শিক্ষাক্ষেত্রে পাঠক্রম হল একটি অন্যতম উপাদান। শিক্ষায় বিভিন্ন ধরনের পাঠক্রমের মধ্যে শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পাঠক্রম (Child Centered Curriculum) আধুনিককালে অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
শিক্ষাবিদ রুশোর প্রবর্তিত শিশু কেন্দ্রিক শিক্ষার বিস্তার সাধনের সাথে সাথে শিক্ষায় পাঠক্রমকে শিশুর চাহিদা, আগ্রহ ও সামর্থ্য অনুযায়ী নির্ধারিত করার উপর অতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তাই বর্তমানে পাঠক্রমের মধ্যে আধুনিকতম সংযোজন হল শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পাঠক্রম।
শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পাঠক্রম কাকে বলে
আধুনিক শিক্ষা শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা। শিক্ষার প্রধান ও অন্যতম উপাদান হল শিশু বা শিক্ষার্থী। শিশুর চাহিদা, আগ্রহ, প্রবণতা, সামর্থ কবিতাটির উপর গুরুত্ব আরোপ করে শিক্ষা দান কার্য সম্পন্ন হবে। এক্ষেত্রে পাঠক্রম একটি শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক যা শিশুকে বিকাশ উপযোগী করে তোলে।
সাধারণভাবে শিক্ষার পাঠক্রম শিশুদের আগ্রহ, প্রবণতা, ক্ষমতা ও সামর্থ্য অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়, তাকে শিশু কেন্দ্রিক পাঠক্রম বলে। এই পাঠক্রমে শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকে।
তাই শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পাঠক্রমে শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে। ফলে শিক্ষার্থীদের সর্বাঙ্গীন বিকাশ সাধন হয়।
পাঠক্রমের এই নমনীয়তা জন্য শিক্ষার্থীরা তাদের ক্ষমতা অনুযায়ী স্বাধীনভাবে পাঠক্রম নির্বাচন করতে পারে। ফলে এই পাঠক্রমের বাস্তবায়ন দ্রুত সম্ভব হয়।
শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পাঠক্রমের বৈশিষ্ট্য | Characteristics of Child Centered Curriculum
শিক্ষার্থী কেন্দ্রে পাঠক্রম শিশুকে বা শিক্ষার্থীদের কেন্দ্র করে রচিত হয়। শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পাঠক্রমের বৈশিষ্ট্য যে সমস্ত দিক থেকে পরিলক্ষিত হয়, সেগুলি হল নিম্নলিখিত –
1. নির্দিষ্ট লক্ষ্যমুখী
শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পাঠক্রম নির্দিষ্ট লক্ষ্যমুখী বা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমুখী প্রক্রিয়া। এই পাঠক্রমের লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীদের সর্বাঙ্গীন বিকাশ সাধন করা। তাই শিক্ষার্থীরা কিভাবে তাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাবে সে বিষয়ে শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পাঠক্রম শিক্ষার্থীদের বিশেষভাবে সাহায্য করে থাকে।
এছাড়া শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পাঠক্রম বাস্তবায়ন হয়।
2. নমনীয়তা
শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পাঠক্রমের বৈশিষ্ট্য হল নমনীয়তা। অর্থাৎ এই পাঠক্রম শিক্ষার্থীদের আগ্রহ, প্রবণতা, সামর্থ প্রভৃতির উপর গুরুত্ব আরোপ করে নির্ধারিত হয়।
3. বৈচিত্র্যধর্মী
শিক্ষার্থীদের কেন্দ্রে পাঠক্রম শিশুদের জন্য রচিত হয় তাই এটি বৈচিত্র্যধর্মী প্রকৃতির হয়ে থাকে। তাই শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পাঠক্রমের বৈশিষ্ট্য গুলির মধ্যে অন্যতম হল, বৈচিত্র্যতা।
এখানে ছাত্রবৈচিত্র্য, কৃষ্টিগত পার্থক্য, ধর্মীয় পার্থক্য, পরিবেশগত বৈচিত্র্য প্রভৃতির উপর গুরুত্ব আরোপ করে পাঠক্রমের মধ্যে বিভিন্ন বৈচিত্র্যধর্মী বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাই শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত বৈষম্য ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে বৈচিত্রতা রয়েছে তার প্রতিফলন পাঠক্রমের মধ্যে ঘটে থাকে।
4. বাস্তব জীবনের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক
শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পাঠক্রম বাস্তব জীবনের সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতার দিকটি উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কারণ শিক্ষার লক্ষ্য হলো শিশুকে বাস্তব জীবনের সঙ্গে অভিযোজন করানো। তাই এই লক্ষ্যকে পরিপূরণ করার জন্য শিক্ষার পাঠক্রমকে বাস্তবসম্মত করে গড়ে তোলা হয়।
তাছাড়া শিশুরা দৈনন্দিন সামাজিক জীবন, পরিবেশ, ও নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়। যাতে এই সমস্ত সমস্যা সহজে সমাধান করা যায় সেই জন্য পাঠক্রমের মধ্যে বাস্তব বিষয়সম্মত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়। সুতরাং শিক্ষার্থীরা যাতে তাদের নিজেদের জীবন থেকে অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে এ বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
5. মনোবিজ্ঞান সম্মত
শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পাঠক্রমের বৈশিষ্ট্য হল এটি মনোবিজ্ঞান সম্মত নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। কারণ আধুনিক শিক্ষা শিশুর মানসিক বিকাশের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। তাই শিশুর মানসিক বিকাশের উপযোগী বিভিন্ন বিষয় এই শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পাঠক্রমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে।
