শিক্ষা ক্ষেত্রে বিভিন্ন শিক্ষাবিদদের মধ্যে যার অবদান উল্লেখযোগ্য তিনি হলেন সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন। জাতির শিক্ষক সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন শিক্ষা দর্শন (Contribution of Radhakrishnan in Education) শিক্ষাকে বিশেষভাবে আলোকিত করে তুলেছিল।
সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন শিক্ষা দর্শন ও শিক্ষাচিন্তা শিক্ষার বিভিন্ন দিক কে বিভিন্ন ভাবে প্রভাবিত করেছিল। তার শিক্ষা দর্শন নতুন আলোকবর্তিতা হিসেবে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিস্তার লাভ করে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের শিক্ষা দর্শন ও শিক্ষা চিন্তা এখানে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হল।
সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন জীবনী
বিশিষ্ট দার্শনিক, চিন্তাবিদ, ও শিক্ষাবিদ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন ৫ই সেপ্টেম্বর ১৮৮৮ সালে ভারতবর্ষের তামিলনাড়ুতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তামিলনাড়ু থেকে স্কুল কলেজের শিক্ষা সম্পন্ন করেন।
তিনি দর্শন শাস্ত্রের উপর উচ্চশিক্ষা বা উচ্চতর ডিগ্রি (এম.এ) লাভ করেন। ১৯২৯ সালে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপনা করেন।
1931 সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং অন্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেন। এরপর তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদ আলোকিত করেন।
১৯৫৪ সালে রাধাকৃষ্ণন জাতীয় স্তরের সর্ব শ্রেষ্ঠ পুরস্কার ‘ভারতরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯৬২ সালে তিনি ভারতবর্ষের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
রাধাকৃষ্ণনের লিখিত উল্লেখযোগ্য পুস্তক হল – ভারতীয় দর্শন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দার্শনিক চিন্তা, ধর্ম ও সমাজ প্রভৃতি।
সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন শিক্ষা দর্শন | Contribution of Radhakrishnan in Education
সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন শিক্ষা দর্শন তার জীবন দর্শনের উপর বিশেষভাবে প্রভাবিত। তিনি ছিলেন একদিকে দার্শনিক এবং অপরদিকে ছিলেন শিক্ষাবিদ।
রাধাকৃষ্ণান বলেছেন – কোন ব্যক্তির জীবন দর্শন তার জীবন যাত্রা ও কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করে।
রাধাকৃষ্ণন এক দিকে ছিলেন আধ্যাত্মবাদী বা ভাববাদী এবং অন্যদিকে ছিলেন বাস্তববাদী। তার শিক্ষা দর্শন কেবলমাত্র আধ্যাত্মিকতা বা ভাবকেন্দ্রিক ছিল না বরং ব্যবহারিক দিকেও তার শিক্ষা চিন্তা বিস্তার লাভ করেছিল।
রাধাকৃষ্ণনের মতে শিক্ষা এবং দর্শন পরস্পর পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক রেখে চলে। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন শিক্ষা দর্শন বিশ্লেষণ করলে যে সমস্ত পরিলক্ষিত হয়, সেগুলি হল –
শিক্ষার লক্ষ্য
সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন শিক্ষা দর্শন এর মধ্যে অন্যতম হল শিক্ষার লক্ষ্য। শিক্ষার লক্ষ্য সম্পর্কে ডক্টর সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের সুচিন্তিত মতামত পাওয়া যায়। তার মতে শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য গুলি হল –
i) শিক্ষার লক্ষ্য হবে শিশুর ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধন। যার ফলে ব্যক্তি ও সমাজের উভয়ের কল্যাণ সাধন সম্ভবপর হবে।
ii) শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্ম সংযমের বিকাশ সাধন করা। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধৈর্য এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের বিকাশে সহায়তা করা।
iii) শিক্ষার লক্ষ্য হবে স্বাধীনতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিজস্ব চিন্তা ভাবনাকে বিকশিত করে
শিক্ষার পাঠক্রম
পাঠক্রম সম্পর্কে রাধাকৃষ্ণন গুরুত্বপূর্ণ মতামত পোষণ করেন। রাধাকৃষ্ণন শিক্ষার পাঠক্রমকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। যথা –
i) বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি – যেগুলি শিক্ষার্থীদের প্রকৃতির বিভিন্ন জ্ঞান এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করে
ii) সামাজিক বিজ্ঞান – সামাজিক বিজ্ঞানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত বিষয় হল – সমাজবিদ্যা, শিক্ষাবিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল প্রভৃতি। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারবে।
iii) দর্শন, শিল্প ও স্থাপত্য – এটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে দিক নির্দেশ করে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আধ্যাত্মিক অস্তিত্বের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানতে সহায়তা করে থাকে।
এছাড়া রাধাকৃষ্ণান পাঠক্রমের মধ্যে ধর্ম ও নীতি শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি বলেন – শিক্ষার সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক থাকা বিশেষ প্রয়োজন। এই ধর্ম শিক্ষার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক শিক্ষা দান করা প্রয়োজন। তবে ধর্মের গোঁড়ামি একেবারে গ্রহণযোগ্য নয়।
শিক্ষকের ভূমিকা
শিক্ষকের ভূমিকা প্রসঙ্গে রাধাকৃষ্ণন বলেন শিক্ষক হবেন আদর্শ এবং গুণমান সম্পন্ন। শিক্ষকের ভূমিকা হল সহানুভূতিশীল ও বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব নিয়ে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের চাহিদাকে পূরণ করবে।
তাছাড়া শিক্ষকদের নিজেদের দায়-দায়িত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন থাকার কথা তিনি বারবার উল্লেখ করেছেন।
শিক্ষার মাধ্যম
সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান শিক্ষা দর্শন হিসেবে শিক্ষার মাধ্যম একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিক। শিক্ষার মাধ্যম সম্পর্কে রাধাকৃষ্ণন বলেছেন –
i) মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষা স্তরে মাতৃভাষা থাকবে। পাশাপাশি জাতীয় ভাষা এবং ইংরেজি হবে শিক্ষার মাধ্যম.
ii) হিন্দি ভাষার উন্নতির জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা.
iii) উচ্চশিক্ষায় আঞ্চলিক ভাষা বা মাতৃভাষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।
iv) উচ্চ শিক্ষার পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ইংরেজি ভাষার প্রাধান্য থাকবে।
নারী শিক্ষা
ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন শিক্ষা দর্শন এর ক্ষেত্রে নারী শিক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তাই তিনি উচ্চশিক্ষার কমিশনের সুপারিশের নারী শিক্ষার বিস্তারের জন্য বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেন।
তিনি আরো বলেন – শিক্ষার মাধ্যমে নারীদের প্রগতি দান করা হলো জাতীয় কর্তব্য। তিনি নারী শিক্ষার জন্য বেশি পরিমাণে বিদ্যালয় স্থাপন ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে নারীদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেছিলেন।
উপসংহার (Conclusion)
সর্বোপরি বলা যায়, রাধাকৃষ্ণান শিক্ষা দর্শন বা শিক্ষা চিন্তা (Contribution of Radhakrishnan in Education) আধ্যাত্মিক বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে হলেও ব্যবহারিক দিকে তার শিক্ষা চিন্তা প্রতিফলন ঘটেছিল। রাধাকৃষ্ণন তাই বলেছিলেন – ভারতের প্রতিটি নাগরিক যাতে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার, ধর্ম বিশ্বাসের স্বাধীনতা ও সর্বক্ষেত্রে সমান সুযোগ পায় তার জন্য উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
তাছাড়া স্বাধীন ভারতের ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের নেতৃত্বে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন বা রাধাকৃষ্ণন কমিশন গঠিত হয়। সেখানে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের চিন্তাধারার প্রতিফলন পাওয়া যায়। উচ্চ শিক্ষার বিস্তারে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ গুলি আধুনিক শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়।
