নারী শিক্ষা (Women Education) তথা নারীমুক্তির আন্দোলনের ক্ষেত্রে সমাজসংস্কারক রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা (Raja Rammohan Roy) ছিল অগ্রগণ্য।
তৎকালীন পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের স্থান ছিল একেবারে নিচুস্তরে। শিক্ষার ক্ষেত্রে নারীদের কোনো সুযোগ-সুবিধা ছিল না। ফলে নারীরা বিভিন্ন দিক থেকে সামাজিকভাবে লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত, শোষিত হতেন। রাজা রামমোহন রায় সর্বপ্রথম এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। তথাকথিত সমাজের বিভিন্ন নিয়ম নীতির বিরুদ্ধে তিনি সমালোচনা করেন।
রামমোহন রায়ের জীবনী (Biography of Rammohan Roy)
ঊনবিংশ শতকের প্রধান প্রাণপুরুষ তথা সমাজ সংস্কারক ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। তিনি 1772 সালের 22শে মে হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামে ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতার নাম ছিল রামকান্ত রায় এবং মা ছিলেন তারিনী দেবী।
ছোটবেলা থেকে রাজা রামমোহন রায় খুব মেধাবী ছিলেন। তিনি মোট 10 টি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সংস্কৃত, ফারসি, আরবি, বাংলা, ইংরেজি, ল্যাটিন প্রভৃতি।
নারী শিক্ষায় রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা (Role of Rammohan Roy in Women Education)
সামাজিকভাবে নিপীড়িত, শোষিত ও পিছিয়ে পড়া নারীদের শিক্ষার জন্য রাজা রামমোহন রায় সারাজীবন লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন। বিভিন্ন সমাজ সংস্কারকমূলক কাজের মধ্য দিয়ে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের হিত সাধন করেছিলেন।
নারী শিক্ষার (Women Education) বিস্তারের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পরিলক্ষিত হয় সেগুলি আলোকপাত করা হল –
1. শিক্ষার সমান অধিকার
রামমোহন রায়ের সমাজ সংস্কারক বিভিন্ন দিকের মধ্য দিয়ে নারী শিক্ষার (women Education) সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট হয়েছিল। অর্থাৎ তিনি নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাই রাজা রামমোহন রায় সর্বপ্রথম নারীদের শিক্ষা ক্ষেত্রে সমান অধিকারের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।
2. নারী কল্যাণ সাধন
ঊনবিংশ শতকের ঘুণধরা পুরুতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে রাজা রামমোহন রায় সোচ্চার হয়েছিলেন। প্রচলিত সামাজিক কুসংস্কার ও গোঁড়ামির অপসারণ করে নারীজাতির কল্যাণ সাধনের মধ্য দিয়ে সমাজজীবনকে কলুষমুক্ত ও নারী শিক্ষার (women Education) বিস্তার সাধন করতে চেয়েছিলেন। তাই নারী কল্যাণ সাধন ছিল রাজা রামমোহন রায়ের নারী শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য।
3. সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠা
তৎকালীন পুরুতান্ত্রিক সমাজে নারীর সমান সামাজিক অধিকার ছিল না। অর্থাৎ মেয়েরা সামাজিক যাবতীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকতো। এমনকি মেয়েদের জন্য যথাযথ শিক্ষার ব্যবস্থা সমাজে প্রচলিত ছিল না।
রাজা রামমোহন রায় সর্বপ্রথম নারীদের সমান সামাজিক অধিকার ছাড়া সমাজের সামগ্রিক উন্নতি সম্ভব নয় একথা বলিষ্ঠ কণ্ঠে উল্লেখ করেছিলেন। তাছাড়া নারীরা যাতে সম্পত্তিতে সমান অধিকার পায় ও স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারে তার জন্য রাজা রামমোহন রায় চেষ্টা করেছিলেন।
4. পুস্তক প্রকাশ
রাজা রামমোহন রায় ১৮২২ সালে ‘নারীদের প্রাচীন অধিকারের বর্তমান সংকোচনের উপর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য’ নামে একটি পুস্তক রচনা করেন। যেখানে নারীদের আইনসম্মত অধিকার ও তাদের শিক্ষাদান -এর জন্য দাবি করেন রাজা রামমোহন রায়।
