ভারতের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ হল তপশিলি জাতি ও উপজাতি জনগোষ্ঠী। সমাজে তপশিলি জাতি ও উপজাতি (Scheduled Castes and Tribes) জনগোষ্ঠী সম্প্রদায় সামাজিকভাবে অক্ষম হিসেবে পরিগণিত হয়।
তপশিলি জাতি ও উপজাতি ধারণা | Scheduled Castes and Tribes
ভারতবর্ষের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী সাধারণত তপশিলি জাতি ও উপজাতি হিসেবে গণ্য করা হয়। এখানে তপশিলি জাতি ও উপজাতি ধারণা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
তপশিলি জাতি | Scheduled Castes
সমাজের সর্বনিম্ন স্তরের জাতি হল তপশিলি জাতি। প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে সমাজব্যবস্থা জাতিভেদ প্রথা দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। যেমন – ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র। এর ফলে সমাজের উচ্চবর্ণের দ্বারা নিম্ন বর্ণের মানুষেরা অবহেলিত, শোষিত ও বঞ্চিত হতো। ফলে সমাজের সর্বনিম্ন স্তরের বা নিম্নবর্ণের মানুষেরা তপশিলি জাতি হিসেবে চিহ্নিত হলো।
কিন্তু জাতির জনক মহাত্মা গান্ধি তপশিলি জাতিকে ‘Harijans’ বলেছিলেন। ‘Harijans’ কথার অর্থ তিনি বলতেন ‘The people of God’ অর্থাৎ তপশিলি জাতি আমাদের সমাজেরই সৃষ্টি।
সাধারণত স্বাধীনতার আগে এই জাতিকে অস্পৃশ্য বা ‘Untouchables’ বলে অভিহিত করা হতো। আবার ব্রিটিশরা এই জাতিকে ‘Exterior Castes’ হিসেবে অভিহিত করতেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর ভারতীয় সংবিধানে অস্পৃশ্যতা আইনের মাধ্যমে এই বিষয়টির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
1935 খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় আইনের ধারায় ভারতীয় সমাজের যে শ্রেণীর মানুষেরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়েছিল এবং সমাজের কাছে থেকে ন্যায়বিচার পায়নি তাদের ‘Scheduled Castes’ বা তপশিলি জাতি হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়।
তপশিলি উপজাতি | Scheduled Tribe
ভারতীয় সংবিধানের 336(25) নম্বর ধারায় তপশিলি উপজাতি সম্পর্কে বলা হয়েছে – তপশিলি উপজাতি হল একটি অংশবিশেষ যা ভারতের রাষ্ট্রপতি 342(1) নম্বর ধারা বলে পাবলিক নোটিফিকেশনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ও চিহ্নিতকরণ করেন।
সুতরাং স্বাধীন ভারতে রাষ্ট্রপতির নির্দেশে বিভিন্ন রাজ্যের যেসব অনগ্রসর উপজাতির নাম নথিভুক্ত করা হয়, তাহলে তপশিলি উপজাতি বলা হয়। যেমন – সাঁওতাল, কোল, মুন্ডা প্রভৃতি।
তাই ভারতীয় সংবিধানে তপশিলি উপজাতি সম্পর্কে বলা হয়েছে –
i) যাদের মধ্যে আদিম লক্ষণগুলি পরিলক্ষিত হয়,
ii) যে সমস্ত জাতি নির্দিষ্ট সংস্কৃতির অধিকারী,
iii) যারা ভারতের ভৌগোলিক অবস্থান থেকে বিচ্ছিন্ন,
iv) অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে অনিচ্ছুক বা সভ্যতার আলোয় আসতে চায় না।
আবার, মিশ্র (2002) তপশিলি উপজাতি সম্পর্কে বলেছেন – তপশিলি উপজাতি হল তারাই যারা
i) নিজেদের ভূমিপুত্র বলে মনে করেন,
ii) পাহাড় বা দুর্গম এলাকায় বসবাস করেন,
iii) অধিকাংশ দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে,
iv) নির্দিষ্ট সংস্কৃতির প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল এবং
v) দলের প্রতি আনুগত্য এবং পূর্বপুরুষদের বিশ্বাসের অনুগামী।
তপশিলি জাতি ও উপজাতি গোষ্ঠীর সামাজিক অন্তর্ভুক্তি করনে শিক্ষার ভূমিকা | Inclusive Education for SC/ST Communities
তপশিলি জাতি ও উপজাতি গোষ্ঠীর শিক্ষা সহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দানের ক্ষেত্রে ভারতীয় সংবিধানের বিভিন্ন ধারা ও উপর ধারা রয়েছে। এর ফলে তপশিলি জাতি ও উপজাতিরা বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা লাভ করে থাকে।
কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক কুসংস্কার এবং মানুষের মানুষের ভেদাভেদ বা উচ্চবর্ণের মানুষদের নিম্ন বর্ণের প্রতি ঘৃণার মনোভাব প্রভৃতি কারণে তপশিলি জাতি ও উপজাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা অনেক সময় সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকরনে অংশগ্রহণ করতে পারে না।
তাই এক্ষেত্রে তপশিলি জাতি ও উপজাতিগোষ্ঠীর (Scheduled Castes and Tribes) সামাজিক অন্তর্ভুক্তি করনে শিক্ষার ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা তপশিলি জাতি ও উপজাতির সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকরণে যে সমস্ত ভূমিকা পালন করে সেগুলি হল –
