ভারতের স্বাধীনতার পর উচ্চশিক্ষার অগ্রগতির জন্য ভারত সরকার দ্বারা গঠিত রাধাকৃষ্ণন কমিশন গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় (Rural University) প্রতিষ্ঠা করার কথা বিশেষভাবে সুপারিশ করেন।
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভের পর উচ্চশিক্ষার উন্নতিকরণ ও প্রসারের জন্য ভারত সরকার ১৯৪৮ সালে ডক্টর সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের নেতৃত্বে রাধাকৃষ্ণন কমিশন বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। এই কমিশনের উদ্দেশ্য ছিল দেশের সর্বত্র উচ্চশিক্ষাকে পৌঁছে দেওয়া। দেশি-বিদেশি ১০ জন সদস্যকে নিয়ে এই কমিশন গঠিত হয়। ১৯৪৯ সালে কমিশন উচ্চ শিক্ষা সংক্রান্ত রিপোর্টটি পেশ করেন।
রাধাকৃষ্ণন কমিশন গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় | Radhakrishnan Commission Rural University
১৯৪১ সালের আদমশুমারি অনুসারে ভারতবর্ষের 85% মানুষ গ্রামে বসবাস করেন এবং তারা কৃষি কাজের সঙ্গে যুক্ত। স্বাধীনতা লাভের পর গ্রামীন উন্নতি দ্রুত করার জন্য যে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল সেটি গ্রামীন বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত।
১৯৪৮ সালে ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন বা রাধাকৃষ্ণন কমিশন গ্রামের নিম্ন স্তর থেকে ছেলেমেয়েরা যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তর পর্যন্ত শিক্ষা পেতে পারে সেই লক্ষ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের সুপারিশ করেন।
অর্থাৎ স্বাধীন ভারতের প্রথম উচ্চশিক্ষা কমিশন বা রাধাকৃষ্ণন কমিশন সর্বপ্রথম গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার উপস্থাপনা করেন।
গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য
রাধাকৃষ্ণন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী গঠিত গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য গুলি হবে নিম্নলিখিত –
i) গ্রাম বাংলা থেকে ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে তাদের জীবন গঠনের সহায়ক হবে।
ii) গ্রাম বাংলার মানুষের মধ্যে উচ্চশিক্ষার আলো পৌঁছাবে।
iii) উচ্চ শিক্ষার প্রসার ঘটানো এবং বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদানকরা।
iv) বিজ্ঞান, কারিগরি ও কৃষি শিক্ষার প্রসার ঘটানো।
v) গ্রাম বাংলার মানুষের মধ্যে বৃত্তি শিক্ষার মধ্য দিয়ে উপযুক্ত জীবিকা অর্জনে সহায়তা করা প্রভৃতি।
গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য
রাধাকৃষ্ণান কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য গুলি হল নিম্নলিখিত –
i) এই বিশ্ববিদ্যালয় গুলি হবে ডেনমার্কের জনতা কলেজ এর আদর্শ অনুসারে।
ii) বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে গান্ধীজীর বুনিয়াদি শিক্ষার সমন্বয়ের ঘটাতে হবে। অর্থাৎ এই শিক্ষা হবে সমন্বয়মূলক।
iii) সমসুযোগ দান। অর্থাৎ গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য হল উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সমসুযোগ দান করা।
iv) বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যতা। গ্রামীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে যে পাঠক্রম অন্তর্ভুক্ত হবে সেই পাঠক্রম বা বিষয় বস্তু ভাবে বৈচিত্র্যময়।
আরোও পোস্ট পড়ুন – Click Here Now |
গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে রাধাকৃষ্ণন কমিশনের সুপারিশ
উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে গ্রামীন বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে রাধাকৃষ্ণন কমিশনের বিভিন্ন সুপারিশ পরিলক্ষিত হয়। সেগুলি নিম্নে আলোচনা করা হল –
1. কর্মসূচি গ্রহণ
কমিশন বলেন নতুন গ্রামীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ভারতবাসীর বা গ্রামবাসীদের প্রয়োজনকে সামনে রেখে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। যাতে উচ্চ শিক্ষার থেকে কেউ বঞ্চিত না হয়।
2. শিক্ষার পাঠক্রম
গ্রামীন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম সংক্রান্ত সুপারিশ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পাঠক্রম ছাড়া যে কোনো শিক্ষা ব্যবস্থা অর্থহীন। তাই কমিশন বলেছেন – শহরের উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে চিকিৎসা শাস্ত্র, কারিগরি ইত্যাদি প্রাধান্য থাকবে এবং গ্রামীন উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে সমাজ উন্নয়ন, কৃষি ও পশুপালন, জনশিক্ষা প্রভৃতির প্রাধান্য থাকবে।