এছাড়া ‘সংবাদ কৌমুদি’ পত্রিকাতে দরিদ্র বিধবাদের সাহায্যের জন্য একটি সমিতি গঠনের জন্য সরকারকে অনুরোধ করেন।
নারী শিক্ষার উন্নতিকল্পে জন্য রাজা রামমোহন রায় যে সোচ্চার হয়েছিলেন তা কয়েকটি গ্রন্থ থেকে বিশেষভাবে জানা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – ভট্টাচার্যের সহিত বিচার (1817), গোস্বামীর সহিত বিচার (1818), সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক নিবর্তক সংবাদ (1818) প্রভৃতি।
এই সমস্ত গ্রন্থে রাজা রামমোহন রায় শাস্ত্রীয় যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে নারী শিক্ষা ও নারীজাতির উন্নতির জন্য তার প্রমাণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
5. ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা
রাজা রামমোহন রায়ের ১৮২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম সমাজের বিভিন্ন নিয়ম-কানুনগুলি নারী কল্যাণে সহায়তা করেছিল। এই ব্রাহ্মসমাজ পরবর্তীকালে নারী শিক্ষার (women Education) ও নারীদের স্বাধীন চিন্তা ভাবনাকে প্রসারিত করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।
রামমোহন রায়ের হাত ধরে পরবর্তীকালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কেশব সেন প্রমূখ ব্রাহ্মসমাজ ও তার কার্যাবলীকে সম্প্রসারিত করেন। তাই ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে রামমোহন রায় সে যুগে নারীদের শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।
6. সতীদাহ প্রথা রদ
তৎকালীন সময়ে সমাজে সবথেকে নিকৃষ্টতম প্রথা হল সতীদাহ প্রথা। অর্থাৎ স্বামী মারা গেলে মেয়েদেরকে স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যেতে হতো। নারীরা কতটা অবহেলিত, নিপীড়িত, শোষিত হলে যুগ যুগ ধরে এই প্রথা সমাজের রন্ধে প্রবেশ করেছিল।
অনেক প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেওরামমোহন রায় সর্বপ্রথম এই নিকৃষ্টতম প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন ও নারীদের এই অমানবিক প্রথা থেকে বের করে আনতে সচেষ্ট হন।
১৮২৯ সালের ৪ ই ডিসেম্বর গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ‘সপ্তদশ বিধি’ নামক আইন পাস করে সতিদাহ প্রথা রদ করেন। যার প্রধান কৃতিত্ব ছিল রাজা রামমোহন রায়ের। এটির মাধ্যমে রাজা রামমোহন রায় কতটা নারী শিক্ষার (Women Education) প্রতি সচেষ্ট ছিলেন ও নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।
আরোও পোস্ট পড়ুন – Click Here Now |
উপসংহার (Conclusion)
সর্বোপরি বলা যায় নারী শিক্ষা (women Education) বিস্তারের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায় ছিলেন আধুনিক ভারতের অন্যতম পথিকৃৎ। রাজা রামমোহন রায় চিন্তা ভাবনা সমাজের কুসংস্কার এর উপর বারবার আঘাত এনেছে। তাই তিনি যেভাবে শিক্ষা সংস্কার, সমাজ সংস্কার, ধর্ম সংস্কার প্রভৃতি দিকে বিশেষ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
রামমোহন রায় কুসংস্কার যুক্ত সমাজকে শিক্ষার আলোর মাধ্যমে জাগ্রত করতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। আবার বাংলা ভাষাকে তিনি প্রতিষ্ঠাও করেন।
সমাজের সর্বস্তরের উন্নতিকল্পে বিশেষ অবদানের জন্য ও কুসংস্কার মুক্ত ভারতবর্ষ গঠনে অগ্রসর হওয়ার জন্য রাজা রামমোহন রায়কে ‘ভারত পথিক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
রাজা রামমোহন রায়ের বিশেষ অবদান প্রসঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন – ” তিনি (রামমোহন) কি না করিয়াছিলেন? শিক্ষা বল, রাজনীতি বল, বঙ্গভাষা বল, বঙ্গসাহিত্য বল, ধর্ম বল, সমাজ বল, বঙ্গসমাজের যে-কোনো বিভাগে উত্তরোত্তর যতই উন্নতি হইতেছে, সে সকল কেবল তাঁহারই হস্তাক্ষর নতুন নতুন পৃষ্ঠায় উত্তরোত্তর পরিস্ফুততর হইয়া উঠিতেছে মাত্র”।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরোও বলেন – “Rammohan Roy inaugurated the Modern Age in India”.
