শিক্ষার বিস্তার ক্ষেত্রে স্বাধীন ভারতে গঠিত কোঠারি কমিশন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাই শিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও উন্নতি করনের ক্ষেত্রে কোঠারি কমিশনের সুপারিশ গুলি (Kothari Commission) বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাধীন ভারতের শিক্ষার উন্নতির জন্য গঠিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন (১৯৪৮-৪৯ সাল) এবং মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন (১৯৫২-৫৩ সাল) কেবলমাত্র শিক্ষা নির্দিষ্ট দিককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। তাই শিক্ষার সার্বিক উন্নতির জন্য কোঠারি কমিশন বা ভারতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়।
কোঠারি কমিশনের সুপারিশ | Recommendations of the Kothari Commission
স্বাধীনতার পর শিক্ষা ব্যবস্থার একটি সুপরিকল্পিত কাঠামো গঠন করার জন্য ভারত সরকার ১৯৬৪ সালে U.G.C এর চেয়ারম্যান ডঃ ডি. এস. কোঠারি নেতৃত্বে যে কমিশন গঠন করেন সেটি শিক্ষার ইতিহাসে কোঠারি কমিশন বা ভারতের শিক্ষা কমিশন নামে অধিক জনপ্রিয়।
দেশী ও বিদেশী মোট ১৭ জন সদস্যদের নিয়ে এই কমিশন গঠন করা হয়। এদের মধ্যে জে. পি. নায়ক, গোপালস্বামী, টি. সেন, পি. এন. কৃপাল প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
স্বাধীন ভারতের শিক্ষার ইতিহাসে এটি তৃতীয় শিক্ষা কমিশন যার রিপোর্ট ছিল 692 পৃষ্ঠার। এই কমিশন কাজের সুবিধার জন্য 12 টি টাস্ক ফোর্স তৈরি করেন এবং 7 টি ওয়ার্কিং গ্রুপ তৈরি করেন। যেগুলি শিক্ষার বিভিন্ন সমস্যার পর্যালোচনা করে দীর্ঘ রিপোর্ট পেশ করেন।
1. শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোঠারি কমিশনের সুপারিশ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কমিশনার মতে শিক্ষার লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য গুলি হল –
i) ভারতীয় সমাজে বর্তমান চাহিদা ও ভবিষ্যৎ প্রয়োজন মেটানোই হবে শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
ii) উৎপাদনমুখী জ্ঞান এবং দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করা
iii) শিক্ষার্থীদের চারিত্রিক বিকাশ সাধন করা
iv) পরিবর্তনশীল সমাজের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের অভিযোজন করানো প্রভৃতি।
2. শিক্ষার কাঠামো
শিক্ষা কাঠামো সংক্রান্ত কোঠারি কমিশনের সুপারিশ বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে। কমিশন প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষা স্তরের একটি সম্পূর্ণ কাঠামোর সুপারিশ করেন। কোঠারি কমিশনের শিক্ষার এই কাঠামোটি 10+2+3 নামে অধিক জনপ্রিয়।
কোঠারি কমিশনের প্রস্তাবিত শিক্ষার কাঠামোটি পাঁচটি ভাগে বিভক্ত। সেগুলি হল –
i) প্রাথমিক শিক্ষা (সাত বা আট বছরের),
ii) নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষা (দুই বা তিন বছরে),
iii) উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা (দুই বছরের),
iv) উচ্চ শিক্ষা বা স্নাতক ( তিন বছরের)
v) সর্বোচ্চ শিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা (দুই বছরের)
3. শিক্ষার পাঠক্রম
পাঠক্রম শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। পাঠক্রম ছাড়া শিক্ষাদান প্রক্রিয়া সুসম্পন্ন হতে পারে না। পাঠক্রম সম্পর্কে কমিশন বলেন – পাঠক্রমকে ব্যক্তির জীবনমুখী অভিজ্ঞতার সঙ্গে ও সামাজিক চাহিদার সাথে সমন্বয় করে গড়ে তুলতে হবে।
