Share on WhatsApp Share on Telegram

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দ্বন্দ্ব কি? ধারণা, কারণ ও ফলাফল | Oriental Occidental Controversy

Join Our Channels

১৮১৩ সালের সনদ আইনের শিক্ষাগত ব্যাখ্যা নিয়ে যে মতভেদ দেখা দেয় সেটি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দ্বন্দ্ব নামে পরিচিত। তাই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দ্বন্দ্ব ভারতীয় শিক্ষার (Oriental Occidental Controversy in Indian Education) ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দ্বন্দ্ব | Oriental Occidental Controversy

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দ্বন্দ্ব বলতে বোঝায় প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদীদের মধ্যে ১৮১৩ সালের সনদ আইনের 45 নম্বর ধারার ব্যাখ্যা নিয়ে দ্বন্দ্ব। অর্থাৎ ১৮১৩ সালের সনদ আইনের ৪৩ নম্বর ধারায় বলা হয় –

i) ব্রিটিশরা ভারতের সাহিত্যের পুনরুজ্জীবন ও উন্নতি বিধান এবং পন্ডিতদের উৎসাহ দান করার জন্য কোম্পানি অর্থ ব্যয় করবে,

ii) ভারতবর্ষে শিক্ষা বিস্তারের জন্য কোম্পানি বছরে এক লক্ষ টাকা ব্যয় করতে পারবে।

কিন্তু ৪৩ নম্বর ধারার এই দুটি সুপারিশ নিয়ে মতভেদ তৈরি হয়। বিশেষ করে এক লক্ষ টাকা পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার না প্রাচ্য শিক্ষার বিস্তারের জন্য খরচ করা হবে তা নিয়ে সংশয় ও মতভেদ দেখা দেয়। যার ফলে দেখা দেয় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দ্বন্দ্ব।

প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দ্বন্দ্বের কারণ | Definition of Oriental Occidental Controversy

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দ্বন্দ্ব (Oriental vs Occidental Debate) মূলত ভারতীয় শিক্ষানীতিকে ঘিরে একটি গভীর মতবিরোধ যা ইংরেজ শাসনকালে সনদ আইনের 43 নম্বর ধারার ব্যাখ্যা নিয়ে ১৮১৩ থেকে ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাদীদের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এর মূল কারণগুলো হল –

i) ভাষার মাধ্যম নিয়ে দ্বিধা (Conflict over Medium of Instruction)

প্রাচ্যপন্থীরা (Orientalists) সংস্কৃত, ফার্সি ও অন্যান্য দেশীয় ভাষায় শিক্ষা প্রদানের পক্ষপাতী ছিলেন। অন্যদিকে পাশ্চাত্যপন্থীরা (Anglicists) ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা চালু করার পক্ষপাতি ছিলেন।

ii) শিক্ষার লক্ষ্য নিয়ে মতভেদ (Disagreement on Educational Objectives)

প্রাচ্যপন্থীরা ভারতীয় সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষা করাকে শিক্ষার মূল লক্ষ্য মনে করতেন। আবার পাশ্চাত্যপন্থীরা বলতেন, ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে ভারতীয়দের “সুশিক্ষিত” করে গড়ে তুলতে হবে।

iii) কর্মসংস্থানের প্রয়োজন (Administrative and Employment Needs)

ইংরেজ সরকার ইংরেজি-শিক্ষিত কর্মচারী তৈরি করতে চেয়েছিল, প্রশাসনিক কাজে ব্যবহারের জন্য। তাই পাশ্চাত্যপন্থীরা বেশি সমর্থন পায়।

iv) অর্থায়নের প্রশ্ন (Utilization of Educational Funds)

১৮১৩ সালের চার্টার আইনের (Charter Act 1813 education) মাধ্যমে শিক্ষা খাতে ১ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়। এই অর্থ প্রাচ্য শিক্ষায় ব্যবহার করা হবে নাকি পাশ্চাত্য শিক্ষায়, তা নিয়েই মূল দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

v) লর্ড ম্যাকলের দৃষ্টিভঙ্গি (Impact of Macaulay’s Views)

লর্ড ম্যাকলে তার বিখ্যাত ১৮৩৫ সালের মিনিটে প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞানকে অবমূল্যায়ন করেন এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার জোরালো সপক্ষে যুক্তি দেন।

প্রাচ্যপন্থীদের যুক্তি | Arguments of Orientalists in Education Policy

প্রাচ্যবাদীদের নেতৃত্বে এইচ. টি. প্রিন্সেপ দাবি করেন সনদ আইনে সাহিত্য বলতে ভারতীয় প্রাচীন সাহিত্য ও শিক্ষিত ভারতীয় বলতে প্রাচ্যশিক্ষায় শিক্ষিত পন্ডিতদেরকে বোঝায়।

পাশ্চাত্যপন্থীদের যুক্তি | Arguments of Anglicists or Western Educators

পাশ্চাত্যবাদী C.E Trevelyan -এর নেতৃত্বে গঠিত দল প্রাচ্যবাদীদের বিপরীত মতামত পোষণ করেন এবং বলেন সনদ আইনের 45 নম্বর ধারায় সাহিত্য বলতে ইংরেজি সাহিত্যকে বোঝানো হয়েছে।

