প্রচলিত গতানুগতিক শিক্ষা পদ্ধতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ ইভান ইলিচ এক নতুন শিক্ষা পদ্ধতির কথা বলেন। ইভান ইলিচের শিক্ষা দর্শন ও শিক্ষাপদ্ধতি (Ivan Illich Educational Philosophy) ছিল আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার এক নতুন অধ্যায়।
১৯২৬ সালের ৪ই ডিসেম্বর ইভান ইলিচ অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে জন্মগ্রহণ করেন। অল্প অল্প বয়সে তিনি অত্যন্ত মেধার পরিচয় দেন। পরবর্তীকালে ইভান ইলিচ ক্রোয়েশীয় ভাষা, গ্রিক ভাষা, ল্যাটিন, হিন্দি, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষা আয়ত্ত করেন। ১৯৬১ সালে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন ও সেখানে মিশনারিদের ভাষা শিক্ষা ও অন্যান্য বিষয়ের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। 2002 সালে এই মহান শিক্ষাবিদের জীবনাবসান হয়।
ইভান ইলিচের শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষাচিন্তা | Ivan Illich Educational Philosophy
ইভান ইলিচের প্রকৃতিবাদী শিক্ষা দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। ইভান ইলিচ দীর্ঘদিনের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলে সংবাদের শিরোনামে এসেছিলেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থার বিরোধিতা করেন। তাঁর শিক্ষা চিন্তার অন্যতম ফসল হল ডি স্কুলিং সোসাইটি। বিদ্যালয় সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব তিনি যুক্তি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।
ইভান ইলিচ দর্শন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে সাফল্যের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেন। এছাড়া তিনি ব্রেমেন ও হ্যাগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেন।
ইভান ইলিচের শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষাচিন্তা (Ivan Illich Educational Philosophy) যে সমস্ত দিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে তা এখন আলোচনা করা হলো।
শিক্ষার লক্ষ্য
ইভান ইলিচ শিক্ষার গতানুগতিক লক্ষ্যের পরিবর্তে শিক্ষার আধুনিক লক্ষ্যের কথা উল্লেখ করেছেন। তার মতে – শিক্ষার লক্ষ্য হবে বহুমুখী। অর্থাৎ শিক্ষার দ্বারা একসাথে অনেকগুলি লক্ষ্য পূরণ করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীদের সর্বাঙ্গিন বিকাশ সাধন ঘটে।
তাছাড়া তার মতে শিক্ষার লক্ষ্য হবে পরীক্ষামূলক। শিক্ষার লক্ষ্যের মধ্যে কোন সংকীর্ণ গণ্ডি থাকবে না। তাই শিক্ষার লক্ষ্যের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থী নতুন কিছু তথ্য করতে পারবে ও পরীক্ষামূলকভাবে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে।
শিক্ষার পাঠক্রম
শিক্ষার পাঠক্রম সম্পর্কে ইভান ইলিচ নতুন ধারণা পোষণ করেন। তার মতে পাঠক্রম হবে আধুনিক এবং পরীক্ষামূলক। তাই তিনি ডি স্কুলিং করণের সুপারিশ করেন। তিনি বলেন যেসব শিক্ষার্থীরা জীবনের যেকোনো সময় শিখতে চায় তখনই শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থাৎ সব সময় শিক্ষা সকলের কাছে সহজলভ্য হবে।
আবার যে সমস্ত শিক্ষার্থীরা শিখতে ইচ্ছুক তাদের শেখা বা দায়িত্ব অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের হাতে তুলে দিতে হবে এবং শিক্ষার্থীরা যাতে কোনো নতুন সমস্যা বা চ্যালেঞ্জিং গ্রহণ করতে পারে সে বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।
ডি স্কুলিং সোসাইটি | Deschooling Society by Ivan Illich
ইভান ইলিচ প্রথাগত শিক্ষার বিরুদ্ধে নতুন বিকল্প ধরনের বিদ্যালয় গঠনের সুপারিশ করেন, যেটি ডি স্কুলিং সোসাইটি নামে অধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এই স্কুলের বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিষ্ঠান ও পেশাদার ব্যক্তিবর্গের সমালোচনা এবং অমানবিকরণের তাদের অবদান ব্যাখ্যা। ইভান ইলিচের শিক্ষায় নীতি মূলক বিপ্লবী শিক্ষাদর্শনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল ডি স্কুলিং সোসাইটি।
ইভান ইলিচ -এর মতে বর্তমান বিদ্যালয় শিক্ষা তার মর্যাদা ও কার্যকারিতা হারিয়েছে। এমনকি বিদ্যালয়ে তার কর্তব্য পালনে ব্যর্থ। কারণ স্কুলের লুকায়িত বিভিন্ন কার্যক্রম যেমন – সমাজের প্রচলিত ধ্যান ধারণা শিক্ষার্থীদের উপর আরোপ করা হয়, যেগুলি অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং অমানুষিক।
ইভান ইলিচ নতুন ধরনের বিদ্যালয়ের গঠন সম্পর্কে বলেছেন বর্তমানে প্রথাগত বিদ্যালয়গুলির একচেটিয়া কারবারের বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে হয়, তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির চরিত্র এবং ব্যবস্থাপনার আকুল পরিবর্তন করতে হবে। ইভান ইলিচের শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া শিশুদের জন্য শিক্ষা। এই সব শিশুরা ধনী পিতা-মাতার সন্তানদের সমকক্ষ হওয়ার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
