মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। কিন্তু অনেক সময় বিভিন্ন কারণে ব্যক্তি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বা তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। সাধারণভাবে সমাজ থেকে ব্যক্তির এই বিচ্ছিন্নতাকে বহির্ভূত করণ (Exclusion) বলে।
সমাজে বহির্ভূত করণের ধারণাটি ১৯৫০ সাল থেকে পরিলক্ষিত হয়। বহির্ভূতকরণের ফলে একটি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বা তাকে বিভিন্ন কারণে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। বহির্ভূত করণের ধারণাটি জটিল এবং পরস্পর বিরোধী। এখানে বহির্ভূতকরণ বলতে কী বোঝো এবং সামাজিক বহির্ভূত করণের কারণ গুলি আলোচনা করা হল।
বহির্ভূতকরণ বলতে কী বোঝো (Concept of Exclusion)
বহির্ভূত করণ (Exclusion) হল অন্তর্ভুক্তিকরণের (Inclusion) বিপরীত ধারনা। সমাজে প্রতিটি নাগরিকের সামাজিক অধিকার আছে। বৃত্তি, বাসস্থান, শিক্ষা ইত্যাদি সমাজের প্রধান কর্মসূচিতে সকলের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয়। কিন্তু যখন এগুলির বিপরীত ধর্মী অবস্থা সৃষ্টি হয় তখন সমাজে বহির্ভূত করণের সৃষ্টি হয়।
বহির্ভূত করণ (Exclusion)-এর ধারণাটি বর্তমানে ইউরোপ এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সামাজিক নীতির ক্ষেত্রে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করে। তবে এই ধারণাটির প্রথম উদ্ভব ঘটে ফ্রান্সে, নিম্নশ্রেণি ও দারিদ্র্য সম্পর্কিত বিষয়ে।
বহির্ভূত করণ বলতে সামাজিক অধিকার, সুযোগ সুবিধা বা সমাজের বিভিন্ন দিক থেকে বঞ্চিত থাকে। অর্থাৎ বহির্ভূতকরণ ঘটে যখন ব্যক্তি বা দল এই ধরনের বিভিন্ন কর্মসূচি থেকে বঞ্চিত হয়।
তাই বিভিন্ন অধিকার, বস্তু সামগ্রী বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা অথবা ব্যক্তির বঞ্চিত হওয়া যেটি ব্যক্তিকে সামাজিক বিভিন্ন কাজকর্মে বাধা সৃষ্টি করে ও ব্যক্তি বিভিন্ন দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় (বিশেষ করে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি) তাকে বহির্ভূ তকরণ বলে।
বহির্ভূতকরণের সংজ্ঞা
ইউরোপিয়ান ফাউন্ডেশন (1998)-এ বলা হয়েছে – বহির্ভূতকরণ হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ব্যক্তি বা দল যে সমাজে বাস করে, সেই সমাজের সামাজিক প্রক্রিয়ায় সামগ্রিক বা আংশিকভাবে অংশগ্রহণ থেকে তারা বঞ্চিত থাকে।
Gore and Figueiredo বলেছেন – বহির্ভূতকরণ হল সেই ব্যক্তি বা দল যারা নানা কারণে সাধারণ নাগরিক সুযোগসুবিধা এবং সামাজিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বহির্ভূত করণকে দু-ভাগে ভাগ করেন—
- সক্রিয় বহির্ভূতকরণ (Active exclusion): যেমন – উদ্বাস্তুদের সামাজিক ও রাজনৈতিক মর্যাদা না দেওয়া।
অর্থাৎ সামাজিক অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করা। - নিষ্ক্রিয় বহির্ভূতকরণ (Passive exclusion): যেমন – দরিদ্র্যতার কারণে আর্থিক সংকট যা কোনো নিয়ম বা আইন প্রণয়নের দ্বারা হয় না।
সামাজিক বহির্ভূতকরণের কারণ (Causes of Social Exclusion)
বহির্ভূতকরণ পদ্ধতিতে সমাজের কিছু দল বা মানুষকে সমাজের প্রান্তিক সীমায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সামাজিক বহির্ভূত করণের কারণ গুলি বিভিন্ন দিক থেকে পরিলক্ষিত হয়। সেগুলি হল –
1. ভৌগোলিক অবস্থান
