ভারতে মধ্যযুগের শিক্ষা তথা ইসলামিক যুগের শিক্ষার বিকাশ মূলত মুসলমান শাসকদের দ্বারা গড়ে উঠেছিল। তাই মধ্যযুগের ভারতবর্ষে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা (Islamic Education System) ভারতবর্ষের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।
ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা (Islamic Education)
ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা এমন একটি জ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি যা মানুষের জাগতিক ও আত্মিক উভয় জীবনের জন্য দিকনির্দেশনা প্রদান করে। এই শিক্ষা ব্যবস্থা কেবল পাঠ্যক্রমে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি মানুষের নৈতিকতা (morality), Ethics, আত্মশুদ্ধি (self-purification), ঈশ্বরভীতি (Taqwa), ও সামাজিক দায়িত্ববোধ গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব দেয়।
ইসলামিক শিক্ষার সংজ্ঞায় বলা যায় – “Islamic education is the process of training and developing human beings who are physically and mentally capable of fulfilling their duties as the servants of Allah and His vicegerents on earth.” — Abdur Rahman Al-Nahlawi, Islamic Education
ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার ১০টি বৈশিষ্ট্য | Features of Islamic Education System
ইসলাম ধর্মগ্রন্থে শিক্ষাকে আবশ্যিক করতে হবে বলে স্বীকার করা হয়েছে। নবী (সা:) বলেছেন,
“জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম পুরুষ এবং মুসলিম নারীর জন্য ফরজ।” তাই কোরআনে শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের কল্যাণ এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। জ্ঞান মানুষের উন্নতি, দয়া ও ন্যায়ের পথপ্রদর্শক।
ইসলামী শিক্ষাকে বিশ্লেষণ করলে এর যে সমস্ত বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়, সেগুলি হল নিম্নলিখিত –
শিক্ষার লক্ষ্য
ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য গুলির মধ্যে অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল শিক্ষার লক্ষ্য। ইসলামিক শিক্ষার মূল লক্ষ্য – শিক্ষার্থীর নৈতিক এবং জাগতিক জীবনের মান উন্নয়ন। ইসলাম ধর্মের আদর্শ এবং পবিত্র কোরআনের নির্দেশ অনুযায়ী ধার্মিক ও চরিত্রবান মানুষ সৃষ্টি করাই হল এই শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য।
তাছাড়া ইসলামী শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য গুলি হল –
i) ধর্মীয় কর্তব্য পালন বা মোহাম্মদের নীতি অনুসরণ,
ii) সামাজিক ঐক্য বজায় রাখা বা সামাজিক শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা,
iii) শিক্ষার্থী সুপ্ত সম্ভাবনা গুলির পরিপূর্ণ বিকাশ প্রভৃতি।
শিক্ষার পাঠক্রম
ইসলামী শিক্ষার পাঠক্রম কে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যথা – প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রম এবং মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠক্রম।
i) প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রম – ইসলামিক শিক্ষায় প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রম হিসেবে মক্তবে গতানুগতিক পাঠক্রম অনুসরণ করা হতো। এখানে কুরআনের নির্বাচিত অংশ মুখস্ত করতে হতো. আবার শিক্ষার্থীদের লেখা, পড়া ও গণিত শিক্ষা দেওয়া হত।
ii) মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠক্রম – ইসলামিক শিক্ষা ব্যবস্থায় মাধ্যমিক শিক্ষা পাঠক্রম হিসেবে মাদ্রাসায় বিভিন্ন ধরনের পাঠক্রম অনুসরণ করা হতো। যেমন – ধর্মীয় শিক্ষার পাঠক্রম হিসাবে কোরআন, মোহাম্মদের বাণী প্রভৃতি। আবার ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার পাঠক্রম হিসেবে সাহিত্য, ব্যাকরণ, ইতিহাস, গণিত, কৃষিবিজ্ঞান, চিকিৎসা বিদ্যা প্রভৃতি পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
শিক্ষাদান পদ্ধতি
ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হিসেবে শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল অন্যতম। অর্থাৎ ইসলামিক যুগে শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল জটিল প্রকৃতির। প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্র মক্তবে শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল মৌখিক প্রকৃতির। এখানে সাধারণত কোন লিখিত বই অনুসরণ করা হতো না। শিক্ষার মাধ্যম ছিল পার্সি ভাষা।