এছাড়া কমিশন বিভিন্ন বিষয়গত দিক পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছেন। যেমন – ভাষা বা সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগোল, সমাজবিদ্যা প্রভৃতি।
3. উপযুক্ত শিক্ষক
গ্রামীন বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগের কথা কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে। এই উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগের জন্য কমিশন কেন্দ্রীয় সরকারকে শিক্ষক নিয়োগ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সুপারিশ করেন।
4. আবাসিক বিদ্যালয় গঠন
কমিশন গ্রাম বাংলার ছেলেমেয়েদের সুবিধার জন্য আবাসিক বিদ্যালয় গঠনের সুপারিশ করেন। কমিশন আরো বলেন – গ্রামের উপযোগী পরিবেশে 30 থেকে 60 একর জমির উপর আবাসিক বিদ্যালয় গঠন করতে হবে। যেখানে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকবে। যাতে শিক্ষার্থীদের বিকাশ যথাযথ হয়।
5. ছাত্র ভর্তি
ছাত্র ভর্তি সংক্রান্ত রাধাকৃষ্ণন কমিশনের সুপারিশ ছিল – বিদ্যালয় শিক্ষার শেষে শিক্ষার্থীরা যাতে গ্রামীন কলেজে এবং পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয় করতে পারে তার যথাযথ ব্যবস্থা করা।
কমিশনের আরো সুপারিশ ছিল প্রতিটি কলেজে 300 জন ছাত্রছাত্রী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজগুলিতে 2500 জন শিক্ষার্থীর বেশি ভরতে নেয়া যাবে না।
উপসংহার (Conclusion)
সর্বোপরি বলা যায়, রাধাকৃষ্ণন কমিশন গ্রামীন বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা শিক্ষাক্ষেত্রে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিক। এর মাধ্যমে গ্রামীন উন্নতি অনেকটাই সহজ সাধ্য হয়েছিল। তাই গ্রামীন বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা এবং কৃষি শিক্ষার উন্নতির পাশাপাশি বিজ্ঞান শিক্ষাকে গ্রহণযোগ্য করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কমিশনের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য।
তথ্যসূত্র (References)
- Education in India-Past-Present-Future, Vol. I and II, J. P. Banerjee
- Landmarks in the History of Modern Indian Education, J. C. Aggarwal
- History of Education in India, Dr. R N Sharma and R K Sharma
- Report of Commissions – Radhakrishnan, Mudaliar, Kothari.
- National Policy on Education, 1986. Policy perspective.
- Internet Sources
প্রশ্ন – কোন কমিশন গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাটি সুপারিশ করে
উত্তর – স্বাধীন ভারতে উচ্চশিক্ষার জন্য ১৮৪৮-৪৯ সালে গঠিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন বা রাধাকৃষ্ণন কমিশন সর্বপ্রথম গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় ধারণাটি সুপারিশ করে।
প্রশ্ন – গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় পরিকল্পনার মাধ্যমিক স্তর কত বছরের
উত্তর – রাধাকৃষ্ণন কমিশনের গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় পরিকল্পনার মাধ্যমিক স্তর ৩-৪ বছরের। অর্থাৎ ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত।
প্রশ্ন – গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় পরিকল্পনার কয়টি স্তরের কথা বলা হয়েছে
উত্তর – রাধাকৃষ্ণন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ীগ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় পরিকল্পনার মোট চারটি স্তরের কথা বলা হয়েছে।
প্রশ্ন – কোন বিদেশী শিক্ষাবিদ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন
উত্তর – স্বাধীনতার পর গঠিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশনের বা রাধাকৃষ্ণন কমিশনের মোট বিদেশি সদস্য ছিলেন তিনজন। তারা হলেন – i) ড. জেমস্. এফ ডাফ, ii) ড. ই. মরগ্যান ও iii) ড. টিগার্ট
আরোও পড়ুন
- শিক্ষার অধিকার আইন 2009| Right to Education Act | RTE Act 2009
- শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য | Individual and Social Aims of Education
- শিক্ষা শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ কি | Etymological Meaning of Education
- শিক্ষার গণতান্ত্রিক লক্ষ্য বলতে কী বোঝো | Democratic Aim of Education
- মন্তেসরি শিক্ষা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য | Characteristics of Montessori Education System
- শিক্ষায় মূল্যবোধের গুরুত্ব | Importance of Values in Education
1 thought on “রাধাকৃষ্ণন কমিশন গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় | Radhakrishnan Commission Rural University”