রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা চিন্তা ও শান্তিনিকেতন ভাবনা সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও | Rabindranath Tagore Contribution to Education

ঊনবিংশ শতাব্দীতে শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে যে সমস্ত মনীষীদের নাম উল্লেখযোগ্য তাদের মধ্যে অন্যতম হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা চিন্তা বা শিক্ষায় অবদান (Rabindranath Tagore Contribution to Education) সমাজে সর্বস্তরে বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছিল।

বিশ্বকবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, গল্পকার ও প্রবন্ধকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 1861 খ্রিস্টাব্দের 7 মে কলকাতার জোড়াসাঁকো বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা ছিলেন জমিদার দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মাতা ছিলেন সারদা দেবী।

Table of Contents

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা জীবন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা জীবন ছিল পরিবার কেন্দ্রিক। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাল্যকালের শিক্ষা পরিবার থেকেই লাভ করেছেন। তিনি পিতার কাছ থেকে সংস্কৃত এবং ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন।

1877 খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আইন শিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে যান কিন্তু শিক্ষা শেষ না করে আবার দেশে ফিরে আসেন। তিনি ইংল্যান্ডের থাকাকালীন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে জ্ঞান অর্জন করেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘গীতাঞ্জলি’ পুস্তকটি নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয় এবং 1913 খ্রিস্টাব্দে তিনি এশিয়ার প্রথম (ভারতীয়) হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা দর্শন বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা চিন্তা | Rabindranath Tagore Contribution to Education

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন প্রকৃতিপ্রেমী দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ। রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির কোলে শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে বাস্তবমুখী শিক্ষাদানের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা চিন্তা বিশ্লেষণ করলে, যে সমস্ত দিক বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয় সেগুলি হল নিম্নলিখিত –

1. শিক্ষার লক্ষ্য

রবীন্দ্রনাথের মতে শিক্ষার লক্ষ্য হল পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে সার্থক অভিযোজন করা। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ বলেন – প্রকৃতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীরা নিজেদেরকে পরিবর্তনশীল প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে।

এছাড়া তিনি শিক্ষার লক্ষ্য হিসেবে শিক্ষার্থীদের সর্বাঙ্গীন বিকাশের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতি বিকাশ সাধন হবে শিক্ষা অন্যতম লক্ষ্য।

2. শিক্ষার পাঠক্রম

শিক্ষার পাঠক্রম প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রদান করেন। রবীন্দ্রনাথের মতে – শিক্ষার পাঠক্রম হবে কর্মকেন্দ্রিক এবং বাস্তব জীবনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যাতে শিক্ষার্থীরা তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞান লাভ করতে পারে।

শিক্ষা পাঠক্রম হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে সমস্ত বিষয়ের উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম হল – ভাষা, সাহিত্য, দর্শন, গণিত, বিজ্ঞান, শিল্পকলা প্রভৃতি। এছাড়া ব্যবহারিক শিক্ষার পাঠক্রম হিসেবে নৃত্য, অংকন, সঙ্গীত, খেলাধুলা, ব্যায়াম প্রভৃতির কথা উল্লেখ করেছেন।

3. শিক্ষণ পদ্ধতি

শিখন পদ্ধতি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা চিন্তা বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে। রবীন্দ্রনাথের মতে – শিক্ষণ পদ্ধতি হবে সমস্যা সমাধানমূলক। অর্থাৎ তিনি শিক্ষার্থীদের স্বাধীন ও স্বাভাবিক পরিবেশে বাস্তব জীবনের সঙ্গে সংযোগ রেখে শিক্ষাদানের কথা বলেছেন।

তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষণ পদ্ধতি হিসেবে – আবিষ্কার পদ্ধতি, কর্মকেন্দ্রিক পদ্ধতি, অভিজ্ঞতা কেন্দ্রিক পদ্ধতি, আলোচনা, বিতর্ক, গল্পের ছলে শিক্ষা প্রভৃতির উল্লেখ করেছেন।

4. শিক্ষকের ভূমিকা

রবীন্দ্রনাথের মতে – শিক্ষক হবেন সহানুভূতিশীল এবং নমনীয়। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে সর্বদা সহায়কের ভূমিকা পালন করবে। অর্থাৎ শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ এবং ভালোবাসা দিয়ে শিক্ষা দান করবেন।

তাই শিক্ষকের ভূমিকা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন – শিক্ষক এমন একটি পরিবেশ রচনা করবেন যেখানে শিক্ষার্থীরা প্রকৃতির মধ্য থেকে স্বাধীনভাবে শিক্ষা লাভ করতে পারবে।

5. শিক্ষার মাধ্যম

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন – “মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ সম”। রবীন্দ্রনাথ মাতৃভাষাকে মাতৃদুগ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাই তিনি শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। এর বাস্তবিক প্রয়োগ দেখা যায়, শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ে।

