নির্দেশনার প্রকারভেদ | 10 Types of Guidance

নির্দেশনা হল এক ধরনের প্রক্রিয়া যা ব্যক্তিকে সমাজ জীবনের উপযুক্ত করে গড়ে তোলে। নির্দেশনার প্রকারভেদ (Types of Guidance) বহুবিধ, যেমন – শিক্ষামূলক, বৃত্তিমূলক, ব্যক্তিগত, দলগত, সামাজিক প্রভৃতি।

নির্দেশনা ব্যক্তি জীবনের সমস্যার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। জীবনে চলার পথে বা পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে অভিযান করার জন্য একটি নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়। আর এই সমস্যার সমাধান করার জন্য নির্দেশনা বিশেষভাবে আবশ্যিক। এখানে ব্যক্তিজীবনের যে সমস্ত নির্দেশনা গুলি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বা নির্দেশনার প্রকারভেদ গুলি আলোচনা করা হল।

নির্দেশনার প্রকারভেদ (Types of Guidance)

নির্দেশনা ধারণা ও সংজ্ঞা থেকে পরিলক্ষিত হয় যে ব্যক্তি যেখানে সমস্যা আক্রান্ত হয় সেখানেই নির্দেশনার প্রয়োজন হয়। ব্যক্তিজীবনে তাই নানা ধরনের নির্দেশনা প্রয়োজন হয়ে থাকে। এখানে নির্দেশনার প্রকারভেদ (Types of Guidance) যে সমস্ত দিক থেকে বর্তমান সেগুলি আলোচনা করা হল –

1. ব্যক্তিগত নির্দেশনা

নির্দেশনার প্রকারভেদ গুলির মধ্যে অন্যতম হল ব্যক্তিগত নির্দেশনা। যখন ব্যক্তিকে এককভাবে বা ব্যক্তিগতভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে তখন তাকে ব্যক্তিগত নির্দেশনা বলে। এই প্রকার নির্দেশনা ব্যক্তির ব্যক্তিগত সমস্যার উপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়ে থাকে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায় – শিক্ষার্থীদের বয়সন্ধিকালের যে সমস্যা সেই সমস্যার সমাধানে ব্যক্তিগত নির্দেশনা বিশেষভাবে প্রযোজ্য।

ব্যক্তিগত নির্দেশনার সুবিধা হল –

  • ব্যক্তির ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধান করা বা মানসিক সমস্যার সমাধান করা সহজসাধ্য হয় এবং
  • ব্যক্তিকে একান্ত ভাবে পর্যবেক্ষণ করে সহজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়।

2. দলগত নির্দেশনা

দলগত নির্দেশনা নির্দেশনার প্রকারভেদ গুলির মধ্যে অন্যতম। যখন দলগত ভাবে শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানের বা ব্যক্তির সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়, তখন তাকে দলগত নির্দেশনা বলে। দলগত নির্দেশনার সর্বপ্রথম ধারণাটি দেন বিঁনে (Binet)। দলগত নির্দেশনার মাধ্যমে প্রধানত শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগত ও বৃত্তিগত তথ্য সরবরাহ বা সাধারণ সমস্যার সমাধান করার ক্ষেত্রে গ্রহণ করা হয়ে থাকে।

দলগত নির্দেশনার উদাহরণ হল – সাধারণ আলোচনা বা সেমিনার, ওয়াকসপ বা কর্মশালা, বক্তৃতা, নাটক প্রভৃতি।

দলগত নির্দেশনার সুবিধা হল –

  • একসঙ্গে বহু সংখ্যক ব্যক্তিকে বা শিক্ষার্থীদের কোনো নির্দিষ্ট বা সাধারণ সমস্যাগুলি সমাধান করা সহজ হয়।
  • দলগত নির্দেশনার ক্ষেত্রে সময় ও অর্থের সাশ্রয় হয়। অর্থাৎ একসঙ্গে অনেককে নির্দেশনা সুযোগ থাকে ফলে ব্যক্তিগত নির্দেশনার মতো সময় ও অর্থ বেশি লাগে না।
  • দলগত নির্দেশনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সাধারণ সমস্যাগুলি বা শিক্ষার্থীদের আচার-আচরণের উন্নতিকরণে বা পরিবর্তন করা সহজসাধ্য হয়।

3. শিক্ষামূলক নির্দেশনা

সাধারণভাবে যে নির্দেশনা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগত দিকে বিশেষভাবে সাহায্য করে, তাকে শিক্ষামূলক নির্দেশনা বলা হয়ে থাকে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ক্ষেত্রে যাবতীয় সমস্যা সমাধানের জন্য শিক্ষামূলক নির্দেশনা গ্রহণ করা হয়ে থাকে।