তথ্যসূত্র (References)
- Ravi, S. Samuel, A Comprehensive Study of Education, Fourth Printing-May 2016, Delhi – 110092, ISBN – 978-81-203-4182-1
- Education in India-Past-Present-Future, Vol. I and II, J. P. Banerjee
- Landmarks in the History of Modern Indian Education, J. C. Aggarwal
- Internet Sources
প্রশ্ন – ডঃ রাধাকৃষ্ণনের মতে শিক্ষার তিনটি লক্ষ্য লেখ
উত্তর – ডঃ রাধাকৃষ্ণনের মতে শিক্ষার তিনটি লক্ষ্য হল – i) ব্যক্তির সর্বাঙ্গীন বিকাশ সাধন, ii) কুসংস্কারও অন্ধবিশ্বাস দূরীকরণ এবং iii) শিক্ষার্থীদের ধৈর্য ও সহনশীলতার বিকাশ সাধন।
প্রশ্ন – সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন এর মতে ধর্ম কি
উত্তর – সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন এর মতে ধর্ম হল মানব জীবনের একটি অপরিহার্য বিষয়। তিনি বলেন – ধর্ম মানবমনে মূল্যবোধ সৃষ্টি করে।
প্রশ্ন – সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন এর বাণী
উত্তর – সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন এর বাণী হল-
i) পুস্তকই হলো সভ্যতার বাহন।
ii) প্রতিটি মানুষের মধ্যে রয়েছে দেবত্বের দীপ্তি বা ঐশ্বরিক আলো।
iii) একজন শিক্ষকের কর্তব্য হবে শিক্ষার্থীদের একটি গণতান্ত্রিক দেশের উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা।
প্রশ্ন – সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন এর লেখা দুটি বই
উত্তর – সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন এর লেখা দুটি বই হল – i) ভারতীয় দর্শন এবং ii) হিন্দু জীবন দর্শন।
প্রশ্ন – সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন কোন সালে ভারতরত্ন পুরস্কার পান?
উত্তর – সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন ১৯৫৪ সালে ভারতরত্ন পুরস্কার পান।
প্রশ্ন – ড সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?
উত্তর – বিশিষ্ট দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ ড সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন ৫ই সেপ্টেম্বর ১৮৮৮ সালে ভারতবর্ষের তামিলনাড়ুতে জন্মগ্রহণ করেন।
প্রশ্ন – ৫ সেপ্টেম্বর ভারতে কার জন্মদিন?
উত্তর – ৫ সেপ্টেম্বর ১৮৮৮ সালে ভারতে বিশিষ্ট দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ ড সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিন।
প্রশ্ন – শিক্ষক দিবসের গুরুত্ব?
উত্তর – শিক্ষক হলেন জাতির মেরুদন্ড। তিনি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য উপযোগী গড়ে তোলেন। তাই শিক্ষক দিবসের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ভারতবর্ষে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ এর ইচ্ছা অনুসারে প্রতিবছর ৫ সেপ্টেম্বর রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিন উপলক্ষে দেশের সমস্ত শিক্ষকদের সম্মান জানাতে শিক্ষক দিবস পালন করা হয়ে থাকে।
প্রশ্ন – সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের মতে শিক্ষা কি?
উত্তর – সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন এর মতে শিক্ষা হল ব্যক্তির বা শিক্ষার্থীর মন এবং আত্মাকে মানবিক বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ করে তোলা। রাধাকৃষ্ণানের মতে – প্রকৃত শিক্ষা শিক্ষার্থীদের মানবিকতার বিকাশে সহায়তা করবে।
আরোও পড়ুন
- পেস্তালৎসী শিক্ষা দর্শন | Pestalozzi Contribution to Education
- ইভান ইলিচের শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষাচিন্তা | Ivan Illich Educational Philosophy
- ভগিনী নিবেদিতার শিক্ষা দর্শন ও শিক্ষা সংস্কার | Role of Sister Nivedita in Educational Reforms
- সমাজ সংস্কারক হিসেবে বেগম রোকেয়ার অবদান | Contribution of Begum Rokeya as a Social Reformer
- নারী শিক্ষায় বেগম রোকেয়ার অবদান | Contribution of Begum Rokeya on Women Education
- স্বামী বিবেকানন্দের মানুষ গড়ার শিক্ষা সংক্রান্ত ধারণাটি ব্যাখ্যা করো | Man Making Education