শিশুর বিকাশের ক্ষেত্রে বিশেষ করে শিশুর সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে ভাইগটস্কির দীর্ঘদিনের গবেষণা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। শিশুর সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে ভাইগটস্কির সামাজিক বিকাশ তত্ত্ব বা ভাইগটস্কির সামাজিক নির্মিতিবাদ তত্ত্ব (Vygotsky’s Theory of Social Development) অন্যতম ভূমিকা গ্রহণ করে।
সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে ভাইগটস্কি দীর্ঘদিন গবেষণা করেন। প্রথম দিকে তার গবেষণার ফলাফল সম্পর্কে সংশয় থাকলেও পরবর্তীকালে বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক ভাইগটস্কির সামাজিক বিকাশ তত্ত্ব বা ভাইগটস্কির সামাজিক নির্মিতিবাদ তত্ত্ব কে স্বীকার করে নেন। এখানে ভাইগটস্কির তত্ত্বকে বিস্তারিত আলোকপাত করা হলো।
নির্মিতিবাদ কাকে বলে
নির্মিতিবাদ একটি তত্ত্ব যেখানে ব্যক্তি কিভাবে জ্ঞান অর্জন করে বা শেখে তার একটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি। অর্থাৎ পারিপার্শ্বিক সামাজিক পরিবেশ থেকে কিভাবে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন করে ও সেই জ্ঞানকে সংগঠিত করে তার একটি কাঠামো হলো নির্মিতিবাদ।
নির্মিতিবাদের তত্ত্বের মধ্যে ভাইগটস্কির সামাজিক নির্মিতিবাদ তত্ত্ব অধিক জনপ্রিয়। এই তত্ত্বের মূল বিষয় হল – শিক্ষার্থীরা বা শিশুরা কিভাবে সামাজিক পরিবেশের মধ্যে অভিযোজন করে ও জ্ঞান অর্জন সে বিষয়ে আলোকপাত করা।
ভাইগটস্কির সামাজিক বিকাশ তত্ত্ব বা ভাইগটস্কির সামাজিক নির্মিতিবাদ তত্ত্ব | Vygotsky’s Theory of Social Development
ভাইগটস্কি 1926 সাল থেকে 1934 সাল পর্যন্ত সামাজিক বিকাশের উপর দীর্ঘ গবেষণা করেন। প্রথম দিকে তার গবেষণা বিভিন্ন মনোবিদগণ ভ্রান্ত বলে মনে করলেও পরবর্তীকালে তার গবেষণা মনোবিদদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।
তবে দুঃখের বিষয় ভাইগটস্কির অকাল প্রয়াণ (মাত্র 37 বছর বয়স তিনি মারা যান) তার তত্ত্ব অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভাইগটস্কির সামাজিক বিকাশ তত্ত্ব শিশুর সামাজিক বিকাশ তথা শিক্ষায় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
ভাইগটস্কি তত্ত্বটিকে সম্পূর্ণভাবে সামাজিক বিকাশ তত্ত্ব বলা হয় না। তিনি পিঁয়াজের জ্ঞানমূলক বা প্রজ্ঞামূলক বিকাশকে সমর্থন করতেন। কিন্তু তিনি পিঁয়াজের মত প্রজ্ঞামূলক বিকাশের কোনো স্তরভিত্তিক বিকাশের কথা বলেন নি।
তবে ভাইগটস্কি জ্ঞানমূলক বিকাশের ক্ষেত্রে সামাজিক উপাদানকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন, সেই কারণে তার তথ্যকে সামাজিক কৃষ্টিমূলক তত্ত্ব ও বলা হয়ে থাকে।
ভাইগটস্কির তত্ত্বকে বিশ্লেষণ করলে শিশুর সামাজিক বিকাশের দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক পরিলক্ষিত হয়, যথা –
i) প্রাথমিক দিক, যা মূলত জৈবিক প্রকৃতি এবং
ii) উচ্চতর মানসিক প্রক্রিয়া, যার ভিত্তি হল সামাজিক কৃষ্টিমূলক উপাদান।
ভাইগটস্কির তত্ত্বকে বিশ্লেষণ করলে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক পরিলক্ষিত হয়, এগুলি হল –
1. অন্তঃস্থিকরণ (Internalization)
ভাইগটস্কি বলেন ব্যক্তির জ্ঞানমূলক বিকাশ তার সমাজে কৃষ্টিগত ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল। তাই ব্যক্তির বিকাশ শুরু হয় পরিবেশে (বিশেষত সামাজিক পরিবেশে) পরে তা ব্যক্তির মধ্যে প্রবেশ করে।
তিনি আরো বলেন – শিশু শুধুমাত্র বড়দের সঙ্গে ভাব বিনিময় করে তা নয়, সে নিজের সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গেও পারস্পরিকভাবে আদান-প্রদানের মাধ্যমে মিথস্ক্রিয়া করে থাকে। তার মধ্যে সামাজিক বিকাশ সহজে সম্পন্ন হয়।
2. বিকাশের সন্নিহিত অঞ্চল (Zone of Proximal Development)
ভাইগটস্কির মতে – সামাজিক বিকাশের সর্বোচ্চসীমা থাকে, কিন্তু তা চূড়ান্ত নয়। তারপরেও আরো কিছুদূর পর্যন্ত বিকাশের এবং শিখন এর ক্ষমতা থাকে।
অর্থাৎ ব্যক্তি প্রকৃত সীমার ওপরেও কিছু কাজ করতে পারে। এই কাজগুলি করার জন্য ব্যক্তির অন্য কোনো একজন দক্ষ ব্যক্তির সাহায্যের প্রয়োজন হয়। শিশুর বিকাশের এই সীমাটিকে বিকাশের সন্নিহিত অঞ্চল বলে।