তাই ইভান ইলিচের দরিদ্র শিক্ষার্থীরা সবদিক থেকে যতদিন পিছিয়ে থাকবে ততদিন শিক্ষার অগ্রগতির জন্য তারা বিদ্যালয়ের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকবে। অর্থাৎ তিনি গতানুগতিক বিদ্যালয় শিক্ষার নেতিবাচক প্রভাবের দিকটি সকলের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন।
ইভান ইলিচ তার শিক্ষা চিন্তায় ভোজ উৎসবপ্রিয়তার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন ডি স্কুলিংকরন ভোজ উৎসবপ্রিয়তা সৃষ্টি করে থাকে। কারন ভোজ উৎসবপ্রিয়তার মাধ্যমে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির এবং ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের স্বাভাবিক ও আবেগময় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অর্থাৎ গতানুগতিক বিদ্যালয় যেটা সম্ভব নয় এই বিদ্যালয় সেই সুসম্পর্ক সহজ ও স্বাভাবিকভাবে বলে তিনি মনে করতেন।
ডি স্কুলিং সোসাইটির প্রয়োজনীয়তা
ইভান ইলিচ ডি স্কুলিং সোসাইটি গঠনের প্রয়োজনীয়তা যে সমস্ত দিক থেকে উল্লেখ করেছেন তা হল –
i) দরিদ্র শিক্ষার্থীদের যথাযথ শিক্ষা প্রদান।
ii) শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অতিরিক্ত বিদ্যালয়ের নির্ভরযোগ্যতা কমানো।
iii) ব্যক্তিদের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন।
iv) অনুশীলন ও পরীক্ষণ এর মাধ্যমে শিখন।
v) দরিদ্র শিক্ষার্থীদের অভিভাবক হিসেবে এই স্কুল কাজ করবে।
vi) বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা প্রদান।
vii) শিক্ষাক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার প্রভৃতি।
উপসংহার (Conclusion)
সর্বোপরি বলা যায়, গতানুগতিক শিক্ষা ব্যবস্থার বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে ইভান ইলিচের ডি স্কুলিং সোসাইটি শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করে। কারণ তিনি এর মাধ্যমে দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করার কথা বলেছিলেন। তাই প্রকৃতিবাদী শিক্ষাচিন্তক হিসাবে ইভান ইলিচের শিক্ষাদর্শন বিশেষভাবে সমাদৃত।
তথ্যসূত্র (References)
- Ravi, S. Samuel, A Comprehensive Study of Education, Fourth Printing-May 2016, Delhi – 110092, ISBN – 978-81-203-4182-1
- Education in India-Past-Present-Future, Vol. I and II, J. P. Banerjee
- Landmarks in the History of Modern Indian Education, J. C. Aggarwal
- Ivan Illich Educational Philosophy b.ed notes
- Internet Sources
প্রশ্ন – বি-স্কুলিকরণের প্রবক্তার পুরো নাম লেখো।
উত্তর – বি-স্কুলিকরণের প্রবক্তার পুরো নাম হল ইভান ইলিচ (Ivan Illich)।
প্রশ্ন – ডি স্কুলিং সোসাইটি কি
ইভান ইলিচ গতানুগতিক প্রথাগত বিদ্যালয় শিক্ষার বিরুদ্ধে নতুন ধরনের বিকল্প স্কুল বা বিদ্যালয় গঠনের কথা বলেন। যেটি শিক্ষায় ডি স্কুলিং সোসাইটি নামে অধিক পরিচিত। অর্থাৎইভান ইলিচের নীতি মূলক বিপ্লবী শিক্ষা তত্ত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল ডি স্কুলিকরণ।
প্রশ্ন – আইভান ইলিচ রচিত একটি বিখ্যাত পুস্তকের নাম লেখো।
উত্তর – আইভান ইলিচ রচিত বিখ্যাত পুস্তকের নাম হল ‘The Celebration of Awareness’ এবং ‘De-Schooling Society’।
প্রশ্ন – ডি স্কুলিং-এর প্রবক্তা কে?
উত্তর – ডি স্কুলিং-এর প্রবক্তা হলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইভান ইলিচ।
প্রশ্ন – আইভান ইলিচ কোন দর্শনতত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।
উত্তর – আইভান ইলিচ প্রকৃতিবাদী দর্শনতত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।
প্রশ্ন – ভোজ উৎসবপ্রিয়তা কি
উত্তর – ইভান ইলিচের শিক্ষাদর্শনের ভোজ উৎসবপ্রিয়তার ধারণাটি একটি বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থার (Alternative in Education) পরিচয়বাহী। ভোজ উৎসবপ্রিয়তা বলতে বোঝায় – স্বশাসন, ব্যক্তিদের ব্যক্তিদের সৃজনশীল মিথস্ক্রিয়া আর পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া। এর মধ্য দিয়ে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির এবং ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের স্বাভাবিক ও আবেগময় সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
আরোও পড়ুন
- পেস্তালৎসী শিক্ষা দর্শন | Pestalozzi Contribution to Education
- ইভান ইলিচের শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষাচিন্তা | Ivan Illich Educational Philosophy
- ভগিনী নিবেদিতার শিক্ষা দর্শন ও শিক্ষা সংস্কার | Role of Sister Nivedita in Educational Reforms
- সমাজ সংস্কারক হিসেবে বেগম রোকেয়ার অবদান | Contribution of Begum Rokeya as a Social Reformer
- নারী শিক্ষায় বেগম রোকেয়ার অবদান | Contribution of Begum Rokeya on Women Education
- স্বামী বিবেকানন্দের মানুষ গড়ার শিক্ষা সংক্রান্ত ধারণাটি ব্যাখ্যা করো | Man Making Education
ইভান ইলিচের শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষাচিন্তা | Ivan Illich Educational Philosophy সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।