কোহলবার্গের নৈতিক বিকাশ তত্ত্ব | Kohlberg’s Theory of Moral Development

শিশুর বিকাশের ক্ষেত্রে অন্যতম দিক হল নৈতিক বিকাশ। শিশুর মধ্যে নৈতিক বিকাশ কিভাবে সম্পন্ন হয় তা বহুলবার্গের নৈতিক বিকাশ তত্ত্ব (Kohlberg’s Theory of Moral Development) -এর মধ্যে বিস্তারিতভাবে পরিলক্ষিত হয়।

সাধারণভাবে ভালো মন্দ বিচার করা, অপরের সাহায্য করা বা একটি পরিস্থিতিতে কি করা উচিত তা বিচার বিবেচনা করার ক্ষমতা নৈতিকতা হিসেবে গণ্য করা হয়। এটি প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে কম বেশি পরিলক্ষিত হয়। নৈতিক বিকাশ কিভাবে সংঘটিত হয় তা নিয়ে কোহলবার্গ দীর্ঘ গবেষণা করেন এবং তার তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে নৈতিক বিকাশ সম্পর্কিত কোহলবার্গের তত্ত্বটি ডায়াগ্রাম সহ আলোচনা করা হলো।

Table of Contents

নৈতিক বিকাশ কাকে বলে

ব্যুৎপত্তিগতভাবে Moral (নৈতিকতা) শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ Manaers থেকে, যার অর্থ হল প্রথা বা নীতিবোধ। অর্থাৎ নীতিবোধ বা নৈতিকতা বলতে ন্যায়বিচার বা ন্যায়পরায়নাতাকে বোঝানো হয়ে থাকে।

কোহলবার্গের নৈতিক বিকাশ কাকে বলে

পিঁয়াজে নৈতিক বিকাশের বিভিন্ন স্তরের কথা বলেন। পরবর্তীকালে তাঁর শিষ্য কোহলবার্গ সেই তত্ত্বকে আরো বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা দেন যা কোহলবার্গের নৈতিক বিকাশের তত্ত্ব নামে পরিচিত।

কোহলবার্গের মতে – নৈতিক বিকাশ ব্যক্তির জন্মগত নয়। ব্যক্তির বাহ্যিক আচরণ তা নৈতিক বিকাশের পরিচায়ক। তাই তিনি নীতিবোধ বলতে ন্যায়বিচার বা ন্যায়পরায়ণতাকে বুঝিয়েছেন।

কোহলবার্গের নৈতিক বিকাশের স্তর | Kohlberg’s Theory of Moral Development

লরেন্স কোহলবার্গ (1927-1987) আমেরিকা শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় Ph.D ডিগ্রির জন্য ধারাবাহিক গবেষণা করেন এবং তিনি শিশুদের নৈতিক বিকাশের উপর গবেষণা পত্র পেশ করেন।

কোহলবার্গ সহযোগীগণ মনে করেন, নীতিবোধ বিষয়ক চিন্তন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের শিশু বা ব্যক্তির সক্রিয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই তিনি নৈতিক বিকাশ সম্পর্কিত গবেষণার জন্য তথ্যসংগ্রহে শিশুদের সম্মুখে নৈতিক দ্বন্দ্ব সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় উপস্থাপন করে তিনি জিজ্ঞাসা করতেন – পরিস্থিতিতে তারা কি করবে এবং কেন করবে? উদাহরণস্বরূপ বলা যায় –

i) চুরি করা অন্যায় জানা সত্বেও কেউ যদি অপরের বাঁচানোর জন্য চুরি করে তাহলে সে কি অন্যায় করবে?

কোহলবার্গের নৈতিক বিকাশের স্তর গুলিকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়ে থাকে। সেগুলি এখানে ছকের মাধ্যমে দেখানো হল –

Kohlberg’s Theory of Moral Development Diagram

1. প্রাক্‌-সংস্কার নীতিবোধের স্তর (4-10 বছর)

কোহলবার্গের মতে এই পর্যায়ে শিশুর নৈতিক আচরণ বা নীতিবোধ স্বার্থ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এটি প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ স্তর এই স্তরের বয়সসীমা হল 4 থেকে 10 বছর পর্যন্ত।

শাস্তি এড়ানো ও ব্যক্তিগত সন্তুষ্টির জন্য শিশুরা নৈতিক আচরণ করে থাকে। তাই এই পর্যায়ে জ্ঞানমূলক বিকাশ এমন পর্যায়ে পৌঁছায় না যার দ্বারা শিশু নৈতিক ভালো-মন্দ বিচার করতে পারে।

