জাতীয় শিক্ষানীতি 1986 এর মূল সুপারিশ গুলি আলোচনা করো | National Education Policy 1986

স্বাধীন ভারতে সমগ্র জাতির শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য গঠিত অন্যতম হল জাতীয় শিক্ষানীতি। এই জাতীয় শিক্ষানীতি 1986 এর মূল সুপারিশ (National Education Policy) গুলি ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতিতে বিশেষ অবদান রয়েছে।

ভারতের শিক্ষা বিস্তারের জন্য গঠিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন (1948-49), মুদালিয়ার কমিশন (1953-53) এবং কোঠারি কমিশন (1964-66) এর পর অন্যতম হল জাতীয় শিক্ষা নীতি (National Education Policy)। এটি ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল।

জাতীয় শিক্ষানীতি 1986 এর মূল সুপারিশ | National Education Policy

1985 সালের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ভারতীয় শিক্ষা বিস্তারে একটি নতুন জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা বা শিক্ষানীতি প্রবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেন। এই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ১৯৮৬ সালের একুশে এপ্রিল জাতীয় শিক্ষানীতি বিশদ আলোচনার পর গৃহীত হয়।

এই জাতীয় শিক্ষানীতিতে মোট ১২টি অধ্যায় আছে এবং প্রথম ও শেষ অধ্যায় বাদে বাকি ১০টি অধ্যায় ভারতীয় শিক্ষার উন্নতি এবং গতি প্রকৃতি নিয়ে বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষা নীতি (National Education Policy) তে পরবর্তী কালে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিবর্তন আনা হয়। এদুটি ১৯৯০ সালে রামমূর্তি কমিটি এবং ১৯৯২ সালে জনার্দন রেড্ডি কমিটি নামে পরিচিত।

1. শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

শিক্ষার উন্নতির ক্ষেত্রে জাতীয় শিক্ষানীতির শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সংক্রান্ত সুপারিশ গুলি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় শিক্ষানীতি ১৯৮৬ এর শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য গুলি হল নিম্নলিখিত –

i) শিক্ষার গুণগত মানের উন্নয়ন করা

ii) জাতি, ধর্ম, বর্ণ, স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে সমস্ত শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা

iii) শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে পুনর্গঠন করা

iv) শিক্ষার মাধ্যমশিক্ষার্থীদের সর্বাঙ্গীন বিকাশ সাধন করা।

v) শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাতীয় সংহতির মনোভাব গড়ে তোলা।

vi) শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানসম্মত ভাবে শিক্ষাদানের মাধ্যমে বিজ্ঞানমনস্ক হতে সাহায্য করা।

2. শিক্ষার কাঠামো

শিক্ষা কাঠামো সংক্রান্ত জাতীয় শিক্ষানীতি 1986 এর মূল সুপারিশ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় শিক্ষানীতিতে সারাদেশে একই রকম শিক্ষা কাঠামোর সুপারিশ করা হয়।

এই শিক্ষানীতির সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষার কাঠামোটি হবে 10+2+3 হিসেবে। এই কাঠামোটি হল –

শিক্ষার স্তরবছর
নিম্ন প্রাথমিক স্তর5 বছরের
উচ্চ প্রাথমিক স্তর3 বছরের
নিম্ন মাধ্যমিক স্তর2 বছরের
উচ্চ মাধ্যমিক স্তর2 বছরের
উচ্চ শিক্ষা3 বছরে

অর্থাৎ দশম শ্রেণি পর্যন্ত নিম্ন প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক নিয়ে 10 বছর (5+3+2), উচ্চমাধ্যমিক 2 বছর এবং উচ্চশিক্ষা 3 বছরের হবে। তাই 10+2+3 এই তিন ভাগে শিক্ষা কাঠামোটি বিভক্ত হবে।

3. শিক্ষার পাঠক্রম

শিক্ষার পাঠক্রমের ক্ষেত্রে জাতীয় শিক্ষা নীতির (National Education Policy) সুপারিশ হল শিক্ষা কাঠামোর মতো শিক্ষার পাঠক্রমটিও সমগ্র দেশের জন্য একই প্রকৃতির হবে। অর্থাৎ সমগ্র দেশের জাতীয় শিক্ষানীতির জন্য জাতীয়ভাবে পাঠক্রমকে নির্ধারিত করতে হবে।

এই শিক্ষানীতি অনুযায়ী পাঠক্রম হবে এমন কতগুলি বিষয়কে কেন্দ্র করে যার মধ্যে কিছু মূল বিষয় থাকবে এবং কিছু ঐচ্ছিক বিষয় থাকবে। ঐচ্ছিক বিষয়গুলি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও পছন্দ অনুযায়ী নির্বাচন করতে পারবে।

তাই এই শিক্ষানীতি অনুযায়ী পাঠক্রমের মধ্যে স্বাধীনতার ইতিহাস, সংবিধান, সামাজিক বৈষম্য সম্পর্কিত জ্ঞান, সাংস্কৃতিক শিক্ষা প্রভৃতি অন্তর্ভুক্তির কথা বলেছেন।

4. ভাষা নীতি

কোঠারি কমিশনের (১৯৬৪-৬৬ সাল) ভাষা নীতি সংক্রান্ত সুপারিশ বা ত্রি ভাষা সূত্র সংক্রান্ত সুপারিশ জাতীয় শিক্ষা নীতিতেও অনুমোদিত হয়েছে। অর্থাৎ জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী ভাষা নীতি হল –

i) প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা।

ii) কোঠারি কমিশনের ত্রি ভাষা সূত্র অনুযায়ী শিক্ষা দিতে হবে।

iii) ভারতীয় সংস্কৃতি বজায় রাখার জন্য ও জাতীয় সংহতি বজায় রাখার জন্য শিক্ষা সংস্কৃত ভাষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হয়।