তাই সর্বোচ্চ সীমার মধ্যে শিখন প্রক্রিয়াকে স্থির না রেখে, দেখা উচিত শিশুর ক্ষমতা কতদূর যেতে পারে। এই প্রত্যাশিত অঞ্চলকে ভাইগটস্কি বিকাশের সন্নিহিত অঞ্চল বা বলয় হিসাবে চিহ্নিতকরণ করেছেন।
3. Scaffolding (প্রয়োজনীয় সাহায্য বা সহায়তা দান বা মাচা নির্মাণ)
ভাইগটস্কির Scaffolding (প্রয়োজনীয় সাহায্য বা সহায়তা দান বা মাচা নির্মাণ) এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। ভাইগটস্কি শিশুর বিকাশের ক্ষেত্রে Scaffolding কথাটি ব্যবহার করেন। তিনি বলেন – শিখন ও সমস্যা সমাধানের জন্য শিক্ষার্থীকে যে প্রয়োজনীয় সাহায্য করা হয় সেই সাহায্যই হল Scaffolding.
তাই বলা যায়, কিছু সর্বাঙ্গীন বিকাশ সাধনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সাহায্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীরা যখন নিজে নিজে কোন কাজ করতে পারে না তখনই তার এই প্রয়োজনীয় সাহায্য প্রয়োজন হয়। এটি মূলত শিক্ষার্থীদের বিকাশের সন্নিহিত অঞ্চল বা ZPD অন্তর্ভুক্ত কাজ বা সমস্যার জন্য এই ধরনের সাহায্যের প্রয়োজন। অপেক্ষাকৃত দক্ষ ব্যক্তির সাহায্যে শিক্ষার্থীদের এই দক্ষতা বৃদ্ধি জন্য সাহায্য প্রদান করা প্রয়োজন।
4. ভাষা ও চিন্তন
ভাইগটস্কির মতে – শিশুরা শুধুমাত্র সামাজিক যোগাযোগের জন্য ভাষা ব্যবহার করে তা নয়, তাদের ভাষার বিকাশ হয় তাদের আচরণ ও চিন্তা প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। তাছাড়া শিশুরা নিজেদের কাজ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নিজেরা নিজেদের সাথে কথা বলে বা যোগাযোগ করে। এই কথোপকথন আত্মকথন নামে পরিচিত।
তাছাড়া তিনি বলেন – আশা ও চিন্তন প্রথমে স্বাধীনভাবে হয়ে থাকে এবং পরবর্তীকালে এর বিকাশ সম্মিলিতভাবে ঘটে। অর্থাৎ ব্যক্তি প্রথমে সমাজের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে ভাষার মাধ্যমে যোগাযোগ করে ও পরবর্তীকালে সে চিন্তন শুরু করে।
আরোও পোস্ট পড়ুন – Click Here Now |
ভাইগটস্কি তত্ত্বের শিক্ষাগত তাৎপর্য
ভাইগটস্কি তত্ত্বের শিক্ষাগত তাৎপর্য গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ আধুনিক শিক্ষায় এই তত্ত্বের প্রভাব গুলি হল –
i) ভাইগটস্কি তত্ত্ব অনুযায়ী শিশুর সন্নিহিত বিকাশ অঞ্চলের কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। ফলে শিশুর জ্ঞানলাভ আরোও বেশি করে সম্ভব হয়। তাই সেই অনুযায়ী পাঠক্রম ও শিখন পরিকল্পনা করা প্রয়োজন।
ii) শিক্ষার্থীদের সহায়তা দানের ক্ষেত্রে বা প্রয়োজনীয় সহায়তা দানের তত্ত্ব শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা গতানুগতিক শিখন এর চেয়ে আরো বেশি শিখন দক্ষতা অর্জন করতে পারে।
iii) জ্ঞানমূলক বিকাশের ক্ষেত্রে ভাষার বিকাশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভাইগটস্কির তত্ত্বে ভাষা একটি অন্যতম উপাদান হিসাবে দেখানো হয়েছে। সুতরাং শিক্ষক শিক্ষার্থীরা শিক্ষার্থীদের আত্মকথা নিয়ে উৎসাহিত করার মাধ্যমে ভাষার বিকাশের সহায়তা করবেন।
iv) প্রত্যেকটি শিশুর তার সামাজিক ও কৃষ্টিগত অভিজ্ঞতা নিয়ে বিদ্যালয়ে আসে এগুলি সবই এই তত্ত্বের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। যা পাঠক্রম বিকাশের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রয়োজন। শিক্ষার্থীর সামাজিক ও কৃষ্টিগত দিকটি পাঠক্রমের মধ্যে উল্লেখ থাকতে হয়। অর্থাৎ পাঠক্রম হবে শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক।
উপসংহার (Conclusion)
পরিশেষে বলা যায়, ভাইগটস্কির সামাজিক বিকাশের তত্ত্ব বা ভাইগটস্কির সামাজিক নির্মিতিবাদ তত্ত্ব (Vygotsky’s Theory of Social Development) আধুনিক শিক্ষায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া শিশুর সামাজিক বিকাশ কিভাবে সম্পন্ন হয় তাই এই তত্ত্বের মাধ্যমে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়।
তথ্যসূত্র (Reference)
- A. Woolfolk – Educational Psychology – Pearson Education
- J. W. Santrock – Educational Psychology – Mc Gray Hill
- J. C. Aggarwal – Essentials of Educational Psychology – Vikas publisher
- S. K. Mangal – Essentials of Educational Psychology – PHI Ltd.
