বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য | Buddhist Education System

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে ভারতবর্ষে বিভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থার জন্ম হয়। এই সমস্ত শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে অন্যতম হল বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা (Buddhist Education System)।

প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে যে সমস্ত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল সেগুলি হল – ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থা, বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা এবং ইসলামিক শিক্ষা ব্যবস্থা। এই পর্বে বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা এবং বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করা হল।

বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা | Buddhist Education System

প্রাচীনকালে ব্রাহ্মণ্য শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন অসুবিধা এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মের জটিলতার বিরুদ্ধে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া রূপে বৌদ্ধ ধর্ম এবং বৌদ্ধ শিক্ষা দর্শনের জন্ম হয়।

বুদ্ধদের ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন এবং এর ফলে যে শিক্ষার জন্ম নেয় সেটি বৌদ্ধ শিক্ষা হিসেবে পরিচিত। বুদ্ধদেব তার শিক্ষা ব্যবস্থায় সকলের সমান অধিকারের সূচনা করেছিলেন। তাই বৌদ্ধ ধর্মের ও শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বজনীনতা থাকার ফলে এটি কেবলমাত্র ভারতবর্ষে নয়, ভারতবর্ষের বাইরেও বিস্তৃত হয়েছিল।

বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য

বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক প্রকৃতির ছিল। এই বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য যে সমস্ত পরিলক্ষিত হয়, সেগুলি হল নিম্নলিখিত –

1. শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য গুলির মধ্যে অন্যতম হল শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। বৌদ্ধ শিক্ষার চরম লক্ষ্য হল – নির্বাণ লাভ বা পরিনির্বান।

নির্বাণ শব্দের অর্থ হল – সকল প্রকার কামনা বা বাসনা থেকে মুক্তি লাভ। তাই দুঃখ জর্জরিত সমাজ জীবনের বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ হল বৌদ্ধ শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

আবার, বৌদ্ধ ধর্মে কামনা-বাসনার অবলুপ্তির মাধ্যমে মানব জীবনের মুক্তি সাধনকে শিক্ষার লক্ষ্য উদ্দেশ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বুদ্ধদেব দুঃখ জর্জরিত মানব জীবনের মুক্তি লাভের জন্য আটটি পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। যেগুলিকে অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলা হয়ে থাকে।

2. শিক্ষার পাঠক্রম

বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার পাঠক্রম ছিল বৈচিত্র ধর্মী এবং শিক্ষার লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে এটি রচিত হয়। এই শিক্ষার পাঠক্রমের মধ্যে ধর্ম শিক্ষা এবং ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার সমন্বয় ঘটেছিল। অর্থাৎ বৌদ্ধ শিক্ষার পাঠক্রম ছিল অধিক গণতান্ত্রিক প্রকৃতির।

মিলিন্দপঞ্চহ গ্রন্থ থেকে বৌদ্ধ শিক্ষার পাঠক্রম বিষয়ে উনিশ রকম বিষয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে অন্যতম হল – বেদ, ইতিহাস, পুরান, সাহিত্য, ছন্দ, কাব্য প্রভৃতি।

3. শিক্ষাদান পদ্ধতি

বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থার শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল আবৃতি মূলক। এই শিক্ষায় পাঠদানের মাধ্যম ছিল মাতৃভাষা। পরবর্তীকালে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে পালি ভাষা গুরুত্ব লাভ করে।

বৌদ্ধ শিক্ষায় শিক্ষাদান পদ্ধতি স্তর ভেদে পরিলক্ষিত হয়। যথা –

i) প্রথম পর্যায়ে শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল আবৃত্তিমূলক

ii) দ্বিতীয় পর্যায়ে আলোচনা মূলক এবং

iii) তৃতীয় পর্যায়ে শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল শিক্ষক শিক্ষণ মূলক

4. শিক্ষক শিক্ষার্থীর সম্পর্ক

বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য গুলির মধ্যে অন্যতম হল শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্পর্ক। এই শিক্ষায় শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল পিতা পুত্রের ন্যায় গভীর এবং আদর্শ স্থানীয়।

