জীবন বিকাশের বিভিন্ন স্তর গুলি আলোচনা কর | 4 Stages of Human Development

প্রাকৃতিক নিয়মে মানব জীবন বিকাশের বিভিন্ন স্তর গুলি আবদ্ধ। শিশুর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবন বিকাশের বিভিন্ন স্তর গুলি (Stages of Human Development) পরিলক্ষিত হয়। যেগুলি শিশুকে সমাজ উপযোগী করে গড়ে তুলতে সহায়তা করে।

পৃথিবীর বা প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ জীব হলো মানুষ। কারণ মানুষ অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় বুদ্ধিমান। ফলে মানুষ নিজের মতো করে চারিপাশের জগতকে সাজিয়ে তুলতে সক্ষম। শিশুর জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত জীবন বিকাশের প্রতিটি স্তর একটি জটিল ও আশ্চর্য বিষয়। কেননা প্রতিটি স্তরে বিভিন্ন বিকাশগত বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। প্রতিটি স্তরের সুষ্ঠু বিকাশের মধ্য দিয়ে শিশু সমাজ উপযোগী হয়ে গঠিত হয়। এখানে মানুষের জীবন বিকাশের বিভিন্ন স্তর গুলি বিভিন্ন মনোবিদগণ যে সমস্ত দিক থেকে উল্লেখ করেছেন তা আলোচনা করা হলো।

জীবন বিকাশের বিভিন্ন স্তর গুলি আলোচনা কর (Stages of Human Development)

অন্যান্য প্রাণীর মতো মানুষের জীবন চক্র একটি জটিল পর্যায়ের মধ্য দিয়ে পরিবাহিত হয়। মানুষের জীবন বিকাশের প্রতিটি স্তর জটিল ও বৈচিত্র ধর্মী। প্রতিটি স্তরের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন মনোবিদ বিভিন্ন দিক থেকে জীবন বিকাশের স্তরকে বর্ণনা করেছেন।

মানব জীবন বিকাশের স্তর

বিশিষ্ট মনোবিদ এরিকসন মানব জীবন বিকাশের ৮ টি স্তরের কথা বলেছেন, আবার পিকুনাস ১০ টি স্তরের কথা বলেছেন। তাছাড়া বিশিষ্ট মনোবিদ পিকুনাস জীবন বিকাশের ৪ টি স্তরের কথা বলেছেন।

বিভিন্ন মনোবিদদের দেওয়া মানব জীবন বিকাশের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ চারটি স্তর বর্তমান। জীবন বিকাশের বিভিন্ন স্তর গুলির মধ্যে মানব জীবন বিকাশের চারটি স্তর এখানে আলোচনা করা হলো।

1. শৈশবকাল (জন্ম থেকে 5 বছর)

মানব জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ও বৈচিত্র ধর্মী স্তর হল শৈশবকাল। এই স্তরের সময়সীমা শিশুর জন্ম থেকে ৫ বছর। তবে অনেক মনোবিদ এই স্তরের সময়সীমা হিসেবে জন্ম থেকে দুবছরও বলে থাকেন। এই স্তরের বিভিন্ন বিকাশ পরিলক্ষিত হয়, যথা – দৈহিক বিকাশ, মানসিক বিকাশ ও সামাজিক বিকাশ।

শিশির মধ্যে বিভিন্ন চাহিদা পরিলক্ষিত হয়। যথা – খাদ্যের চাহিদা, ঘুমের চাহিদা, নিরাপত্তার চাহিদা প্রভৃতি।

শৈশবকালের দৈহিক বিকাশ

শৈশব কালের দৈহিক বিকাশ বা শারীরিক বিকাশ একটি প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিশুর দৈহিক বিকাশের যে সমস্ত বৈশিষ্ট্য এই স্তরে পরিলক্ষিত হয়, সেগুলি হল –

  • ওজন গত পরিবর্তন। জন্মের সময় শিশুর স্বাভাবিক শিশুর গড় ওজন তিন থেকে সাড়ে তিন কেজি পর্যন্ত হয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে শিশুর ওজন বৃদ্ধি পায়। যেমন – ৫ থেকে ৬ মাস বয়সে ওজন দ্বিগুণ হয় ও এক বছর বয়সে ওজন তিনগুণ বেড়ে যায়।
  • উচ্চতা গত পরিবর্তন। এটি নির্ভর করে বংশগতির উপর। তবে তিন বছরে শিশুর গড় উচ্চতা হয় তিন ফুটের উপর।
  • মাংসপেশির বৃদ্ধি ঘটে থাকে। এটি দুই ধরনের হয়ে থাকে। যথা – সেফালোকডাল ধারা (Cephalocaudal Tendency) – এই ধরনের বৃদ্ধি মাথা থেকে পায়ের আঙ্গুল পর্যন্ত হয়। এবং প্রক্সিমোডিস্টাল ধারা (Proximodistal Tendency) – এই ধরনের বৃদ্ধি কেন্দ্র থেকে পরিধির দিকে হয়ে থাকে। অর্থাৎ দেহের মধ্যবর্তী স্থান থেকে মাংসপেশীর বিকাশ শরীরের শেষ পর্যায়ে পর্যন্ত হয়ে থাকে।