এগুলি ছাড়াও শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পাঠক্রমের বৈশিষ্ট্য গুলি হল –
i) সম্প্রসারণ যুক্ত। অর্থাৎ এখানে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণ করে থাকে।
ii) নির্মিতিবাদ যুক্ত। অর্থাৎ শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পাঠক্রম নির্মিতিবাদ দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী রচনা ও কার্যকর করা হয়ে থাকে।
iii) বিকাশ উপযোগী। অর্থাৎ শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পাঠক্রম বিকাশের উপযোগী পাঠক্রম।
শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পাঠক্রম শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্যের সঙ্গে কতখানি সম্পর্কিত
শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পাঠক্রম শিশুর উপর অতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এটি শিক্ষার ব্যক্তি তান্ত্রিক লক্ষ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়। কারণ এখানে শিশুর ব্যক্তিগত বিকাশ সাধনের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
ব্যক্তিতান্ত্রিক মতবাদ অনুযায়ী – ব্যক্তির সর্বাঙ্গীন বিকাশ সাধনই হলো শিক্ষার একমাত্র হল। তাই ব্যক্তিগত বিকাশ সাধনের উদ্দেশ্যে শিক্ষার পাঠক্রম নির্ধারিত হয়ে থাকে। যা শিশু কেন্দ্রিক শিক্ষার সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক শিক্ষার পাঠক্রমের সঙ্গে ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্যগুলির সম্পর্ক হল –
i) ব্যক্তিগত উন্নয়ন
ii) স্বশিক্ষা ও আত্মনির্ভরতা
iii) সৃজনশীলতার বিকাশ
iv) সমাজিক ও যোগাযোগ দক্ষতার বিকাশ
v) ব্যক্তিগত ও পেশাগত লক্ষ্য অর্জন প্রভৃতি।
সুতরাং ব্যক্তিতান্ত্রিক মতবাদের অন্যতম সমর্থক শিক্ষাবিদ রুশো শিশুর শিক্ষার ও তার বিকাশ সাধনের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। ফলে শিক্ষা ব্যক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে শিক্ষার লক্ষ্যকে পূর্ণ রূপদান করা সম্ভব হয়।
উপসংহার (Conclusion)
পরিশেষে বলা যায়, শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পাঠক্রম (Child Centered Curriculum) শিক্ষার্থীদের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের উপযোগী। এই পাঠক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যেমন তাদের আগ্রহ ও প্রবণতা অনুযায়ী পাঠক্রম নির্বাচন করতে পারে তেমনি এই পাঠক্রমের ফলে তারা বাস্তব জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে বা অংশগ্রহণ করতে পারে। তাই আধুনিককালে শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পাঠক্রমের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে।
তথ্যসূত্র (References)
- Aggarwal, J. C., Theory and Principles of Education. 13th Ed. Vikas Publishing House Pvt. Ltd.
- V.R. Taneja, Educational Thoughts & Practice. Sterling Publication Pvt. Ltd. New Delhi
- Nayak, B.K, Text Book of Foundation of Education. Cuttack, Odisha: KitabMhal
- Ravi, S. Samuel, A Comprehensive Study of Education, Fourth Printing-May 2016, Delhi – 110092, ISBN – 978-81-203-4182-1,
- Internet sources
প্রশ্ন – শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পাঠক্রম বলতে কী বোঝো?
উত্তর – যে পাঠক্রমের মধ্যে শিক্ষার্থীদের চাহিদা, আগ্রহ, প্রবণতা, সামর্থ্য প্রভৃতির উপর গুরুত্ব আরোপ করে শিক্ষার্থীদের সর্বাঙ্গীন বিকাশের উপযোগী পাঠক্রম নির্ধারণ করা হয় তাকে শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পাঠক্রম বলে।
শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পাঠক্রমে কোন দক্ষতা, জ্ঞান ও মূল্যবোধের উপর জোর দেওয়া হয়?
উত্তর – শিক্ষার্থী কেন্দ্রে পাঠক্রমে শিক্ষার্থীদের সামাজিক গুনাবলী দক্ষতা, অভিযোজন ক্ষমতা, মূল্যবোধের বিকাশ ও নৈতিকতার উপর অতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পাঠ্যক্রমে নিচের কোনটির গুরুত্ব বেশি?
a) শিক্ষক, b) শিশু, c) পাঠ্যক্রম, d) বিদ্যালয়
উত্তর – শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পাঠ্যক্রমে শিশুর গুরুত্ব বেশি।
আরোও পড়ুন
- পাঠক্রম কাকে বলে | পাঠক্রমের 10 টি সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য | Definition of Curriculum
- পাঠক্রমের প্রকারভেদ | Various Types of Curriculum
- পাঠক্রম রচনার নীতি গুলি আলোচনা করো | Principles of Curriculum Design
- পাঠক্রম ও পাঠ্যসূচির পার্থক্য | Curriculum and Syllabus
- সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী কাকে বলে | সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য | Co Curricular Activities
- সহপাঠক্রমিক কার্যাবলীর প্রকারভেদ | Types of Co Curricular Activities
1 thought on “শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পাঠক্রম কাকে বলে | এই পাঠক্রমের বৈশিষ্ট্য | Child Centered Curriculum”