স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশ শাসনকালে বিভিন্ন মিশনারি যেমন – পর্তুগিজ, দিনেমার, খ্রিস্টান প্রভৃতি ভারতবর্ষে শিক্ষা বিস্তারে জন্য পদার্পণ করেন এবং মিশনারীরা নারী শিক্ষা (Missionaries’ Contribution to Women Education) বিস্তারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
স্বাধীনতার আগে ভারতবর্ষে শিক্ষার হার বিশেষত নারী শিক্ষার (Women’s Education) ক্ষেত্রে কোন অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয় না। ব্রিটিশদের পাশাপাশি বিভিন্ন মিশনারিরা নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
নারী শিক্ষা (Women’s Education)
সুদূর প্রাচীনকাল থেকে সমাজে নারী শিক্ষা অবহেলিত। অর্থাৎ স্বাধীনতার আগে ভারতবর্ষে নারী শিক্ষার বিস্তার সাধন খুব বেশি পরিলক্ষিত হয় না। ব্রিটিশ যুগে ইংরেজরা নারী শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে কিছুটা সচেষ্ট হয়েছিল। তাছাড়া রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ প্রমূখ মনীষীরা নারী শিক্ষায় অসামান্য অবদান রেখেছেন।
নারী শিক্ষা সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দ (Swami Vivekananda) বলেছিলেন – একটি ডানার সাহায্যে পাখি যেমন আকাশে উড়তে পারে না, তেমনি শুধুমাত্র পুরুষজাতি শিক্ষিত হলে সামাজিক সুস্থতা বজায় থাকে না। তাই নারীদের শিক্ষার মধ্য দিয়ে আগে তুলতে হবে। তবেই সমাজের কল্যাণ সাধন সম্ভবপর হবে।
Greek warrior Napoleon বলেছেন – “Give me a few educated mothers; I shall give you a heroic race.” অর্থাৎ “আমাকে কয়েকটা শিক্ষিত মা দাও; আমি তোমাকে বীরের জাতি দেব।”
নারী শিক্ষায় মিশনারীদের অবদান (Missionaries’ Contribution to Women Education)
২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনকালে বিভিন্ন মিশনারি ভারতবর্ষে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে পদার্পণ করেছে। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মিশনারিদের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়গুলিতে নারী শিক্ষার (Women’s Education) আয়োজন পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ তারা ভারতবর্ষে নারী শিক্ষা বিস্তারে কমবেশি সচেষ্টা হয়েছিলেন।
ভারতবর্ষে নারী শিক্ষার বিস্তারের বিভিন্ন মিশনারিদের অবদান পরিলক্ষিত হয়। এদের মধ্যে অন্যতম হলো ফরাসি, পর্তুগিজ, দিনেমার ও ক্রিস্টিয়ান মিশনারি। নারী শিক্ষায় এই সমস্ত মিশনারিদের অবদান (Missionaries’ Contribution to Women) উল্লেখ করা হল –
1. পর্তুগিজ মিশনারি
ইউরোপীয় বণিকদের মধ্যেই পর্তুগিজরা সর্বপ্রথম ভারতে আসেন। বাণিজ্য বিস্তার ও ধর্ম বিস্তার এর সাথে সাথে পর্তুগিজরা কয়েকটি বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করেন। পর্তুগিজ মিশনারিদের মধ্যে সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার এবং রবার্ট-ডি-নোবিলি ধর্ম প্রচার ও শিক্ষা প্রচারে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন।
পর্তুগিজ মিশনারীদের স্থাপিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে অন্যতম হল –
- মিশন ও গির্জা সংলগ্ন প্রাথমিক স্কুল
- ভারতীয় অনাথ বালক বালিকাদের জন্য প্রাথমিক স্কুল।
- উচ্চ শিক্ষার জন্য জেসুইট কলেজ (Jesuit College) স্থাপন প্রভৃতি।
তবে পর্তুগিজ মিশনারিদের মূল উদ্দেশ্য ছিল খ্রিস্টান ধর্মপ্রচার ও ভারতীয় কৃষ্টি, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে মুছে দিয়ে পর্তুগিজদের চিন্তাভাবনা ভারতীয়দের মধ্যে বিস্তার সাধন করা।
2. ফরাসি মিশনারী (The French Missionaries)
১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চন্দননগরে, পন্ডিচেরিতে তাদের আধিপত্য বিস্তার সাধন করেন। পর্তুগিজদের মতো ফরাসিরাও তাদের কর্মকেন্দ্রগুলিতে শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। এই সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ছেলেরা ও মেয়েরা উভয়ই শিক্ষাগ্রহণ করতে পারত। শিক্ষাদান হতো মূলত ফরাসি ভাষা এবং দেশীয় শিক্ষকদের জন্য আঞ্চলিক ভাষা।