শিক্ষামূলক নির্দেশনায় যে সমস্ত সমস্যাগুলি আশু সমাধান করা সম্ভবপর হয়, সেগুলি হল –

  • শিক্ষার্থীদের পাঠক্রম নির্বাচনের সহায়তা করা।
  • শিক্ষার্থীদের অমনোযোগী বা অমনোযোগের সমস্যা দূরীকরণ।
  • পাঠের অভ্যাস গঠন।
  • উচ্চ শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করা প্রভৃতি।

4. বৃত্তিমূলক নির্দেশনা

যে নির্দেশনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবনের উপযোগী করে গড়ে তোলা বা ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য বৃত্তি নির্বাচনের ক্ষেত্রে সাহায্য করা হয়, তাকে বৃত্তিমূলক নির্দেশনা বলে। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের বৃত্তি জগতের সঙ্গে পরিচয় ঘটানো বা অভিযোজনে সাহায্য করা বৃত্তিমূলক নির্দেশনার অন্যতম উদ্দেশ্য।

বৃত্তিমূলক নির্দেশনার সুবিধা হল –

  • বৃত্তিমূলক নির্দেশনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সহজে বৃত্তি নির্বাচন করতে পারে।
  • কোথায় কি ধরনের বৃত্তি রয়েছে তা বৃত্তিমূলক নির্দেশনার মাধ্যমে সহজে জানা যায়।
  • বৃত্তি পছন্দ, কোন ব্যক্তির জন্য কি ধরনের শিক্ষাগত যোগ্যতা রয়েছে তা বৃত্তিমূলক নির্দেশনা শিক্ষার্থীদের বিশেষভাবে সাহায্য করে।

5. সামাজিক নির্দেশনা

মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সমাজের মানুষের সঙ্গে পারস্পরিক মেলবন্ধন বা সামাজিক ভাবে অভিযোজনের মাধ্যমে ব্যক্তির সমাজের সদস্য হিসেবে পরিগণিত হয়। আর এক্ষেত্রে সামাজিক নির্দেশনা ব্যক্তিকে বিশেষভাবে সহায়তা করে থাকে।

তাই সামাজিক নির্দেশনা হল সমাজের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক মেলামেশা, ভাবের আদান-প্রদান, বন্ধুত্ব স্থাপন বা সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখা এবং পরিবর্তনশীল সামাজিক পরিবেশের মধ্যে ব্যক্তিকে সার্থক হবে অভিযোজনে অংশগ্রহণ করানো।

6. নৈতিক নির্দেশনা

নির্দেশনার প্রকারভেদ গুলির মধ্যে এটি একটি অন্যতম নির্দেশনা। নৈতিক নির্দেশনা হল ব্যক্তির মধ্যে নৈতিক গুণাবলীর জাগ্রত করা। অর্থাৎ নৈতিক নির্দেশনার মাধ্যমে ব্যক্তিকে সমাজ উপযোগী ও চরিত্রবান মানুষ হিসেবে গঠন করা।

এই নির্দেশনার মাধ্যমে – ব্যক্তি সমাজের একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসাবে গঠিত হয়। তাছাড়া ন্যায় অন্যায়ের প্রতিবাদ করা বা বিচার করার ক্ষমতা, অবাঞ্ছিত আচরণ না করা যেমন – মিথ্যা কথা বলা প্রভৃতি গুণাবলীর বিকাশ সাধন সম্ভবপর হয়।

7. অবসর যাপনমূলক নির্দেশনা

অবসর সময়ে অনেক ব্যক্তি বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন, তাই অবসরকালীন সময়ে ব্যক্তি যাতে এই সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন না হয় তার জন্য যে নির্দেশনা সেটি অবসর যাপনমূলক নির্দেশনা নামে পরিচিত। তাই অবসর যাপনমূলক নির্দেশনা হল সৃজনশীল বিভিন্ন কাজকর্মের মাধ্যমে অবসরকালীন সময় কাটানো।

অবসর যাপনমূলক নির্দেশনা উদ্দেশ্য হল – ব্যক্তিকে অবসর সময়ে সময় কাটাতে সাহায্য করে। বিভিন্ন সেবামূলক কাজ যেমন – বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, NSS, ও বিভিন্ন সৃজনমূলক কাজ, গল্পের বই পড়া প্রভৃতি অবসর যাপনমূলক নির্দেশনার অন্তর্গত।