তাই বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থায় সংঘের কথা বা গুরুদেবের কথা শেষ কথা ছিল না। অনেক সময় শিক্ষার্থী বা শ্রমণদের কথা বা সুবিধা অসুবিধা দেখা হত।

5. শিক্ষায় শৃঙ্খলা

বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থায় শৃংখলা ছিল গণতান্ত্রিক প্রকৃতির। বৌদ্ধ শিক্ষায় বৌদ্ধ বিহার গুলিতে (যেখানে শিক্ষা দান করা হতো বা আধুনিক অর্থে বিদ্যালয়) নিয়মাবর্তিতা এবং পারস্পরিক সহযোগিতা ছিল।

তবে কিছু কঠোর নিয়ম কানুন বিহার জীবনের অঙ্গ ছিল। যেমন – ত্রিশরন মন্ত্র পাঠ, অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণ প্রভৃতি।

6. নারী শিক্ষা

বৌদ্ধ শিক্ষায় নারী শিক্ষা অবহেলিত হয়েছে। কারণ বৌদ্ধ ধর্মে জন্মগ্রহণকে দুঃখের কারণ বলা হয়। এক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়। এছাড়াও বিভিন্ন কারণে সংঘে নারীদের শিক্ষার অধিকার ছিল না।

তবে পালকমাতা মহাপ্রজাপতি গৌতমীর অনুরোধে বৌদ্ধদের নারীদের শিক্ষা করতে সম্মত হয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে কঠোর বিধি নিষেধের মাধ্যমে নারীদের শিক্ষা দেওয়া হতো। তাই নারী শিক্ষাবৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য গুলির মধ্যে অন্যতম।

7. আবাসিক প্রকৃতির

বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এটি আবাসিক প্রকৃতির শিক্ষা ব্যবস্থা। অর্থাৎ এখানে শিক্ষা গ্রহণের জন্য শিষ্যকে বা শিক্ষার্থীকে বৌদ্ধ সংঘে থাকতে হতো।

আরোও পোস্ট পড়ুন – Click Here Now

উপসংহার (Conclusion)

সর্বোপরি বলা যায়, সমকালীন শিক্ষা ব্যবস্থায় বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল অধিক গ্রহণযোগ্য এবং সর্বজনীন প্রকৃতির। কারণ বৌদ্ধ শিক্ষা গণতান্ত্রিক প্রকৃতির হওয়ার ফলে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় এই শিক্ষা ব্যবস্থা বিস্তার লাভ করেছিল এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

তথ্যসূত্র (References)

  • Education in India-Past-Present-Future, Vol. I and II, J. P. Banerjee
  • Landmarks in the History of Modern Indian Education, J. C. Aggarwal
  • History of Education in India, Dr. R N Sharma and R K Sharma
  • Report of Commissions – Radhakrishnan, Mudaliar, Kothari.
  • National Policy on Education, 1986. Policy perspective.
  • Internet Sources

প্রশ্ন – প্রবজ্যা কি

উত্তর – প্রবজ্যা হল বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থার শিক্ষা শুরুর অনুষ্ঠান। তাই বৌদ্ধ শিক্ষায় যে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বৌদ্ধ বিহার সংঘে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় এবং শিক্ষা শুরু হয় তাকে প্রবজ্যা বলে।

প্রশ্ন – উপসম্পদা কি

উত্তর – উপসম্পদা হল বৌদ্ধ শিক্ষার শিক্ষা শেষের অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা শেষে বা শিক্ষা জীবনের শেষে ভিক্ষু সংঘে প্রবেশের অনুষ্ঠান। অর্থাৎ উপসম্পদা লাভের মধ্য দিয়ে ভিক্ষু তার পূর্ব নাম ত্যাগ করে নতুন নাম নিতেন এবং সংঘ জীবন কাটানোর পূর্ণ অধিকার লাভ করত।

আরোও পড়ুন

Leave a Comment

close