প্রথমদিকে ফরাসি পাদ্রীরা খাদ্য, বস্ত্র ও বইপত্র প্রভৃতি বিনামূল্যে দান করতেন। ফলে গরিব ছাত্র-ছাত্রীরা এই সমস্ত জিনিসপত্রের জন্য শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হতেন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতেন।
3. দিনেমার মিশনারি (The Danes Missionaries)
দক্ষিণ ভারতের এবং কলকাতার কাছে শ্রীরামপুরে সপ্তদশ শতকে দিনেমারদের উপনিবেশ স্থাপিত হয়। দিনেমার মিশনারীরা তাদের মিশনারি কার্যকলাপের কারণে বিখ্যাত হয়েছিলেন।
দিনেমার মিশনারীদের মধ্যে জিগেনবাল্গ (Ziengenbalg) এবং প্লুশো (Plutschau) শিক্ষাবিস্তারের জন্য বিশেষভাবে চেষ্টা করেছিলেন। জিগেনবাল্গ (Ziengenbalg) ১৭১৩ সালে তামিল ভাষায় একটি ছাপাখানা, ১৭১৬ সালে শিক্ষক শিক্ষণ কেন্দ্র ও তামিল শিক্ষার্থীদের জন্য দুটি পৃথক অবৈতনিক স্কুল স্থাপন করেন।
আবার, মিশনারী সুলজ (Schultz) শিক্ষা প্রচেষ্টাকে অব্যহত রাখার জন্য পুরনো স্কুলগুলিকে সংগঠিত করেন ও আরও দুটি নতুন বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
যেখানে ছেলেমেয়েরা একইসঙ্গে পড়াশোনার সুযোগ সুবিধা লাভ করতেন। তাঁর কর্মদক্ষতায় খুশি হয়ে রবার্ট ক্লাইভ তাকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ করে। এরপর তিনি বাকি জীবনটা বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় উন্নতিতে উৎসর্গ করেন।
4. শ্রীরামপুর মিশন (Serampore Mission)
ভারতবর্ষে ইংরেজদের আগমনের সাথে সাথে খ্রিস্টান মিশনারীদের আগমন শুরু হয়। খ্রিস্টান মিশনারীরা মূলত খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষে আসেন। খ্রিস্টান মিশনারিরা দরিদ্র ভারতবর্ষে ধর্ম প্রচারের সাথে সাথে শিক্ষার প্রসারের সচেষ্ট হন। কারণ তারা বুঝে গিয়েছিলেন যে বুঝেছিলেন যে ভারতবর্ষে শিক্ষার বিস্তার না হলে ধর্ম বিস্তার কোনো রকমই সম্ভবপর নয়।
তাছাড়া বিভিন্ন কারণে ভারতবর্ষে শ্রীরামপুর মিশন শিক্ষার বিস্তারে বিশেষত নারী শিক্ষার (Women’s Education) বিস্তারে তাদের অবদান রেখেছেন।
মেয়েদের তথা নারীদের শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে কেরি সাহেব ১৮১৯ সালে শ্রীরামপুরে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তাছাড়া গরীব ও অনাথ মেয়েদের জন্য একটি অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে ছেলেমেয়ের একসঙ্গে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারত।
শ্রীরামপুর মিশনের উদ্যোগে ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি (Female Juvenile Society) স্থাপন করা হয়। এই বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার বিস্তার সাধন করা। তবে এটি পরবর্তীকালে ক্যালকাটা ব্যাপটিস্ট ফিমেল স্কুল সোসাইটি (Calcutta Baptist Female School Society) নামে পরিণত হয়।
নারী শিক্ষায় রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা | নারী শিক্ষায় বিদ্যাসাগরের ভূমিকা |
নারী শিক্ষা বিষয়ে ভক্তবৎসলম কমিটির সুপারিশ | নারী শিক্ষা সংক্রান্ত হংসরাজ মেহেতা কমিটির সুপারিশ |
নারী শিক্ষার বিস্তারে মিশনারিদের প্রতিষ্ঠিত স্কুলের তালিকা (Missionaries’ Contribution to Women Education – List of schools established)
ভারতে মিশনারিদের দ্বারা নারী শিক্ষার (Missionaries’ Contribution to Women) জন্য প্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলির তালিকা উল্লেখ করা হল –
নারী শিক্ষার (Women’s Education) জন্য প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের নাম | প্রতিষ্ঠার বছর |
হেজেস গার্লস স্কুল (প্রথম স্থাপিত মেয়েদের স্কুল) | ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ |
রেভারেন্ড মে দ্বারা প্রতিষ্ঠিত চুঁচুড়াতে মেয়েদের জন্য স্কুল। | ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ |
উইলিয়াম কেরি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামপুরে মেয়েদের বিদ্যালয় | ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দ |
ক্যালকাটা ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের জন্য স্কুল। | ১৮২০ খ্রিস্টাব্দ (মোট আঠারোটি স্কুল) |