8. বার্ধক্য নির্দেশনা

বৃদ্ধ বয়সে ব্যক্তিরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হীনমন্যতায় ভোগে। তাই বার্ধক্য বয়সে যে নির্দেশনার মাধ্যমে বয়স্কদের সহযোগিতা করা হয় তাকে বার্ধক্য নির্দেশনা বলে। বয়স্করা যাতে মানসিকভাবে সুস্থ থাকে সেই বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয় এই নির্দেশনায়। তাই বার্ধক্য নির্দেশনের মাধ্যমে বার্ধক্য বয়সের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা হয়ে থাকে।

9. স্বাস্থ্য সম্পর্কিত নির্দেশনা

স্বাস্থ্যই সম্পদ। সুস্বাস্থ্যই মানুষকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সবল করে তোলে। তাই সুস্থ শরীর সুস্থ মনের পরিচায়ক। যে নির্দেশনা শিক্ষার্থী বা ব্যক্তির স্বাস্থ্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করে প্রদান করা হয় তাকে স্বাস্থ্য নির্দেশনা বলে। স্বাস্থ্য সম্পর্কিত নির্দেশনার উদ্দেশ্য হল – স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

তাই স্বাস্থ্য নির্দেশনার মধ্যে যে সমস্ত বিষয় প্রাধান্য পায়, সেগুলি হল –

  • স্বাস্থ্য রক্ষা কর্মসূচি মেনে চলা,
  • স্বাস্থ্যের প্রতি অধিক যত্নবান হওয়া,
  • বিদ্যালয় ও গৃহের চারপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা,
  • সুষম খাদ্য বহন করা ও পরিষ্কার পানীয় জল সেবন করা,
  • বিভিন্ন রোগের নিয়ম কানুন বা বিধি মেনে চলা,
  • বছরে একবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা প্রভৃতি।

10. ধর্মীয় নির্দেশনা

যে নির্দেশনা ধর্ম কেন্দ্রিক বা বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-আচরণ, বিধি-নিষেধ পালনের মধ্য দিয়ে একটি চারিত্রিক ও নৈতিক উন্নতি সাধন হয় তাকে ধর্মীয় নির্দেশনা বলে। প্রতিটি সমাজে ধর্মের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু ধর্মীয় নির্দেশনার মাধ্যমে নৈতিক, চারিত্রিক সহ বিভিন্ন সামাজিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটানো হয়ে থাকে। ধর্মীয় নির্দেশনার উদ্দেশ্য হল – কুসংস্কার দূরীকরণের মাধ্যমে নৈতিক বা আধ্যাত্মিক গুণাবলীর বিকাশ সাধন।

আরোও পোস্ট পড়ুন – Click Here Now

উপসংহার (Conclusion)

পরিশেষে বলা যায়, ব্যক্তির জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নির্দেশনার বিশেষ প্রয়োজন পরিলক্ষিত হয়। তবে কি ধরনের নির্দেশনা ব্যক্তির মধ্যে প্রযোজ্য হবে তা নির্ভর করে ব্যক্তির প্রয়োজনের উপর বা সমস্যার উপর। অর্থাৎ শিশুর জন্ম মুহূর্ত থেকে পরিণত হতে বিভিন্ন চাহিদা বা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আর এই জন্য বা শিশুর বিকাশের জন্য নির্দেশনার প্রয়োজন রয়েছে।

তবে উপরের আলোচিত নির্দেশনার প্রকারভেদ গুলি সাধারণভাবে সকল ব্যক্তিদের মধ্যে বিশেষভাবে কমবেশি প্রয়োজনীয়তা লক্ষ্য করা যায়। তাই নির্দেশনা ব্যক্তিকে সার্থকভাবে জীবন যাপন করতে সক্ষম করে তোলে।

তথ্যসূত্র (Reference)

  • Basu, N.C. Educational and Vocational Guidance.
  • Chauhan, S.S. – Principles and Techniques of Guidance.
  • Dave Indu – The Basic Essentials of Counseling.
  • Kocher, S.K. – Guidance and Counselling in Secondary School
  • NCERT- Guidance and Counseling.

প্রশ্ন – নির্দেশনা কত প্রকার

উত্তর – নির্দেশনা (Guidance) বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। সেগুলি হল – শিক্ষামূলক নির্দেশনা, বৃত্তিমূলক নির্দেশনা, সামাজিক নির্দেশনা, পারিবারিক নির্দেশনা, সাংস্কৃতিক নির্দেশনা, ধর্মীয় নির্দেশনা প্রভৃতি।

আরোও পড়ুন

Leave a Comment

close