i) শিক্ষা ক্ষেত্রে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা,
ii) শিক্ষায় সমসুযোগের ব্যবস্থা করা বা সকলের জন্য শিক্ষা প্রদান করা,
iii) আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করা,
iv) চাকরি ক্ষেত্রে সমসুযোগের নীতি গ্রহণ করা বা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা,
v) অনুন্নত এলাকায় শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা প্রদান প্রভৃতি।
তপশিলি জাতি ও উপজাতি গোষ্ঠী সামাজিক দিক থেকে বহির্ভূত কেন | Why Scheduled Castes and Tribes Remain Socially Excluded: Causes and Challenges
তপশিলি জাতি ও উপজাতিগোষ্ঠী (Scheduled Castes and Tribes) সামাজিক দিক থেকে বহির্ভূত কেন তার বিভিন্ন কারণ রয়েছে, সেগুলি হল নিম্নলিখিত –
i) জাতপাত ও ছোঁয়াছুঁয়ির প্রথা (Caste-based discrimination)
ii) শিক্ষার অভাব (Lack of education)
iii) অর্থনৈতিক দুর্বলতা (Economic deprivation)
iv) রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের ঘাটতি (Lack of political representation)
v) সামাজিক অবমাননা (Social humiliation)
vi) সাংস্কৃতিক ভিন্নতা ও বিচ্ছিন্নতা (Cultural alienation)
vii) সরকারি নীতির দুর্বল প্রয়োগ (Poor implementation of government policies)
viii) প্রযুক্তিগত সুবিধা থেকে বঞ্চিত (Lack of access to technology)
ix) স্বাস্থ্যসেবা ও জীবনমানের বৈষম্য (Inequality in healthcare and living standards)
x) প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি ও কুসংস্কার (Prejudices and superstitions)
উপসংহার (Conclusion)
পরিশেষে বলা যায়, ভারতবর্ষে বিভিন্ন জায়গায় তপশিলি জাতি ও তপশিলি উপজাতিদের (Scheduled Castes and Tribes) বসবাস পরিলক্ষিত হয়। ভারতীয় সংবিধানের বিভিন্ন ধারায় তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের শিক্ষা সহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দানের কথা বলা হয়। অর্থাৎ এদের উন্নতিকল্পে ভারতীয় সংবিধান বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে ও বঞ্চনার মুক্তি পেতে বিভিন্ন আইনি সহায়তা প্রদান করে।
তথ্যসূত্র (References)
- Kar. Chintamani, Exceptional Children Their Psychology and Education. Sterling Publication Pvt. Ltd. New Delhi.
- Kirk, S. A. Educating Exceptional Children. Oxford IBH. New Delhi.
- Mangal, S. K. Educating Exceptional Children: An Introduction to Special Education. PHI Learning Pvt. Ltd. New Delhi.
- Panda, K. C. Education of Exceptional Children. Vikas Publishing House Pvt. Ltd. New Delhi.
- Internet sources
- Concept of Scheduled Castes and Tribes
প্রশ্ন – ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী তপশিলি জাতি কাদের বলা হয়
উত্তর –
ভারতীয় সংবিধানের 15 এবং 46 নং ধারায় তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের শিক্ষা বিষয়ে বলা হয়েছে।
প্রশ্ন – তপশিলি জাতি কোন রাজ্যে বেশি
উত্তর – ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ভারতে পাঞ্জাবে তপশিলি জাতি সবথেকে বেশি। যেখানে জনসংখ্যার ৩২ শতাংশ হল তপশিলি জাতি।
প্রশ্ন – তপশিলি উপজাতি কোন রাজ্যে বেশি
উত্তর – ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লাক্ষাদ্বীপে তপশিলি উপজাতির জনসংখ্যা সব থেকে বেশি। এখানে মোট 94.8% উপজাতি জনগোষ্ঠী। ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির মধ্যে এটি সর্বোচ্চ।
Latest Education Articles
- অন্তর্ভুক্তিকরণের বাধা সমূহ | 6 Barriers to Inclusion
- তপশিলি জাতি ও উপজাতি কাকে বলে | Concept of Scheduled Castes and Tribes
- বহু কৃষ্টি মূলক সমাজের জন্য শিক্ষার ভূমিকা | Role of Education for a Multicultural Society
- শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য শিক্ষার ভূমিকা | Role of Education for Peaceful Coexistence
- বাধামুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে সমাজের ভূমিকা | Role of Society in Creating Barrier Free Environment
- বাধামুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে বিদ্যালয়ের ভূমিকা | Role of School in Creating a Barrier Free Environment