মেকলে মিনিট 1835 | Macaulay’s Minute and Anglicist Victory

প্রাচ্য পাশ্চাত্যের দ্বন্দ্বের সংকটময় পরিস্থিতিতে ১৮৩৪ সালে লর্ড মেকলে বড়লাটের পরিষদে আইন সদস্য রূপে এবং পরে GCPI (General Committee of Public Instruction)-এর সভাপতি পদনিযুক্ত হন। তিনি শিক্ষা সভায় সনদ আইনের 45 নম্বর ধারার ব্যাখ্যা নিয়ে দুই দলের মধ্যে তীব্র বিরোধিতা পরিলক্ষিত করেন এবং ১৮৩৫ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি আর বিখ্যাত মিনিট বা মন্তব্য লিপি পেশ করেন। ভারতীয় শিক্ষার ইতিহাসে এটি মেকলে মিনিট (‘Minute on Indian Education’) নামে পরিচিত।

দ্বন্দ্বের ফলাফল ও প্রভাব | Impact of Oriental Occidental Debate

এই বিতর্কের ফলে ভারতে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা চালু হয়। স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতি উপেক্ষিত হয়। ব্রিটিশ চাকরির যোগ্যতা নির্ধারণেও ইংরেজি ভাষা একটি প্রধান শর্ত হয়ে দাঁড়ায়।

উপসংহার (Conclusion)

সর্বোপরি বলা যায়, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ব্রিটিশ প্রশাসনের মধ্যে সংঘটিত দ্বন্দ্ব ছিল শুধুমাত্র ভাষা বা পাঠ্যবিষয়ক নয়, বরং এটি ছিল ভারতের শিক্ষার ভবিষ্যৎ নির্ধারণের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে ১৮৩৫ সালে লর্ড ম্যাকলে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার পক্ষে মত দেন, যার ফলে পাশ্চাত্য শিক্ষার সূচনা ঘটে। এর ফলে ভারতীয় সমাজে আধুনিক জ্ঞান, বিজ্ঞান এবং যুক্তিনির্ভর চিন্তাধারার প্রসার ঘটে। তবে একে একমুখী সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখা হয়। ফলে এতে প্রাচীন ভারতের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য উপেক্ষিত হয়। তবুও এই দ্বন্দ্ব শিক্ষা ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সূচনা করে।

তথ্যসূত্র (References)

  • Education in India-Past-Present-Future, Vol. I and II, J. P. Banerjee
  • Landmarks in the History of Modern Indian Education, J. C. Aggarwal
  • History of Education in India, Dr. R N Sharma and R K Sharma
  • Report of Commissions – Radhakrishnan, Mudaliar, Kothari.
  • National Policy on Education, 1986. Policy perspective.
  • Oriental Occidental Controversy in Indian Education
  • Internet Sources

প্রশ্ন – প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দ্বন্দ্বের অবসান ঘটান কে

উত্তর – প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দ্বন্দ্বের অবসান ঘটান লর্ড ম্যাকলে (Lord Thomas Babington Macaulay)
তিনি ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে তার বিখ্যাত ‘Minute on Indian Education’-এ পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থাকে সমর্থন করে মত প্রকাশ করেন। এতে তিনি স্পষ্টভাবে বলেন যে, ইংরেজি ভাষায় পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও সাহিত্য শিক্ষা দেওয়াই শ্রেয়। এরপর উইলিয়াম ব্যেন্টিঙ্ক ম্যাকলের মতানুযায়ী একটি সরকারি আদেশ জারি করেন, যার মাধ্যমে ইংরেজি মাধ্যমেই শিক্ষা প্রদান শুরু হয় এবং এই দ্বন্দ্বের প্রশাসনিকভাবে অবসান ঘটে। তবে পরবর্তীকালে এই ঘটনার পর জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের জন্ম নেয়।

প্রশ্ন – প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বাদী কাদের বলা হয়

উত্তর – ১৮১৩ সালের সনদ আইনের ব্যাখ্যা নিয়ে প্রাচ্য পাশ্চাত্য দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এখানে দুটি মতভেদ পরিলক্ষিত হয় যথা – প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী।
প্রাচ্যবাদী বলা হয় তাঁদের, যারা ভারতের প্রাচীন ভাষা ও সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী ছিলেন এবং সংস্কৃত, ফার্সি, আরবি ভাষায় শিক্ষা দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। প্রাচ্যবাদীদের নেতৃত্ব দেন এইচ টি প্রিন্সেপ, মনুস্টুয়ারি এলিফিনস্টোন, জোনাথন ডানকান, ওয়ারেন হেস্টিংস।
পাশ্চাত্যবাদী বলা হয় তাঁদের, যারা ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও সাহিত্যভিত্তিক আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে ছিলেন। এই পাশ্চাত্যবাদীদের নেতৃত্ব দেন লর্ড ম্যাকলে, চার্লস ট্রেভেলিয়ান, উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক।

আরোও পড়ুন

Rate this post

Mr. Debkumar – Author and Founder of Edutiips.com

Mr. Debkumar – Author and Founder of Edutiips.com

A dedicated educator with 10+ years of teaching experience, UGC NET Qualified, and holder of MA, B.Ed, and M.Phil in Education (University of Calcutta).

He has authored several books published by Aheli Publication, such as Communication Skills, Aspect of Democratic Citizenship, Sociological Foundation of Education, Computer Applications, Fundamentals of Education, Educational Organization and Planning, and Educational Research.

He is also an active contributor on Quora, where he shares expert insights on education, history, and social issues.

Leave a Comment

close