চিত করা প্রভৃতি। এই শিক্ষাব্যবস্থার কিছু দিক আজও ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।
তথ্যসূত্র (References)
- Education in India-Past-Present-Future, Vol. I and II, J. P. Banerjee
- Landmarks in the History of Modern Indian Education, J. C. Aggarwal
- History of Education in India, Dr. R N Sharma and R K Sharma
- Report of Commissions – Radhakrishnan, Mudaliar, Kothari.
- National Policy on Education, 1986. Policy perspective.
- Brahmanic Education System Features
- Internet Sources
প্রশ্ন – ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলি কি কি?
উত্তর – ব্রাহ্মণ্য শিক্ষার প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলি হল – ধর্ম কেন্দ্রিক বা বেদ নির্ভরতা, আধ্যাত্মিক মূলক, আবাসিক এবং মৌখিক শিক্ষাদান পদ্ধতি। জীবনের চতুরাশ্রম পালনকে শিক্ষার একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
প্রশ্ন – ব্রাহ্মণ্য শিক্ষায় শিক্ষকের ভূমিকা কি?
উত্তর – ব্রাহ্মণ্য শিক্ষায় শিক্ষকের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র। তাঁকে “গুরু” বলা হতো। তিনি ধর্ম, নৈতিকতা ও আচারবিধির প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচিত হতেন। গুরুকুলে শিক্ষক নিজ আশ্রমে ছাত্রদের বসবাস করিয়ে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা দিতেন। তিনি শুধু পাঠদানই করতেন না, বরং শিষ্যের চরিত্র গঠনের দায়িত্বও পালন করতেন। ব্রাহ্মণ শিক্ষকগণ ছাত্রদের দীক্ষা দিতেন এবং মৌখিকভাবে বেদের মন্ত্র শেখাতেন। শিক্ষার্থীকে গুরুদক্ষিণা প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষা সমাপ্ত হতো। তিনি শুধুমাত্র উচ্চবর্ণের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সুযোগ দিতেন, যা এই ব্যবস্থার অন্যতম সীমাবদ্ধতা।
প্রশ্ন – ব্রাহ্মণ যুগের সময়কাল কত ছিল?
উত্তর – ব্রাহ্মণ যুগের আনুমানিক সময়কাল হল খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দ (BC 1000 – BC 600)
প্রশ্ন – চারটি বেদ ক্রমে কি কি?
উত্তর – চারটি বেদ হল যথাক্রমে – ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদ।
আরোও পড়ুন
- ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার 10টি বৈশিষ্ট্য | Features of Islamic Education System
- ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য | 10 Brahmanic Education System Features
- শিক্ষার অধিকার আইন 2009 | Right to Education Act | RTE Act 2009
- ১৮১৩ সালের সনদ আইনের শিক্ষামূলক গুরুত্ব | Educational Importance of the Charter Act of 1813
- রাষ্ট্রীয় উচ্চতর শিক্ষা অভিযান ভূমিকা | Rashtriya Uchchatar Shiksha Abhiyan (RUSA) 2013
- বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য | Buddhist Education System
ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য | 10 Brahmanic Education System Features সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।