5. উচ্চশিক্ষার সর্বজনীনতা

জাতীয় শিক্ষানীতি 1986 এর মূল সুপারিশ গুলির মধ্যে উচ্চশিক্ষার সার্বজনীনতা একটি অন্যতম বিষয়। এই শিক্ষানীতিতে ভারতবর্ষের মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দানের কথা বলা হয়েছে। এই জন্য এই শিক্ষা নীতিতে নবোদয় বিদ্যালয় বা জেলায় জেলায় মডেল স্কুল স্থাপনের সুপারিশ করা হয়।

তাই গ্রাম অঞ্চলের বা শহর অঞ্চলের মেধাবী শিক্ষার্থীরা যাতে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে সে বিষয়ে এই শিক্ষা নিতে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

6. প্রতিবন্ধীদের জন্য শিক্ষা

জাতীয় শিক্ষানীতি 1986 এর মূল সুপারিশ গুলির মধ্যে অন্যতম হল প্রতিবন্ধীদের জন্য শিক্ষা প্রদান। অর্থাৎ প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে তাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে।

তাই জাতীয় শিক্ষানীতির সুপারিশ হল যে সমস্ত ছাত্রছাত্রীরা অল্প প্রতিবন্ধকতা যুক্ত তাদেরকে সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের পাশাপাশি পঠন-পাঠনের সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। এবং তাদেরকে ভবিষ্যতের জন্য উপযোগী করে গড়ে তুলতে বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব করতে হবে।

7. বয়স্ক শিক্ষা

শিক্ষার অন্যতম জাতীয় লক্ষ্য হল যারা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত তাদেরকে সুশিক্ষিত করা। অর্থাৎ জাতীয় শিক্ষানীতিতে বয়স্ক শিক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

এই শিক্ষা নীতিতে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করার জন্য বয়স্ক শিক্ষার মাধ্যমে তা করতে হবে। এই কাজের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার এবং পাশাপাশি সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে।

8. নারী শিক্ষা

দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক হল নারী। নারীরা শিক্ষিত না হলে সামাজিক উন্নতি তাই সম্ভব নয়। এইজন্য জাতীয় শিক্ষানীতিতে নারী শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

নারী শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করে জাতীয় শিক্ষা নীতিতে নারী শিক্ষার পাঠক্রম সম্পর্কে সুপারিশ করা হয় যে নারী শিক্ষার বিস্তার সাধনের জন্য পাঠক্রম এবং পাঠ্যপুস্তককে নতুন করে সাজাতে হবে। এর পাশাপাশি এই শিক্ষা নিতে নারী শিক্ষা বিস্তার সাধনের ক্ষেত্রে সামাজিক ব্যাধি হিসেবে বাল্যবিবাহ বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়।

9. অর্থপূর্ণ অংশীদারিত্ব

জাতীয় শিক্ষানীতির অন্যতম সুপারিশ হল অর্থপূর্ণ অংশীদারিত্ব। অর্থাৎ জাতীয় শিক্ষানীতিতে অর্থপূর্ণ অংশীদারিত্ব কথার অর্থ হল শিক্ষা ক্ষেত্রে যুগ্ম তালিকায় কেন্দ্রীয় রাজ্য সরকারের ভূমিকা কি হবে? তার পর্যালোচনা করা।

তাই শিক্ষাক্ষেত্রে অর্থপূর্ণ অংশীদারিত্ব এর মাধ্যমে বা কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে শিক্ষার উন্নতির কথা জাতীয় শিক্ষা নীতিতে সুপারিশ করা হয়েছে।

10. চাকুরী থেকে ডিগ্রীর বিচ্যুতিকরণ

জাতীয় শিক্ষানীতির একটি অন্যতম সুপারিশ হল চাকুরী থেকে ডিগ্রীর বিচ্যুতিকরণ। এর অর্থ হল চাকরির ক্ষেত্রে ডিগ্রির প্রয়োজনীয়তাকে কমানো বা বিচ্ছিন্ন করা। কারণ ডিগ্রির মাধ্যমে প্রকৃত শিক্ষা প্রতিফলিত হয় না।

তাই এই শিক্ষা-নীতিতে শিক্ষাকে কর্মের সঙ্গে সংযুক্ত করার মধ্য দিয়ে ডিগ্রিকে বিচ্ছিন্ন করার সুপারিশ করা হয়।

আরোও পোস্ট পড়ুন – Click Here Now

উপসংহার (Conclusion)

সর্বোপরি বলা যায়, ভারতের শিক্ষার উন্নতিকল্পে জাতীয় শিক্ষানীতির সুপারিশ গুলি বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে। কারণ এই শিক্ষানীতি অনুযায়ী সারা ভারতবর্ষে একই প্রকাশ শিক্ষার ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে আজও পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি। তবুও জাতীয় শিক্ষানীতি সুপারিশ গুলি বর্তমানে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

তথ্যসূত্র (References)

  • Education in India-Past-Present-Future, Vol. I and II, J. P. Banerjee
  • Landmarks in the History of Modern Indian Education, J. C. Aggarwal
  • History of Education in India, Dr. R N Sharma and R K Sharma
  • Report of Commissions – Radhakrishnan, Mudaliar, Kothari.
  • National Policy on Education, 1986. Policy perspective.
  • Internet Sources

প্রশ্ন – রামমূর্তি কমিটি কত সালে গঠিত হয়

উত্তর – জাতীয় শিক্ষানীতির সংশোধনের জন্য ১৯৯০ সালে রামমূর্তি কমিটি গঠিত হয়।

আরোও পড়ুন

Leave a Comment

close