- S. K. Mangal – Advanced Educational Psychology – PHI Ltd
- S. S. Chauhan – Advanced Educational Psychology – Vikas publisher
- E. B. Hurlock – Child Development – Anmol Publication Pvt. Ltd
- L. E. Berk – Child Development – PHI Ltd
- Internet Sources
প্রশ্ন – ভাইগটস্কির সামাজিক তত্ত্ব কি?
উত্তর – ভাইগটস্কির সামাজিক তত্ত্ব হল শিশুর জ্ঞানমূলক বিকাশের পাশাপাশি সামাজিক বিকাশ কিভাবে সম্পন্ন হয় তার বিস্তারিত তত্ত্ব। তাছাড়া তবে ভাইগটস্কি জ্ঞানমূলক বিকাশের ক্ষেত্রে সামাজিক উপাদানকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন, সেই কারণে তার তথ্যকে সামাজিক কৃষ্টিমূলক তত্ত্ব ও বলা হয়ে থাকে।
প্রশ্ন – ভাইগটস্কির ভারা শিখন তত্ত্ব কি?
উত্তর – ভাইগটস্কির ভারা শিখন তত্ত্ব – শিখন ও সমস্যা সমাধানের জন্য শিক্ষার্থীকে যে প্রয়োজনীয় সাহায্য করা হয় সেই সাহায্যই হল Scaffolding বা ভারা শিখন তত্ত্ব।
প্রশ্ন – ভাইগটস্কির তত্ত্বের উপযোগিতা?
উত্তর – ভাইগটস্কির তত্ত্বের উপযোগিতা হল – শিশুর যথাযথ ভাষা বিকাশ, শিশুর সামাজিক বিকাশ অর্থাৎ মানসিক বিকাশের পাশাপাশি শিশুর সামাজিক বিকাশ সাধন, চিন্তন ক্ষমতা বৃদ্ধি প্রকৃতি।
প্রশ্ন – সামাজিক নির্মিতিবাদ এর প্রবক্তা
উত্তর – সামাজিক নির্মিতিবাদ এর প্রবক্তা হলেন বিশিষ্ট মনোবিদ ভাইগটস্কি।
প্রশ্ন – বিকাশের সন্নিহিত অঞ্চল কাকে বলে
উত্তর – ভাইগটস্কি কিশোর সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে কোনো কিছুকে সর্বোচ্চ সীমা বা চূড়ান্ত সীমা হিসেবে অভিহিত করেননি। তিনি বলেছেন – সর্বোচ্চ সীমার মধ্যে শিখন প্রক্রিয়াকে স্থির না রেখে দেখা উচিত শিশুর বিকাশ বা ক্ষমতা কতদূর যেতে পারে। এই প্রত্যাশিত অঞ্চলকে বিকাশের সন্নিহিত অঞ্চল বলে।
প্রশ্ন – ZPD এর পুরো নাম কি
উত্তর – ZPD এর পুরো নাম হল – Zone of Proximal Development বা বিকাশের সন্নিহিত অঞ্চল।
আরোও পড়ুন
- শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশ | বৃদ্ধি ও বিকাশের মধ্যে পার্থক্য | 10 Difference Between Growth and Development
- বৃদ্ধি কাকে বলে | বৃদ্ধির বৈশিষ্ট্য | 4 Definition of Growth
- বৃদ্ধি ও বিকাশের বৈশিষ্ট্য | Characteristics of Growth and Development
- জীবন বিকাশের বিভিন্ন স্তর গুলি আলোচনা কর | 4 Stages of Human Development
- শিখন কাকে বলে | শিখনের বৈশিষ্ট্য | 5 Definition and Characteristics of Learning
- ব্যক্তিত্ব কাকে বলে | ভালো ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য (5 Definition and Characteristics of Personality)