শৈশবকালের মানসিক বিকাশ

শৈশবকালের মানসিক বিকাশের মধ্যে শিশুর মধ্যে যে সমস্ত বিকাশ পরিলক্ষিত হয় তার মধ্যে অন্যতম হল – ভাষার বিকাশ এবং বৌদ্ধিক বিকাশ।

ভাষার বিকাশ – শিশুর জন্মের পর দু মাসের কাছাকাছি বয়স থেকে বিভিন্ন ধরনের শব্দ উচ্চারণ করে। একে Cooing বলা হয়ে থাকে। আবার চার মাস বয়সের কাছাকাছি শিশুর শব্দের উচ্চারণের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। একে Babbling বলে।

বৌদ্ধিক বিকাশ – শৈশব কালে দু বছর বয়সের কাছাকাছি শিশুর বৌদ্ধিক বিকাশ সম্পন্ন হয়। এই স্তরে শিশু বিভিন্ন বস্তুর প্রতি আকৃষ্ট হয় ও বস্তুর রং আকার আয়তন সম্পর্কে কিছুটা ধারণা গঠন হয়। স্মৃতিশক্তি প্রখর হয় ও তার ব্যবহার করতে পারে।

2. বাল্যকাল (5 থেকে 12 বছর)

শৈশবের পরবর্তী স্তর হল বাল্যকাল। জীবন বিকাশের ক্ষেত্রে বাল্যকাল একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর। এই স্তরের সময়সীমা পাঁচ থেকে বারো বছর পর্যন্ত। বাল্যকালকে আবার দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন- প্রারম্ভিক বাল্য (৫ থেকে ৭ বছর) ও উত্তর বাল্যকাল (৭ থেকে ১২ বছর বয়স)।

বাল্যকালের শিশুদের মধ্যে যে সমস্ত চাহিদা দেখা যায়, সেগুলি হল – খাদ্যের চাহিদা, ঘুমের চাহিদা, নিরাপত্তার চাহিদা, দায়িত্ব পালনের চাহিদা, অনুসন্ধানের চাহিদা প্রভৃতি।

বাল্যকালের শিশুদের মধ্যে বিকাশগত বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন – শারীরিক বিকাশ, ভাষাগত বিকাশ, মানসিক বিকাশ, সামাজিক বিকাশ ও প্রাক্ষোভিক বিকাশ।

3. কৈশোর কাল (12 থেকে 18 বছর)

মানব জীবন বিকাশের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং সংকটজনক স্তর হল কৈশোর কাল বা বয়ঃসন্ধিকাল। বয়সন্ধিকালে সূচনা হয় ১২ বছর বয়স থেকে এবং এটির সময়সীমা ১৮ বছর পর্যন্ত। ছেলে এবং মেয়েদের মধ্যে বয়ঃসন্ধি সূচনা হয় বিভিন্ন বয়সে। ছেলেদের ক্ষেত্রে ১৩-১৪ বছর বয়সে ও মেয়েদের ক্ষেত্রে ১২-১৩ বছর বয়সে এটি পরিলক্ষিত হয়।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও মনোবিদ স্ট্যানলি হল্‌ (Stanley Hall) কৈশোর কালকে বা বয়ঃসন্ধি কালকে ‘ঝড়-ঝঞ্ঝার’ বা ‘দুঃখকষ্টের কাল’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

বিশিষ্ট মনোবিদ Baron বলেছেন – যৌবন আরম্ভের সময় থেকে শুরু করে একজন ব্যক্তি যখন বয়স্কদের ভূমিকা ও কর্তব্যবস্থ থেকে ততদিন পর্যন্ত সময়কাল হল কৈশোর কাল।

আবার বিশিষ্ট মনোবিদ T. Jersild বলেছেন – কৈশোরকাল বা বয়ঃসন্ধিকাল হল এমন একটি বয়স যেখানে ছেলেমেয়েরা দৈহিক, মানসিক, প্রাক্ষোভিক ও সামাজিক দিক থেকে প্রাপ্তবয়স্ক লাভ করে।

কৈশোরকালে শিশুদের মধ্যে বিভিন্ন চাহিদা তৈরি হয়। যেগুলি অন্যান্য বয়সের থেকে পার্থক্য দেখা যায়, যেমন – স্বাধীনতার চাহিদা, আত্মপ্রকাশের চাহিদা, দুঃসাহসিক কাজকর্মের চাহিদা, সৃজনশীলতার চাহিদা, নিরাপত্তা চাহিদা, নৈতিক চাহিদা, যৌন চাহিদা প্রভৃতি।

জীবন বিকাশের অন্যান্য স্তরের মতো কৈশোর কালের বিভিন্ন বিকাশগত বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়, যথা – দৈহিক বিকাশ বা দৈহিক পরিবর্তন, মানসিক বিকাশ, সামাজিক বিকাশ প্রভৃতি।

