রাজা রামমোহন রায় রচনা (Raja Rammohan Roy)

প্রাচীন ঘুন ধরা সমাজের উন্নতিকল্পে তথা সমাজ সংস্কারক হিসেবে রাজা রামমোহন রায় (Raja Rammohan Roy)-এর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। তাঁর হাত ধরে সমাজে নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল।

তৎকালীন সমাজব্যবস্থা ছিল বিভিন্ন কুসংস্কারের নিমজ্জিত। যেমন – গঙ্গায় সন্তান বিসর্জন, সতীদাহ প্রথা, নারীদের রক্ষণশীলতা বা শিক্ষার ব্যবস্থা না করা প্রভৃতি। এই অন্ধকারচ্ছন্ন এবং কুসংস্কার যুক্ত সমাজের সংস্কারের মূল কান্ডারী ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। এখানে রাজা রামমোহন রায়ের সমাজ সংস্কারক ও শিক্ষা সংস্কার ছাড়াও আরো যে সমস্ত দিকে চিন্তাধারা যে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তা একটি রচনাকারে আলোচনা করা হল।

রামমোহন রায়ের জীবনী (Biography of Rammohan Roy)

ঊনবিংশ শতকের প্রধান প্রাণপুরুষ তথা সমাজ সংস্কারক ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। তিনি 1772 সালের 22শে মে হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামে ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতার নাম ছিল রামকান্ত রায় এবং মা ছিলেন তারিনী দেবী।ছোটবেলা থেকে রাজা রামমোহন রায় খুব মেধাবী ছিলেন।

রামমোহন রায় পাটনা ও কাশিতে গিয়ে সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি ভাষায় উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন। তিনি মোট 10 টি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সংস্কৃত, ফারসি, আরবি, বাংলা, ইংরেজি, ল্যাটিন প্রভৃতি।

রাজা রামমোহন রায় হিন্দু ধর্মের গোড়ামী ও কুসংস্কারের প্রতি প্রতিবাদ করার পিতার সঙ্গে তার মনোমালিন্য তৈরি হয়। এর ফলে তিনি গৃহ ত্যাগ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ান। 1803 সালে পিতার মৃত্যু হলে তিনি বাড়িতে ফিরে আসেন। 1804 সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীকালে রামমোহন রায় বিভিন্ন সমাজ সংস্কারের কাজে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেন। 1833 সালের 27 শে সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের বিস্টল শহরে এই মহামানবের জীবনাবসান হয় এবং সেখানেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়।

রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা (Role of Raja Rammohan Roy)

রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা সমাজের বিভিন্ন দিকে বর্তমান। তিনি সমাজকে আধুনিক ও প্রগতিশীল হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। তাই তাকে নবজাগরণের অন্যতম পথিক হিসেবে গণ্য করা হয়। আবার রাজা রামমোহন রায়কে ভারত পথিক ও হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। সমাজের বিভিন্ন দিকের উন্নতিকল্পে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা গুলি হল –

শিক্ষার প্রসার ঘটানো

ভারতীয় সমাজে শিক্ষার প্রসার ঘটনার ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা অনবদ্য। তিনি শিক্ষার মাধ্যমে ভারতীয় সমাজকে কুসংস্কার মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তাই রাজা রামমোহনের মতে শিক্ষার লক্ষ্য হবে –

  • জাগতিক এবং সমাজকল্যাণমূলক,
  • শিক্ষার মাধ্যমে কুসংস্কার দূর করা,
  • যুক্তিবাদী মানসিকতা ও চিন্তাভাবনা গঠন,
  • ব্যক্তির মনের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন ও উন্নয়ন প্রভৃতি

নারী শিক্ষার প্রসার

তৎকালীন ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের শিক্ষার কোন অধিকার ছিল না। ফলে নারীরা শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। তাই রাজা রামমোহন রায়ের অন্যতম ভূমিকা হল নারী শিক্ষার প্রসার ঘটানো।

নারী শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন। নারী শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে তিনি হিন্দু শাস্ত্রের বিভিন্ন অংশকে বিশ্লেষণ করে সমাজকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। এদিক থেকে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা ছিল অনবদ্য।

সতীদাহ প্রথা রদ

রামমোহন রায় তৎকালীন ভারতীয় প্রাচীন নিষ্ঠুর সতীদাহ প্রথার অবসান ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল। হিন্দু সমাজের এই নিষ্ঠুর প্রথাকে তিনি বন্ধ করার জন্য বিশেষ উদ্যোগী হয়েছিলেন। ফলে তারই সর্বত সহযোগিতায় 1829 সালে লর্ড বেন্টিংক সতীদাহ প্রথা আইন করে বন্ধ করেন। তাই সতীদাহ প্রথা রদ করার মাধ্যমে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে গিয়েছিল।