মিস কুক দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের জন্য স্কুল। | ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে (চারটি) ও ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে (চারটি) |
মিস কুক দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সেন্ট্রাল স্কুল। এটি মহিলা শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুল | ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দ |
বোম্বেতে প্রথম স্থাপিত নারী শিক্ষার স্কুল | ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দ |
স্যার ড্রিংকওয়াটার বেথুন ও দক্ষিণারঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় -এর প্রচেষ্টায় হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় বা ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল | ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দ |
আরোও পোস্ট পড়ুন – Click Here Now
উপসংহার (Conclusion)
সর্বপরি বলা যায় ভারতবর্ষে নারী শিক্ষায় মিশনারীদের অবদান (Missionaries’ Contribution to Women Education) ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা মিশনারিরা সর্বপ্রথম ব্রিটিশ শাসনকালে নারী শিক্ষার বিস্তারে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে সচেষ্ট হয়েছিলেন একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
তথ্যসূত্র – Ravi, S. Samuel, A Comprehensive Study of Education, Fourth Printing-May 2016, Delhi – 110092, ISBN – 978-81-203-4182-1
প্রশ্ন – শ্রীরামপুর ত্রয়ী কারা?
উত্তর – উইলিয়াম কেরি, মার্শম্যান ও উইলিয়াম ওয়ার্ড এই তিনজন শ্রীরামপুরের শিক্ষা বিস্তারে বিশেষ অবদান রাখেন। তাই এদেরকে একসঙ্গে শ্রীরামপুর ত্রয়ী বলে আখ্যায়িত করা হয়।
প্রশ্ন – কত সালে লেডিস সোসাইটি ফর ফিমেল এডুকেশন স্থাপিত হয়েছিল?
উত্তর – ১৮২৪ সালে চার্চ মিশনারি সোসাইটির উদ্যোগে স্থাপিত হয়।
প্রশ্ন – হিন্দু ফিমেল স্কুল এর বর্তমান নাম কি?
উত্তর – হিন্দু ফিমেল স্কুলের বর্তমান নাম বেথুন স্কুল।
প্রশ্ন – Calcutta Female School কোন দুই শিক্ষাবিদের প্রচেষ্টায় কত সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
উত্তর – ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে সালে স্যার ড্রিংকওয়াটার বেথুন ও দক্ষিণারঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় -এর প্রচেষ্টায় হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় বা ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল।
প্রশ্ন – ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কবে, কোথায় প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর – দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় শ্রীমতী নাথীবাঈ দামোদর ঠাকরচি মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯১৬ সালে স্থাপন করেছিলেন।
আরোও পড়ুন
- নারী শিক্ষায় রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা (Important Role of Rammohan Roy in Women Education)
- নারী শিক্ষায় বিদ্যাসাগরের অবদান (Role of Vidyasagar in Women Education)
- নারী শিক্ষায় হংসরাজ মেহেতা কমিটির সুপারিশ (Hansraj Mehta Committee)
- Bhaktavatsalam Committee: নারী শিক্ষা বিষয়ে ভক্তবৎসলম কমিটির সুপারিশ
- Durgabai Deshmukh Committee: নারী শিক্ষায় দূর্গাবাঈ দেশমুখ কমিটির সুপারিশ
- নারী শিক্ষায় মিশনারীদের অবদান : Missionaries’ Contribution to Women Education
- নারী শিক্ষা ভূমিকা | নারী শিক্ষা বিস্তারের বাধাসমূহ (4 Main Constraints of Women Education)
- নারী শিক্ষা বিষয়ে ভারতীয় শিক্ষাবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি ভূমিকা (Indian Female Educationist)
- ভারতে নারী শিক্ষার ইতিহাস | History of Women’s Education
1 thought on “নারী শিক্ষায় মিশনারীদের অবদান : Missionaries’ Contribution to Women Education”