4. প্রাপ্তবয়স্ক কাল (18 থেকে আমৃত্যু)

জীবন বিকাশের বিভিন্ন স্তর গুলির মধ্যে অন্যতম এবং গুরুত্বপূর্ণ স্তর হল প্রাপ্তবয়স্ক কাল। যেটি আঠারো বছরের পর থেকে শুরু হয় এবং আমৃত্যু পর্যন্ত চলতে থাকে। অন্যান্য স্তরে যেমন দৈহিক বিকাশ পরিলক্ষিত হয় এই স্তরে কিন্তু বৃদ্ধি ব্যতীত অন্যান্য বিকাশ প্রায় স্থিতিশীল হয়ে যায়।

এই স্তরের অন্যতম চাহিদাগুলো হল – ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের চাহিদা, স্বাবলম্বী হওয়ার চাহিদা, যৌন চাহিদা, ভালোবাসার চাহিদা, নিরাপত্তার চাহিদা, সৃজনশীলতার চাহিদা প্রভৃতি।

জীবন বিকাশের বিভিন্ন স্তর গুলির মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক স্তরের যে-সমস্ত বিকাশগত বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়, সেগুলি হল – শারীরিক বিকাশ বা দৈহিক পরিবর্তন, সামাজিক বিকাশ, মানসিক বিকাশ, আধ্যাত্মিক বিকাশ প্রভৃতি।

আরোও পোস্ট পড়ুন – Click Here Now

উপসংহার (Conclusion)

পরিশেষে বলা যায়, জীবন বিকাশের বিভিন্ন স্তর গুলি প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কোন একটি স্তরের বিকাশ ব্যাহত হলে সেই প্রভাব জীবন বিকাশের বিভিন্ন স্তর গুলিতে পরিলক্ষিত হয়। তাই শিশুর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবন বিকাশের বিভিন্ন স্তর গুলি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

তথ্যসূত্র (Reference)

  • A. Woolfolk – Educational Psychology – Pearson Education
  • J. W. Santrock – Educational Psychology – Mc Gray Hill
  • J. C. Aggarwal – Essentials of Educational Psychology – Vikas publisher
  • S. K. Mangal – Essentials of Educational Psychology – PHI Ltd.
  • S. K. Mangal – Advanced Educational Psychology – PHI Ltd
  • S. S. Chauhan – Advanced Educational Psychology – Vikas publisher
  • E. B. Hurlock – Child Development – Anmol Publication Pvt. Ltd
  • L. E. Berk – Child Development – PHI Ltd
  • Internet Sources

প্রশ্ন – মনোবিদ পিকুনাস জীবন বিকাশের স্তরকে কয়টি

উত্তর – মনোবিদ পিকুনাস জীবন বিকাশের স্তরকে দশটি ভাগে ভাগ করেছেন। সেগুলি হল –
1. প্রাক জন্মস্তর (গর্ভসঞ্চার থেকে জন্মের আগে পর্যন্ত),
2. সদ্যজাত স্তর (জন্ম থেকে চার সপ্তাহ পর্যন্ত),
3. প্রারম্ভিক শৈশব স্তর (এক মাস থেকে দেড় বছর পর্যন্ত),
4. উত্তর শৈশব স্তর (দেড় বছর থেকে আড়াই বছর পর্যন্ত),
5. প্রারম্ভিক বাল্য স্তর (আড়াই থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত),
6. মধ্য বাল্য স্তর (৫ বছর থেকে 9 বছর পর্যন্ত),
7. উত্তর বাল্য স্তর (৯ বছর থেকে ১২ বছর পর্যন্ত),
8. যৌবন স্তর (১২ বছর থেকে ২১ বছর পর্যন্ত),
9. প্রাপ্তবয়স্ক স্তর (২১ বছর থেকে ৭০ বছর পর্যন্ত),
10. বার্ধক্য স্তর (৭০ বছর থেকে আমৃত্যু)

প্রশ্ন – এরিকসনের জীবন বিকাশের স্তর কয়টি

উত্তর – এরিকসনের জীবন বিকাশের স্তর হল ৮ টি।

প্রশ্ন – আর্নেস্ট জোনস জীবন বিকাশের স্তর

উত্তর – আর্নেস্ট জোনস জীবন বিকাশের স্তর হল চারটি। সেগুলি হল –
1. শৈশবকাল (জন্ম থেকে ৫ বছর পর্যন্ত),
2. বাল্যকাল (পাঁচ বছর থেকে ১২ বছর পর্যন্ত),
3. কৈশোর কাল (১২ বছর থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত) এবং
4. প্রাপ্তবয়স্ক কাল (১৮ বছর থেকে আমৃত্যু পর্যন্ত)

আরোও পড়ুন

1 thought on “জীবন বিকাশের বিভিন্ন স্তর গুলি আলোচনা কর | 4 Stages of Human Development”

  1. Thanks for describing different stages of human life.It seems to be more to be more complicated. It could be simpler for general readers.

    Reply

Leave a Comment

close