6. শৃঙ্খলা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষায় মুক্ত শৃঙ্খলা দানের কথা উল্লেখ করেছেন। তাই তিনি বলেন শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় স্বাধীনতা দিলে শিক্ষার্থীরা নিজে থেকেই শৃঙ্খলিত হয়ে পড়বে। তাই রবীন্দ্রনাথের মতে – শৃঙ্খলা মানে বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া কোনো নিয়ম-কানুন নয়।

7. বিদ্যালয় স্থাপন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা চিন্তার মধ্যে অন্যতম দিক হল বিদ্যালয় স্থাপন। রবীন্দ্রনাথ নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা পদ্ধতির বিরোধিতা করে বলেছিলেন – মানুষের শিশু কাঁদতে কাঁদতে পাঠশালায় যায়। তাই বিদ্যালয়ের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেন – প্রকৃতির কোলে শান্ত নির্জন পরিবেশ হবে বিদ্যালয়ের পরিবেশ।

অর্থাৎ প্রকৃতির কোলে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে যেখানে শিক্ষার্থীরা স্বাধীনভাবে শিক্ষা লাভ করবে।

শান্তিনিকেতন ভাবনা সংক্ষিপ্ত পরিচয়

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা চিন্তার অন্যতম ব্যবহারিক বা বাস্তবায়িত দিক হল 1901 সালের 22 শে ডিসেম্বর শান্তিনিকেতনে আশ্রমিক বিদ্যালয় স্থাপন। শান্তিনিকেতনকে ব্রহ্মচর্যাশ্রম বলা হয়। এটি পরবর্তীকালে বিশ্বভারতীতে রূপান্তরিত হয়। অর্থাৎ এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা হওয়ার 17 বছর পর 1918 সালে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতন ভাবনা শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই শিক্ষা ব্যবস্থার কতগুলি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। সেগুলি হল –

i) এই শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল আশ্রমিক শিক্ষা প্রকৃতির।

ii) অবাক স্বাধীনতা মূলক।

iii) সৃজনধর্মী শিক্ষা ব্যবস্থা।

iv) বৃত্তিমুখীনতা। শান্তিনিকেতনের এই শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবনের উপযোগী করে তোলার জন্য বৃত্তিশিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

উপসংহার (Conclusion)

সর্বোপরি বলা যায়, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা চিন্তা আধুনিককালে বিশেষভাবে গ্রহণযোগ্য। তার শিক্ষা চিন্তা কেবলমাত্র তাত্ত্বিক দিকেই সীমাবদ্ধ ছিলনা বরং ব্যবহারিক দিকের তার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। যেমন – বিশ্বভারতী বা শান্তিনিকেতনের শিক্ষা ব্যবস্থা।

তথ্যসূত্র (References)

  • Education in India-Past-Present-Future, Vol. I and II, J. P. Banerjee
  • Landmarks in the History of Modern Indian Education, J. C. Aggarwal
  • Internet Sources

প্রশ্ন – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা দর্শনের চারটি প্রধান নীতি কী কী

উত্তর – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা দর্শনের চারটি প্রধান নীতি হল – যুক্তি, মুক্তি, সৃজনধর্মী আত্মপ্রকাশ এবং প্রকৃতির সান্নিধ্য বা মানুষ আর প্রকৃতির মধ্যে মিলন।

প্রশ্ন – শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়টি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পূর্বে এর নাম কী ছিল

উত্তর – 1901 সালের 22 শে ডিসেম্বর শান্তিনিকেতনে আশ্রমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পূর্বে এর নাম ছিল ব্রহ্মচর্যাশ্রম।

প্রশ্ন – শিক্ষার মাধ্যম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ কী বলেছিলেন

উত্তর – শিক্ষার মাধ্যম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাতৃভাষার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন – মাতৃভাষা হল মাতৃদুগ্ধের সমান। অর্থাৎ তিনি মাতৃভাষাকে মাতৃদুগ্ধের সহিত তুলনা করেছিলেন

প্রশ্ন – বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠাতা কে এবং এর প্রথম উপাচার্য কে ছিলেন

উত্তর – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২১ সালেবিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেন। এটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে ১৯৫১ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ছিলেন কবির পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

প্রশ্ন – বিশ্বভারতীর দুটি উদ্দেশ্য লেখো

উত্তর – বিশ্বভারতীর দুটি উদ্দেশ্য হল – i) সত্যের অনুসন্ধান, ii) প্রাচীন কৃষ্টির বিকাশের জন্য গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন।

প্রশ্ন – কবে এবং কোথায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর পরীক্ষণমূলক বিদ্যালয় স্থাপন করেন

উত্তর – 1924 সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গ্রামীণ শিক্ষার পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য শান্তিনিকেতনে একটি পরীক্ষামূলক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। যেটি শিক্ষাসত্র নামে পরিচিত।

প্রশ্ন – কত সালে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয় এবং কবে এটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে

উত্তর – বিশ্বভারতী 1921 সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করেন। এটি 1951 সালে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে।

আরোও পড়ুন

Leave a Comment

close