ভৌগোলিক অবস্থান ব্যক্তির সামাজিক অন্তর্ভুক্তি করনে বিশেষ বাধা সৃষ্টি করে। ফলে ব্যক্তি সামাজিক বহির্ভূত করণের অংশীদার হয়ে যায়। অর্থাৎ দুর্গম ও পার্বত্য এলাকা যে সমস্ত মানুষ বাস করে তাদের কাছে সমস্ত সুযোগ সুবিধা পৌঁছায় না। তারা সমাজের মূল স্রোত থেকে দূরে সরে থাকে।
তুলনামূলকভাবে সমতলের মানুষ বা ব্যক্তিবর্গ অনেক সুযোগ সুবিধা লাভ করে থাকে। তাই ভৌগোলিক অবস্থান ব্যক্তির সামাজিক বহির্ভূতকরণের কারণ অন্যতম ভূমিকা পালন।
2. দরিদ্রতা
দরিদ্রতা সামাজিক অন্তর্ভুক্তি করনের ক্ষেত্রে বাধা স্বরূপ। অর্থাৎ দরিদ্রতা ব্যক্তিকে সামাজিক বহির্ভূত করণের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। দরিদ্র মানুষ সমাজের মূল স্রোতে ফিরে আসতে পারে না বা সমাজ থেকে সে অবহেলিত বা লাঞ্ছিত বঞ্চিত হয়ে থাকে ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকে।
তাই দরিদ্রতা ব্যক্তির উন্নতি করনের ক্ষেত্রে বিশেষ বাধা স্বরূপ। তাই এটি ব্যক্তির সামাজিক বহির্ভূতকরণের কারণ অন্যতম ভূমিকা পালন।
3. বেকারত্ব
বেকারত্ব ব্যক্তির উন্নতির বা সফলতার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে ব্যক্তি দিন দিন পিছিয়ে থাকে। অর্থাৎ সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে বা পরিবর্তনশীল সমাজের সঙ্গে সহজে অভিযোজন করতে পারে না। তাই বেকারত্ব ব্যক্তিকে সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে। সুতরাং সামাজিক বহির্ভূতকরণের কারণ হিসেবে বেকারত্ব অন্যতম।
4. ধর্ম
ধর্ম সামাজিক বহির্ভূত করণের অন্যতম কারণ। একই দেশে বহু ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গ বসবাস করলে সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে থাকে। কারণ কোন ধর্ম অধিক গুরুত্ব পাবে তা রাষ্ট্র বিচার বিবেচনা করতে অনেক সময় সক্ষম হয় না।
তাছাড়া ধর্মীয় ভেদাভেদ ও ধর্মীয় বিশ্বাসের জনসংখ্যা কম হলে সামাজিক বহির্ভূতকরণ ঘটে থাকে।
5. রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ
বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্র বিভিন্ন রকম নিয়ম-নীতির প্রবর্তন করেন। অর্থাৎ বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্র যে সমস্ত নিয়ম নীতি গ্রহণ করেন সেগুলি কিছু সংখ্যক ব্যক্তির কাছে প্রতিকূল হতে পারে। ফলে এই সমস্ত ব্যক্তিরা সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে এটি ব্যক্তির সামাজিক বহির্ভূতকরণের কারণ অন্যতম ভূমিকা পালন।
6. নিরাপত্তার অভাব
ব্যক্তির চাহিদাগুলির মধ্যে খাদ্য, বস্ত্র ছাড়া নিরাপত্তা বা আশ্রয়স্থল একটি অন্যতম দিক। সমাজে বসবাসকারী ব্যক্তিরা যদি নিরাপত্তার অভাব অনুভব করে তখন তারা সামাজিকভাবে বঞ্চিত হয়ে পড়ে। যেটি সামাজিক বহির্ভূকরণের কারণ গুলির মধ্যে অন্যতম।
7. উপযুক্ত শিক্ষার অভাব
আধুনিক শিক্ষার লক্ষ্য হল সকলের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা। কিন্তু অনেক শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কারণে বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না বা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে তারা সমাজের প্রতিষ্ঠিত লাভ করতে সক্ষম হয় না। তাই উপযুক্ত শিক্ষার অভাব সামাজিক বহির্ভূতকরণে ক্ষেত্রে অন্যতম কারণ।
8. কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস
কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস সামাজিক বহির্ভূত করণের কারণগুলির মধ্যে অন্যতম। যে সমাজে যত বেশি অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কার পরিলক্ষিত হয় সেই সমাজ ততো বেশি পিছিয়ে থাকে ও শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়। তাই সামাজিক বহির্ভূতকরণের ক্ষেত্রে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