তথ্যসূত্র (References)
- Ravi, S. Samuel, A Comprehensive Study of Education, Fourth Printing-May 2016, Delhi – 110092, ISBN – 978-81-203-4182-1
- Basabi Chakrabarti, Women’s Studies: Various Aspects. Urbi Prakashani 2014
- Betty Friedan. The Feminine Mystique. New York: Norton, 1963
- Geraldine Forbes, Women in Modern India Cambridge University Press, 1996.
- Mary E. John. “Women’s Studies in India: A reader” Penguin Books. 2008
- Mukherjee, K. K., Some Great Educators of the World, Das Gupta & Co. Pvt. Ltd, Calcutta
- Purkait, B. K., Great Educators, New Central Book Agency, London
- Vidya Ratna Taneja, Educational Thought and Practice, Sterling Publishers Pvt.Ltd
- Internet Sources
প্রশ্ন – ভারত পথিক কাকে বলা হয়?
উত্তর – রাজা রামমোহন রায়কে ভারত পথিক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
প্রশ্ন – রাজা রামমোহন রায়ের লেখা দুটি বইয়ের নাম লেখো।
উত্তর – রাজা রামমোহন রায়ের লেখা দুটি বইয়ের নাম হল – ‘কেন উপনিষদ’, ‘বেদান্তের চূর্ণক’ । এই দুটি গ্রন্থ ইংরেজি ভাষায় রচিত। এতে ভূমিকা লেখেন ডিগবি সাহেব। তিনি বিলেতে গিয়ে বইগুলির পুনর্মুদ্রন করেন।
প্রশ্ন – রাজা রামমোহন রায় কে রাজা উপাধি কে দেন?
উত্তর – রাজা রামমোহন রায়কে ‘রাজা’ উপাধি দিয়েছিলেন দিল্লির বাদশাহ দ্বিতীয় আকবর।
প্রশ্ন – সপ্তদশ বিধি কি?
উত্তর – সপ্তদশ বিধি হল সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ আইন। ১৮২৯ সালে গভর্নর জেনারেল বেন্টিঙ্ক ‘ সপ্তদশ বিধি’ নামক আইন পাস করে সতিদাহ প্রথা রদ করেন। যার প্রধান কৃতিত্ব ছিল রাজা রামমোহন রায়ের।
প্রশ্ন – সতীদাহ প্রথা কে কবে নিষিদ্ধ করেন?
উত্তর – গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্ক -এর কাছে রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করার আবেদন করেন। এই আবেদনের ভিত্তিতে ১৮২৯ সালে গভর্নর জেনারেল বেন্টিঙ্ক ‘ সপ্তদশ বিধি’ নামক আইন পাস করে সতিদাহ প্রথা চিরতরে নিষিদ্ধ করেন।
আরোও পড়ুন
- নারী শিক্ষায় বেগম রোকেয়ার অবদান | Contribution of Begum Rokeya on Women Education
- নারী শিক্ষায় বিবেকানন্দের অবদান | Vivekananda on Women’s Education
- নারী শিক্ষায় জাতীয় শিক্ষানীতি 1986 এর সুপারিশ | National Education Policy 1986 on Women Education
- নারী শিক্ষায় মুদালিয়র কমিশনের সুপারিশ | Mudaliar Commission on Women Education
- নারী শিক্ষায় কোঠারি কমিশনের সুপারিশ | Kothari Commission on Women’s Education
- নারী শিক্ষায় রাধাকৃষ্ণন কমিশনের সুপারিশ | Radhakrishnan Commission on Women’s Education
3 thoughts on “নারী শিক্ষায় রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা (Important Role of Rammohan Roy in Women Education)”