প্রাক্‌-সংস্কার নীতিবোধের স্তরকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা –

i) সামঞ্জস্যহীন নীতিবোধ

এই স্তরে শিশু তার কাজের ভালোমন্দ বিচার করে শাস্তি ও পুরস্কারের দ্বারা। অর্থাৎ শিশুর নৈতিক বিকাশ শাস্তি ও পুরস্কার এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।

ii) ব্যক্তিকেন্দ্রিক নীতিবোধ

এই স্তরে শিশু স্বার্থ রক্ষার জন্য বিভিন্ন নিয়ম মেনে চলে। কোহলবার্গ এই স্তরকে বদলের নীতির কথা বলেছেন। যেমন – তুমি আমার বই ছিঁড়েছো, আমি তোমার পুতুল ভাঙবো।

2. সংস্কার প্রভাবিত নীতিবোধ (10-13 বছর)

নৈতিক বিকাশের দ্বিতীয় অন্যতম স্তর হল সংস্কার প্রভাবিত নীতিবোধের স্তর। এই স্তরের বয়সসীমা হল 10 থেকে 13 বছর পর্যন্ত।

এই স্তরে শিশুরা ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের নিকট থেকে সমর্থন প্রত্যাশা করে থাকে। তারা শুধু সমাজের নীতি নিয়ম মেনে চলে তাই নয় সমাজ নির্ধারিত আচরণের মানকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করে।

সংস্কার প্রভাবিত নীতিবোধের দুটি স্তর পরিলক্ষিত হয়, যথা –

i) প্রত্যাশামূলক নীতিবোধ

এই স্তরে শিশুরা অপরের বা সমাজের অন্য কোনো ব্যক্তির সমর্থন আশা করে। যেমন – ভালো ছেলে বা ভালো মেয়ে ইত্যাদি। এখানে শিশুর নৈতিক আচরণ গোষ্ঠীর প্রত্যাশা দ্বারা নির্ধারিত হয়।

ii) সমাজ নিয়ন্ত্রিত নীতিবোধ

এই বয়সের শিশুরা সমাজ নিয়ন্ত্রিত নীতিবর দ্বারা প্রভাবিত হয়। অর্থাৎ এখানে সামাজিক নিয়ম-নীতি প্রাধান্য পায়। আইন কানুন, সমাজ, ধর্ম প্রকৃতি নৈতিকতা আচরণকে প্রভাবিত করে। তাই এখানে শিশুরা আইন সংগত সমাজ সমর্থিত আচরণ কর্তব্য বলে মনে করে।

3. সংস্কারমুক্ত নীতিবোধ (13 বছর ও তার অধিক)

কোহলবার্গের নৈতিক বিকাশ তত্ত্বের তৃতীয় স্তর হল সংস্কারমুক্ত নীতিবোধ। এই স্তরের বয়সসীমা 13 বছর ও তার অধিক।

কোহলবার্গ বলেন এই স্তরে শিশুর মধ্যে প্রকৃত নৈতিকতা দেখা যায়। নীতিবোধ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে শিশু অন্যের উপর নির্ভরশীল নয়। অর্থাৎ শিশুরা স্বাধীনভাবে ভালো-মন্দ বিচার করতে শেখে।

সংস্কারমুক্ত নীতিবোধের স্তরকে আবার দুটি ভাগে ভাগ করা যায়, যথা –

i) সামাজিক চুক্তি নিয়ন্ত্রিত নীতিবোধ

এখানে শিশুর আচরণ সমাজের প্রতি তার দায় দায়িত্ব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। অর্থাৎ নীতি সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যক্তি যুক্তি তর্কের আশ্রয় নেয়।

ii) সার্বজনীন নীতিবোধ

এই স্তরে নৈতিক আচরণের ক্ষেত্রে শিশুর বিবেক খুব বেশি সক্রিয় হয়। অর্থাৎ এই স্তরে নীতিবোধ কোন আইন বা সামাজিক চুক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। এখানে ব্যক্তির আচরণ সার্বজনীন নীতিবোধের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

আরোও পোস্ট পড়ুন – Click Here Now

কোহলবার্গের নৈতিক বিকাশ তত্ত্বের শিক্ষাগত তাৎপর্য

কোহলবার্গের নৈতিক বিকাশের তত্ত্ব শিক্ষাগত দিক থেকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। অর্থাৎ কোহলবার্গের মতানুসারে, শিশুর নৈতিক বিকাশ নির্দিষ্টধাপ অতিক্রম করে আছে এবং পূর্ববর্তী ধাপ বাদ দিয়ে কখনো সে উচ্চস্তরে পৌঁছাতে পারেনা।