কোঠারি কমিশন শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন রকম পাঠক্রমের সুপারিশ করেছেন। সেগুলি হল –
i) প্রাথমিক স্তরের পাঠক্রম
প্রাথমিক স্তরের পাঠক্রম কে কমিশন দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। যথা – নিম্ন প্রাথমিক স্তর ও উচ্চ প্রাথমিক স্তর।
নিম্ন প্রাথমিক স্তরের পাঠক্রম সম্পর্কে কমিশন বলেন – এই স্তরে মাতৃভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা, গণিত, পরিবেশ পরিচিতি স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রভৃতি থাকবে।
উচ্চ প্রাথমিক স্তরের পাঠক্রম হিসেবে কমিশন বলেন – এই স্তরে পাঠক্রম হিসেবে দুটি ভাষা (মাতৃভাষা অথবা আঞ্চলিক ভাষা এবং হিন্দি অথবা ইংরেজি), গণিত, বিজ্ঞান, সমাজবিদ্যা (ইতিহাস, ভূগোল) , কর্ম অভিজ্ঞতা ও সমাজসেবা ও অন্তর্ভুক্ত হবে
ii) মাধ্যমিক স্তরের পাঠক্রম
মাধ্যমিক স্তরের পাঠক্রমকে কমিশন দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। যথা – নিম্ন মাধ্যমিক স্তর ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তর।
নিম্ন মাধ্যমিক স্তরের পাঠক্রমের মধ্যে থাকবে তিনটি ভাষা (মাতৃভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা, হিন্দি ও ইংরেজি), গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, কর্ম অভিজ্ঞতা ও সমাজসেবা প্রভৃতি।
উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পাঠক্রম হবে আধুনিক ভারতীয় ভাষা, আধুনিক বিদেশী ভাষা এবং প্রাচীন ভাষার মধ্যে যেকোনো দুটি, একটি অতিরিক্ত ভাষা, ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি, সমাজবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, গণিত, জীববিদ্যা প্রভৃতি।
4. শিক্ষার মাধ্যম
শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে কোঠারি কমিশনের সুপারিশ গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার মাধ্যম সম্পর্কে কোঠারি কমিশন মাতৃভাষার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
কমিশন শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ‘ত্রি ভাষা সূত্র’ এর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। কমিশন বলেন এই ত্রি ভাষা সূত্রটি হল – মাতৃভাষা কিংবা আঞ্চলিক ভাষা, হিন্দি ও ইংরেজি। অর্থাৎ তিনটি ভাষার সমন্বয়ই হল ত্রি ভাষা সূত্র।
আবার ভাষা শিক্ষা সম্পর্কে কমিশন বলেন পঞ্চম শ্রেণীর পূর্বে ইংরেজি ভাষা থাকবে না। অষ্টম শ্রেণীর পর থেকে ঐচ্ছিক ভাষা হিসেবে সংস্কৃত অন্তর্ভুক্তি করার কথা বলেছেন।
5. নারী শিক্ষা
নারী শিক্ষার উন্নতিকল্পে কোঠারি কমিশনের সুপারিশ। কমিশন বলেন পুরুষদের সঙ্গে একত্রে নারীরা কাজ করবে। তাই নারী শিক্ষার বিস্তারের জন্য কমিশনের সুপারিশ হল – মেয়েদের শিক্ষার জন্য বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদান করতে হবে এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
তাই কমিশন বলেন – নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা করে পুরুষদের মত নারীদের শিক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।