আবার মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে মাদ্রাসাতেও শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল মৌখিক প্রকৃতির। শিক্ষকগণ বক্তৃতা পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। মুখস্ত ছিল শিখনের প্রধান পদ্ধতি।
শিক্ষক শিক্ষার্থী সম্পর্ক
যে কোনো শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম দিক হল শিক্ষক শিক্ষার্থীর সম্পর্ক। ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থা ও বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থার মতো ইসলামিক শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক ছিল পিতা পুত্রের ন্যায় গভীর ও মধুর। এখানে শিক্ষকের স্থান ছিল একেবারে সর্বোচ্চ স্থানে। শিক্ষকগণ ছিলেন ছাত্রদের শ্রদ্ধার পাত্র। আবার শিক্ষকদের সেবা করাই ছিল ছাত্রদের একমাত্র কর্তব্য। শিক্ষকদের স্নেহের ছায়ায় শিক্ষার্থীদের নৈতিক জীবন গড়ে উঠতো।
শিক্ষায় শৃঙ্খলা
ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য গুলির মধ্যে অন্যতম হল শিক্ষায় কঠোর শৃঙ্খলা। অর্থাৎ ইসলামিক শিক্ষা ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ছিল কঠোর প্রকৃতির। শিক্ষার্থীদের নৈতিক বিকাশ সাধনার জন্য মক্তবে কঠোর শৃঙ্খলা মেনে চলতে হতো। স্কুল পালানো বা অপরাধ প্রবণ ছাত্রদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হতো। আবার মক্তবের মতো মাদ্রাসাতেও কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলা রক্ষা করা হতো এবং অপরাধের জন্য যথাযথ শাস্তি দানের ব্যবস্থা ছিল।
উপসংহার (Conclusion)
সর্বোপরি বলা যায়, ইসলামিক শিক্ষা ব্যবস্থা হল এমন শিক্ষা পদ্ধতি, যা কেবল জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে নয়, বরং আধ্যাত্মিকতা, নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। ইসলামিক শিক্ষা সর্বদা শিক্ষা ও জ্ঞানের প্রতি উৎসাহিত করে, যেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক সম্মান ও ভালোবাসার ওপর ভিত্তি করে। এই শিক্ষাব্যবস্থা আত্মনির্ভরশীল, সহজে গ্রহণযোগ্য এবং জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ইসলামিক শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো জ্ঞানভিত্তিক জীবনযাপন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।
তথ্যসূত্র (References)
- Education in India-Past-Present-Future, Vol. I and II, J. P. Banerjee
- Landmarks in the History of Modern Indian Education, J. C. Aggarwal
- History of Education in India, Dr. R N Sharma and R K Sharma
- Report of Commissions – Radhakrishnan, Mudaliar, Kothari.
- National Policy on Education, 1986. Policy perspective.
- Features of Islamic Education System
- Internet Sources
প্রশ্ন – ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য কি কি?
উত্তর – ইসলামী শিক্ষার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল – মোহাম্মদের নীতি অনুসরণ বা ধর্মীয় নিয়ম-নীতি মেনে চলা, শিক্ষার্থীদের নৈতিক বিকাশ সাধন, নিয়ম শৃঙ্খলা বজায় রাখা প্রভৃতি।
প্রশ্ন – ইসলাম শিক্ষার মূল উৎস কী?
উত্তর – ইসলাম শিক্ষার মূল উৎস হল – কোরআন। অর্থাৎ কোরআনের বাণী অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের সর্বাঙ্গীন বিকাশ সাধন করা।
আরোও পড়ুন
- ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার 10টি বৈশিষ্ট্য | Features of Islamic Education System
- ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য | 10 Brahmanic Education System Features
- শিক্ষার অধিকার আইন 2009 | Right to Education Act | RTE Act 2009
- ১৮১৩ সালের সনদ আইনের শিক্ষামূলক গুরুত্ব | Educational Importance of the Charter Act of 1813
- রাষ্ট্রীয় উচ্চতর শিক্ষা অভিযান ভূমিকা | Rashtriya Uchchatar Shiksha Abhiyan (RUSA) 2013
- বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য | Buddhist Education System
ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য | Features of Islamic Education System সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।