পত্রপত্রিকা প্রকাশ

রাজা রামমোহন রায় বিভিন্ন পত্রপত্রিকার মাধ্যমে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার সমালোচনা করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন আধুনিক চেতনা সম্পন্ন সমাজ গঠন করতে। এর জন্য তিনি বাংলা ভাষায় ‘সংবাদ কৌমুদী’ এবং ফারসি ভাষায় ‘মিরাৎ-উল-আকবর’ নামক দুটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। এবং এখানে তিনি বিভিন্ন বিতর্কমূলক ও সমালোচনামূলক প্রবন্ধ নিয়মিত প্রকাশ করতেন।

বিদ্যালয় স্থাপন

শিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায় বিভিন্ন বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এর মধ্যে ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে ‘ অ্যাংলো হিন্দু স্কুল’ স্থাপন করে। তাছাড়া শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান করার জন্য বিভিন্ন বিদ্যালয় স্থাপন করেন।

বাংলা সাহিত্যের উন্নয়ন

শিক্ষার প্রচার ও প্রসারের জন্য তিনি বাংলা সাহিত্যের উন্নয়নের প্রতি মনোযোগী হন। তিনি বিভিন্ন গ্রন্থ অনুবাদ ও রচনা করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – বেদ-বেদান্ত, উপনিষদের অনুবাদ, এবং কুসংস্কারের প্রতি লেখা গৌড়ীয় ব্যাকরণ অন্যতম।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষার সমন্বয়

পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা ছিল অনবদ্য। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষার মধ্যে সমন্বয় সাধনের কথা বলেন। এর ফলে একদিকে যেমন ভারতীয় প্রাচীন সংস্কৃতির সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে, অপরদিকে তেমনি পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষা হবে বিজ্ঞান সম্মত।

ইংরেজি ভাষার চর্চা ও প্রসার

পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায় ইংরেজি ভাষার চর্চা ও প্রসারের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি দেখেছিলেন ইউরোপের নবজাগরণের প্রধান দিক হল ইংরেজি শিক্ষা। এইজন্য 1823 সালে রামমোহন লর্ড আমহাস্টের কাছে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের জন্য আর্থিক সাহায্য চেয়েছিলেন।

বিজ্ঞান চেতনার মনোভাব গঠন

রামমোহন রায় পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান চর্চার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন যে ভারতীয়রা গণিত, দর্শন, রসায়ন প্রভৃতি বিজ্ঞানের অন্যতম শাখা গুলির প্রতি আগ্রহী হবে। তাই তিনি ভারতীয়দের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা প্রসারের জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন।

আরোও পোস্ট পড়ুন – Click Here Now

উপসংহার (Conclusion)

সর্বোপরি বলা যায়, সমাজের সর্বস্তরের উন্নতিকল্পে বিশেষ অবদানের জন্য ও কুসংস্কার মুক্ত ভারতবর্ষ গঠনে অগ্রসর হওয়ার জন্য রাজা রামমোহন রায়কে ‘ভারত পথিক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

রাজা রামমোহন রায় প্রসঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন – ” তিনি (রামমোহন) কি না করিয়াছিলেন? শিক্ষা বল, রাজনীতি বল, বঙ্গভাষা বল, বঙ্গসাহিত্য বল, ধর্ম বল, সমাজ বল, বঙ্গসমাজের যে-কোনো বিভাগে উত্তরোত্তর যতই উন্নতি হইতেছে, সে সকল কেবল তাঁহারই হস্তাক্ষর নতুন নতুন পৃষ্ঠায় উত্তরোত্তর পরিস্ফুততর হইয়া উঠিতেছে মাত্র”।

তথ্যসূত্র (References)

  • Ravi, S. Samuel, A Comprehensive Study of Education, Fourth Printing-May 2016, Delhi – 110092, ISBN – 978-81-203-4182-1
  • Internet Sources

প্রশ্ন – ভারত পথিক কাকে বলা হয়?

উত্তর – রাজা রামমোহন রায়কে ভারত পথিক বলা হয়।

প্রশ্ন – রাজা রামমোহন রায় কে রাজা উপাধি কে দেন?

উত্তর – রাজা রামমোহন রায়কে ‘রাজা’ উপাধি দিয়েছিলেন দিল্লির বাদশাহ দ্বিতীয় আকবর।

আরোও পড়ুন

Leave a Comment

close