এছাড়া কমিশন সুপারিশ করেন – নারী শিক্ষার প্রসারে জন্য বিভিন্ন স্কলারশিপ এর ব্যবস্থা করতে হবে, আলাদা বিদ্যালয়ে স্থাপন করতে হবে, নারী পুরুষের বৈষম্য দূরীকরণ করতে হবে, মেয়েদের থাকার জন্য হোস্টেলের ব্যবস্থা করতে হবে, মেয়েদের শিক্ষায় সমসুযোগ দিতে হবে প্রভৃতি।
6. শিক্ষায় সমসুযোগ
কোঠারি কমিশন গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষের শিক্ষা ক্ষেত্রে সমসুযোগের সুপারিশ করেছেন। কমিশন বলেন – শিক্ষার লক্ষ্য হবে সকল স্তরের শিক্ষাকে অবৈতনিক করে তোলা এবং এর জন্য শিক্ষায় সকলকে সমান সুযোগ দান করা দরকার।
শিক্ষার সমান সুযোগের ক্ষেত্রে কমিশনের সুপারিশ গুলি হল –
i) জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সমান সুযোগ প্রদান।
ii) উচ্চতর মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত কোনো বেতন নেওয়া যাবে না।
iii) আর্থিক অবস্থা এবং পদমর্যাদা অনুযায়ী সকল শিশুদের জন্য শিক্ষার সর্বোত্তম সুযোগ প্রদান করা।
আরোও পোস্ট পড়ুন – Click Here Now |
উপসংহার (Conclusion)
সর্বোপরি বলা যায়, ভারতীয় শিক্ষার ইতিহাসে কোঠারি কমিশনের সুপারিশ গুলি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই কমিশন প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সমস্ত স্তরে শিক্ষার যাবতীয় উন্নতিকরণে ও বিস্তার সাধনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেন। তাই কোঠারি কমিশনের সুপারিশ গুলি শিক্ষাক্ষেত্রে অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
তথ্যসূত্র (References)
- Education in India-Past-Present-Future, Vol. I and II, J. P. Banerjee
- Landmarks in the History of Modern Indian Education, J. C. Aggarwal
- History of Education in India, Dr. R N Sharma and R K Sharma
- Report of Commissions – Radhakrishnan, Mudaliar, Kothari.
- National Policy on Education, 1986. Policy perspective.
- Internet Sources
প্রশ্ন – ভারতীয় শিক্ষা কমিশনের অপর নাম কি
উত্তর – ভারতীয় শিক্ষা কমিশনের অপর নাম হল কোঠারি কমিশন। এই কমিশন ১৯৬৪-৬৬ সালে ডক্টর ডি. এস. কোঠারির নেতৃত্বে গঠিত হয়।
প্রশ্ন – ভারতীয় শিক্ষা কমিশনের সভাপতি কে ছিলেন
উত্তর – ভারতীয় শিক্ষা কমিশনের সভাপতি ছিলেন U.G.C এর চেয়ারম্যান ডঃ ডি. এস. কোঠারি ।
প্রশ্ন – কোঠারি কমিশনের একজন ভারতীয় সদস্যের নাম
উত্তর – কোঠারি কমিশনের একজন ভারতীয় সদস্যের নাম হল – শ্রী পি. এন. কৃপাল।
প্রশ্ন – কোঠারি কমিশনের দুজন বিদেশি সদস্যের নাম
উত্তর – কোঠারি কমিশনের দুজন বিদেশি সদস্যের নাম হল – M. V. Elvin (UK) ও J. F. Mc. Dougall.
প্রশ্ন – কোঠারি কমিশন কবে গঠিত হয়
উত্তর – কোঠারি কমিশন ১৯৬৪ সালের ১৪ই জুলাই অধ্যাপক ডি. এস. কোঠারি নেতৃত্বে গঠিত হয়।
প্রশ্ন – কোঠারি কমিশনের সম্পাদক কে ছিলেন
উত্তর – ১৯৬৪-৬৬ সালে গঠিত কোঠারি কমিশনের সম্পাদক ছিলেন শ্রী জে. পি. নায়ক (Shri J.P.Naik)।
আরোও পড়ুন
- শিক্ষার অধিকার আইন 2009 | Right to Education Act | RTE Act 2009
- মনোযোগ কাকে বলে | শিক্ষাক্ষেত্রে মনোযোগের ভূমিকা | Attention in Psychology
- শিখন সঞ্চালনের তত্ত্ব | Theory of Transfer of Learning
- শিখন সঞ্চালনের প্রকারভেদ | Types of Transfer of Learning
- আগ্রহ কাকে বলে | শিক্ষাক্ষেত্রে আগ্রহের গুরুত্ব লেখ | Interest in Psychology
- শিখন সঞ্চালন কাকে বলে | শিখন সঞ্চালনের বৈশিষ্ট্য | Transfer of Learning