পৃথিবীর অর্ধেক জনসমষ্টি নারী। কেবলমাত্র সমাজে পুরুষরা শিক্ষিত হলে সমাজ ব্যবস্থার পুরোপুরি উন্নতি সম্ভবপর নয়। তাই বর্তমানকালে নারী শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে ও সেই অনুযায়ী নারী শিক্ষার উদ্দেশ্য (Objectives of Women’s Education) নেইচিহ্নিতকরণ করা হচ্ছে।
শিক্ষা হল শক্তিশালী হাতিয়ার। কিন্তু সমাজে শিক্ষার সমসুযোগ পরিলক্ষিত হয় না। অর্থাৎ শিক্ষা থেকে নারীরা বঞ্চিত ও অবহেলিত। কিন্তু আধুনিক শিক্ষা ক্ষেত্রে নারী শিক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। সাধারণভাবে নারীদের শিক্ষার আলোয় নিয়ে আসা নারী শিক্ষার একমাত্র প্রধান উদ্দেশ্য। নারী শিক্ষার উদ্দেশ্য গুলি কি কি সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।
নারী শিক্ষার উদ্দেশ্য | Objectives of Women’s Education
প্রাচীনকালে নারীদের শিক্ষার অধিকার ছিল না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলে আধুনিক শিক্ষার ক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও শিক্ষিত হচ্ছে।
আধুনিক শিক্ষা ক্ষেত্রে নারী শিক্ষার উদ্দেশ্য বহুবিধ। যে সমস্ত দিক থেকে নারী শিক্ষার উদ্দেশ্য পরিলক্ষিত হয়, সেগুলি হল নিম্নলিখিত –
1. নিরক্ষরতা দূরীকরণ
নারী শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হল নিরক্ষরতা দূরীকরণ। যার মধ্য দিয়ে মেয়েরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয়। এটি সমাজ অগ্রগতির ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সহায়তা করে থাকে।
2. বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রদান
নারী শিক্ষার মাধ্যমে বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রদান করা হয়ে থাকে। কারণ সমাজে নারীদের বা মেয়েদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা না হলে সমাজ পিছিয়ে পড়বে বা আর্থিক দিক থেকে সমাজ অনেকখানি পিছিয়ে থাকবে। তাই অর্থনৈতিক দিকের ক্ষেত্রে মেয়েদের স্বাবলম্বী বা স্বাধীন করার জন্য বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রদান নারী শিক্ষার উদ্দেশ্য।
3. নেতৃত্বদান
বর্তমানে মেয়েরা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দান করতে সক্ষম হচ্ছে। অর্থাৎ নারী শিক্ষার ফলে নেতৃত্বদান করা অনেক বেশি সহজ হবে। তাই নারী শিক্ষার উদ্দেশ্য হল নেতৃত্বদানের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মেয়েদের অসামান্য অবদানকে তুলে ধরা।
4. সচেতনতা বৃদ্ধি
নারীরা সমাজের বিভিন্ন কুসংস্কার দ্বারা আচ্ছন্ন। ফলে সমাজের অগ্রগতি অনেক ধীর গতিতে সম্পন্ন হচ্ছে। তাই নারী শিক্ষার মাধ্যমে মেয়েদের সচেতনতা করার মধ্য দিয়ে তাদের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়নসহ সমাজের উন্নয়ন বা অগ্রগতি সম্ভব। তাই নারী শিক্ষার উদ্দেশ্য হল নারীদের বা মেয়েদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
5. আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা
নারীরা যাতে বিভিন্ন কাজে তাদের অবদান রাখতে সচেষ্টা হয়, সেই জন্য তাদের শিক্ষার মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস গঠন করা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাই নারী শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হল মেয়েদের বা নারীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা।
6. মানব সম্পদের বিকাশ
মানবসম্পদের বিকাশ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে একটি সমাজসহ দেশের উন্নতি দ্রুত গতিতে সম্পন্ন হয়। তাই কেবলমাত্র পুরুষ জাতি শিক্ষিত হলে মানুষ সম্পদের যথাযথ বিকাশ সম্ভব নয়। পাশাপাশি নারী শিক্ষার মধ্য দিয়ে মানবসম্পদ বিকাশকে ত্বরান্বিত করা যায়। তাই নারীরা যে দেশের অন্যতম মানব সম্পদ, সেই দিকটির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে নারী শিক্ষার উদ্দেশ্য হল মানব সম্পদের যথাযথ বিকাশ সাধন করা।
7. সামাজিক সমস্যা প্রতিরোধ
সমাজে বিভিন্ন সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে প্রণপ্রথা, অন্ধবিশ্বাস বা বিভিন্ন কুসংস্কার প্রভৃতি। নারী শিক্ষার মধ্য দিয়ে সামাজিক বিভিন্ন সমস্যার প্রতিরোধ করা সম্ভবপর হয়ে থাকে। কারণ মেয়েরা যত বেশি শিক্ষিত হবে সামাজিক সমস্যা গুলি তত বেশি কমতে থাকবে। তাই নারী শিক্ষার উদ্দেশ্য হল সামাজিক সমস্যার প্রতিরোধে সচেষ্টা হওয়া।
8. গঠনমূলক কাজে সহায়তা
পুরুষের পাশাপাশি মেয়েরা যাতে সমাজের গঠনমূলক কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে তার জন্য আগে দরকার নারী শিক্ষা। কারণ মেয়েরা বা নারীরা উপযুক্ত শিক্ষিত না হলে সমাজ কখনোই অগ্রগতি লাভ করতে পারে না। তাই বিভিন্ন গঠনমূলক কাজে সহায়তা করার জন্য নারী শিক্ষার উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়।
9. সমাজ গঠনে উপযোগী
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন – একটি ডানায় ভর করে যেমন পাখি উড়তে পারে না, ঠিক তেমনি পুরুষজাতি কেবলমাত্র শিক্ষিত হলে সমাজের অগ্রগতি সম্ভব নয়। তাই সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে প্রয়োজন। তাই নারী শিক্ষার উদ্দেশ্য হল শিক্ষার মাধ্যমে নারীদের সমাজ গঠনের উপযোগী করে গড়ে তোলা।
10. লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ
সমাজের একটি মূল সমস্যা হল লিঙ্গ বৈষম্য। অর্থাৎ নারী পুরুষের মধ্যে ভেদাভেদ তৈরি করা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা লিঙ্গ ভেদ বা লিঙ্গবৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করে। কিন্তু নারীরা যদি শিক্ষিত হয় তাহলে এই লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ সম্ভব হবে। কারণ পুরুষের সাথে লিঙ্গ বৈষম্য করে নারীদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
তাই নারী শিক্ষার উদ্দেশ্য হল লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ করা। যাতে সবাই একসঙ্গে শিক্ষার আলয় আলোকিত হতে পারে।
11. বাল্যবিবাহ দূরীকরণ
নারী শিক্ষার মাধ্যমে বাল্যবিবাহ দূরীকরণ করা সম্ভব করা হয়। কারণ ভারতবর্ষে সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও জলন্ত সমস্যা হল বাল্যবিবাহ। মেয়েদেরকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করে অতি অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদেরকে পারিবারিক বোঝা হিসাবে মনে করা হয়।
তাই নারী শিক্ষার উদ্দেশ্য হল বাল্যবিবাহ দূরীকরণ করা। যাতে মেয়েরা শিক্ষার মধ্য দিয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ গঠন করতে পারে সেই দিকে নারী শিক্ষার গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সুতরাং যথাযথ নারী শিক্ষার মধ্য দিয়ে বাল্যবিবাহ রোধ করে এর অভিশাপ থেকে সমাজকে মুক্ত করা সম্ভবপর হয়।
12. সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বৃদ্ধি
নারী শিক্ষার উদ্দেশ্য হল মেয়েদেরকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। অর্থাৎ যে কোনো কাজে তারা যেন নিজেদেরকে দুর্বল না ভাবে। তাই উপযুক্ত শিক্ষার মধ্য দিয়ে তাদের যথাযথ নিজেদের জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বৃদ্ধি করাই হল নারী শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য।
সুতরাং যে নারীরা যত বেশি শিক্ষিত ও মার্জিত রুচিসম্পন্ন হবে তারা তত বেশি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সচেষ্ট হবে। তাই শিক্ষা নারীকে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন – সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে পুরুষের সমকক্ষ হতে পারে, তার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করাই হল নারী শিক্ষার উদ্দেশ্য।
এগুলি ছাড়াও নারী শিক্ষার উদ্দেশ্যের মধ্যে আরো যে সমস্ত বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলি হল –
- নারীর আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি করা,
- প্রয়োজন ক্ষমতা হ্রাস জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে সচেতন করা,
- মাতৃত্বকালীন মৃত্যু হ্রাস করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ বা সচেতন করা,
- শিশু মৃত্যুর হার রোধ করা। অর্থাৎ মায়েরা যত বেশি শিক্ষিত হবে শিশু মৃত্যুর হার ততো কম হবে।
- স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা করা। অর্থাৎ শিক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে নারীদেরকে সচেতন করে গড়ে তোলা।
- সন্তান লালন পালনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত চিন্তা ভাবনা গ্রহণ করা। তাই বলা হয় একজন শিক্ষিত মা ১০০ জন শিক্ষকের সমান। অর্থাৎ নারীরা শিক্ষিত হলে তাদের সন্তানও সুশিক্ষিত ও সমাজে উপযোগী হয়ে গড়ে উঠবে।
👉 আরোও পোস্ট পড়ুন – Click Here Now
উপসংহার (Conclusion)
পরিশেষে বলা যায়, নারী শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের অগ্রগতি অনেকাংশে সম্ভবপর হয়। তাই আধুনিক যুগে শিক্ষা ব্যবস্থায় নারী শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। নারী শিক্ষার বিস্তারের ক্ষেত্রে তাই সরকারি বিভিন্ন প্রজেক্ট গ্রহণ করা হচ্ছে অপরদিকে বেসরকারি উদ্যোগও নারী শিক্ষার বিস্তারে সহায়তা করছে।
তথ্যসূত্র (References)
- Ravi, S. Samuel, A Comprehensive Study of Education, Fourth Printing-May 2016, Delhi – 110092, ISBN – 978-81-203-4182-1
- Internet Sources
প্রশ্ন – নারী শিক্ষার দুটি উদ্দেশ্য
উত্তর – নারী শিক্ষার দুটি উদ্দেশ্য হল – i) নারীদেরকে শিক্ষার মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা এবং ii) দেশ ও জাতির উন্নতির জন্য বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণ করা।
আরোও পড়ুন
- নারী শিক্ষায় রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা | Important Role of Rammohan Roy in Women Education
- নারী শিক্ষায় বিদ্যাসাগরের অবদান | Role of Vidyasagar in Women Education
- নারী শিক্ষায় হংসরাজ মেহেতা কমিটির সুপারিশ (Hansraj Mehta Committee)
- Bhaktavatsalam Committee: নারী শিক্ষা বিষয়ে ভক্তবৎসলম কমিটির সুপারিশ
- Durgabai Deshmukh Committee: নারী শিক্ষায় দূর্গাবাঈ দেশমুখ কমিটির সুপারিশ
- নারী শিক্ষায় মিশনারীদের অবদান : Missionaries’ Contribution to Women Education