তাই বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে শিশু এক স্তর থেকে অন্য স্তরে পদার্পণ করে ও তার নৈতিক বিকাশ সংঘটিত হয়। অর্থাৎ শিক্ষার প্রতিটি স্তরের মতো ধাপে ধাপে শিশুর মধ্যে নৈতিক বিকাশ পরিপক্ক লাভ করে। সেই জন্য নৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে শিক্ষার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। যেমন –

শ্রেণিকক্ষে বিভিন্ন সংস্কৃতির শিক্ষার্থীরা থাকে, সেক্ষেত্রে ব্যক্তি বৈষম্য থাকাটাও স্বাভাবিক। তাই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সামনে নৈতিক দ্বন্দ্ব উপস্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক নৈতিক বিকাশ বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হবে।

তাছাড়া শিক্ষক শিক্ষিকেরা প্রত্যক্ষ আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন না। বরং শিক্ষার্থীদের আলোচনায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে নৈতিক বিকাশ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিজস্ব মতামত প্রদান করতে পারে। এর ফলে শিশুদের মধ্যে বিভিন্ন নৈতিকতার বিকাশ সাধন হবে।

উপসংহার (Conclusion)

পরিশেষে বলা যায়, কোহলবার্গের নৈতিক বিকাশের তত্ত্বের মাধ্যমে শিশুর নৈতিক বিকাশ কিভাবে সংঘটিত হয় তা সহজে জানা যায়।

তাছাড়া ১৯৮৪ সালে কোহলবার্গ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বলেন – নীতিবোধের বিকাশের ক্ষেত্রে ব্যক্তির দুটি দিক প্রভাবিত হয়, সে দুটি হল –

A টাইপ – এই সকল ব্যক্তিরা নিজে থেকে নৈতিক আচরণ করে না।

B টাইপ – এই সকল ব্যক্তিরা নিজে থেকে নৈতিক আচরণ করে থাকে। অর্থাৎ নৈতিক আচরণের মধ্যে ব্যক্তির স্বতঃস্ফূর্ততা দেখা যায়।

তথ্যসূত্র (Reference)

  • A. Woolfolk – Educational Psychology – Pearson Education
  • J. W. Santrock – Educational Psychology – Mc Gray Hill
  • J. C. Aggarwal – Essentials of Educational Psychology – Vikas publisher
  • S. K. Mangal – Essentials of Educational Psychology – PHI Ltd.
  • S. K. Mangal – Advanced Educational Psychology – PHI Ltd
  • S. S. Chauhan – Advanced Educational Psychology – Vikas publisher
  • E. B. Hurlock – Child Development – Anmol Publication Pvt. Ltd
  • L. E. Berk – Child Development – PHI Ltd
  • Internet Sources

প্রশ্ন – নৈতিক বিকাশ তত্ত্বের প্রবক্তা কে?

উত্তর – নৈতিক বিকাশ তত্ত্বের প্রবক্তা হলেন আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক লরেন্স কোহলবার্গ।

প্রশ্ন – নৈতিক বিকাশের তত্ত্ব কে প্রথম দেন?

উত্তর – নৈতিক বিকাশ তত্ত্ব প্রথম দেন লরেন্স কোহলবার্গ।

প্রশ্ন – নৈতিক বিকাশের প্রবর্তক কে?

উত্তর – নৈতিক বিকাশের প্রবর্তক হলেন আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট গবেষক লরেন্স কোহলবার্গ।

প্রশ্ন – নৈতিক বিকাশের দ্বিতীয় পর্যায় কোনটি?

উত্তর – নৈতিক বিকাশের দ্বিতীয় পর্যায়টি হল সংস্কার প্রভাবিত নীতিবোধ। এই পর্যায়ের আবার দুটি স্তর রয়েছে। যথা – প্রত্যাশামূলক নীতিবোধ এবং সমাজ নিয়ন্ত্রিত নীতিবোধ।

প্রশ্ন – নৈতিক বিকাশের সার্বজনীন নীতি কি কি?

উত্তর – নৈতিক বিকাশের সার্বজনীন নীতি হল – এখানে শিশুর নৈতিক আচরণের ক্ষেত্রে বিবেক খুব সক্রিয় হয়, কোনো আইন বা সামাজিক চুক্তির দ্বারা নয়।

প্রশ্ন – কোহলবার্গের নৈতিক বিকাশের স্তর কয়টি

উত্তর – কোহলবার্গের নৈতিক বিকাশের স্তর হল তিনটি। সেগুলি হল –
i) প্রাক সংস্কার নীতিবোধ
ii) সংস্কারপ্রভাবিত নীতিবোধ এবং
iii) সংস্কারমুক্ত নীতিবোধ

আরোও পড়ুন

Leave a Comment

close