9. শারীরিক অসুস্থতা বা দুর্বলতা
ব্যক্তির শারীরিক অসুস্থতা বা দুর্বলতা সামাজিক বহির্ভূত করণের কারণ এর মধ্যে অন্যতম। এই শারীরিক অসুস্থতার কারণে সমাজে অনেক মানুষকে ঘর ছাড়া হতে বাধ্য হতে হয়েছে।
বিশেষ করে কুষ্ঠ নামক ব্যাধি মানুষের জীবনকে দুর্বিসহ করে এবং কুষ্ঠ আক্রান্ত ব্যক্তিরা সমাজ থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হয়। ফলে তারা সমাজে বসবাস করতে পারে না বা পরিবারের সাথে একসঙ্গে মেলামেশা সুযোগ পায় না। তাছাড়া ২০১৯ সালে করোনা আসার পর অনেক মানুষ সামাজিকভাবে দূরে সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
10. মানসিক অসুস্থতা
মানসিক অসুস্থতা সামাজিক বহির্ভূত করণের অন্যতম কারণ। মানসিক দিক থেকে অসুস্থ ব্যক্তিরা সমাজের মূল স্রোতে ফিরে আসতে পারে না অর্থাৎ সমাজের সঙ্গে সঠিকভাবে মিলেমিশে বসবাস করতে পারে না। ফলে সমাজের ব্যক্তিবর্গ মানসিক অসুস্থতার কারণে ব্যক্তিকে সমাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। তাই মানসিক অসুস্থতা ব্যক্তিকে সমাজ বহির্ভূতকরণ করে থাকে।
উপসংহার (Conclusion)
পরিশেষে বলা যায়, সামাজিক বহির্ভূতকরণ সমাজের একটি সামাজিক ব্যাধি হিসেবে গণ্য হয়। যতদিন সমাজে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, দলাদলি, ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার প্রভৃতি পরিলক্ষিত হবে ততদিন সমাজের উন্নতি সম্ভব না। তাই সামাজিক বহির্ভূত করণ দূর করার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিকে সমাজের অন্তর্ভুক্তিকরণ -এর মাধ্যমে সমাজকল্যাণের দিকে লক্ষ্য দেওয়া ব্যক্তি তথা সমাজ তথা রাষ্ট্রের আশু কর্তব্য হওয়া উচিত।
তথ্যসূত্র (References)
- Kar. Chintamani, Exceptional Children Their Psychology and Education. Sterling Publication Pvt. Ltd. New Delhi.
- Kirk, S. A. Educating Exceptional Children. Oxford IBH. New Delhi.
- Mangal, S. K. Educating Exceptional Children: An Introduction to Special Education. PHI Learning Pvt. Ltd. New Delhi.
- Panda, K. C. Education of Exceptional Children. Vikas Publishing House Pvt. Ltd. New Delhi.
- Internet sources
প্রশ্ন – বহির্ভূতকরণ কী?
উত্তর – বহির্ভূতকরণ হল সমাজে যারা বাত্য বা পিছিয়ে থাকে, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকে, ন্যায় বিচার পায় না এবং প্রকৃত শিক্ষা পায় না, তাদের সকলকেই বোঝায়।
প্রশ্ন – সামাজিক বহির্ভূতকরণের দুটি কারণ লেখো।
উত্তর – সামাজিক বহির্ভূতকরণের দুটি কারণ হল – শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা এবং বেকারত্ব ও দরিদ্রতা।
আরোও পড়ুন
- একজন আদর্শ শিক্ষকের গুণাবলী | 7 Qualities of a Good Teacher
- শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য | Individual and Social Aims of Education
- শিক্ষা শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ কি | Etymological Meaning of Education
- শিক্ষার গণতান্ত্রিক লক্ষ্য বলতে কী বোঝো | Democratic Aim of Education
- মন্তেসরি শিক্ষা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য | Characteristics of Montessori Education System
- শিক্ষায় মূল্যবোধের গুরুত্ব | Importance of Values in Education