যখন কোন বিষয় ব্যক্তি মনে করতে পারে না, তখন সেটিকে বিস্মৃতি বলে। স্মৃতির বিপরীত হল বিস্মৃতি। বিস্মৃতি কারণ গুলি (Causes of Forgetting) বিভিন্ন দিক থেকে হয়ে থাকে।
সাধারণত স্মৃতির অভাবে বিস্মৃতি ঘটে। বিস্মৃতির ফলে অনেক সময় মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে ওঠে। কারণ সঠিক সময়ে যদি সঠিক বিষয় মনে না পরে তাহলে সেই সময় ব্যক্তির জীবনে আর ফিরে নাও আসতে পারে। যেমন – ইন্টারভিউ সময় যদি প্রশ্নের উত্তর ভুলে যায় তাহলে এক্ষেত্রে বিশেষ সমস্যা হয়ে থাকে। এখানে বিস্মৃতির কারণ গুলি কি কি তা আলোচনা করা হল।
বিস্মৃতি কাকে বলে
স্মৃতির অভাব হল বিস্মৃতি । অর্থাৎ কোনো কিছু মনে করতে ব্যর্থ হওয়াকে বিস্মৃতি বলে। তাই পূর্বে শেখা কোনো বিষয় বা ঘটনা প্রয়োজনের সময় চেষ্টা সত্ত্বেও সঠিকভাবে মনে করতে না পারাকে বিস্মৃতি বলা হয়।
বিস্মৃতির সংজ্ঞা
বিস্মৃতি কাকে বলে সে বিষয়ে বিভিন্ন মনোবিদদের দেওয়া বিভিন্ন সংজ্ঞা পরিলক্ষিত হয়। বিস্মৃতির সংজ্ঞা গুলি হল নিম্নলিখিত –
বিশিষ্ট মনোবিদ Munn বলেছেন – বিস্মৃতি হল মনে রাখতে ব্যর্থ হওয়া বা যা অর্জিত হয়েছে তা স্মরণ করতে না পারা। (“Forgetting is failing to retain or to be able to recall which has been acquired.”)
আবার মনোবিদ Drever বলেছেন – “Forgetting means failure at any time to recall an experience, when attempting to do so, or to perform an action previously learned.”
বিস্মৃতির কারণ | Causes of Forgetting
বিস্মৃতির কারণ বিভিন্ন দিক থেকে পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ বিভিন্ন কারণে মানুষের মধ্যে বিস্মৃতি ঘটে থাকে। বিস্মৃতির কারণ গুলি হল, নিম্নলিখিত –
1. শারীরিক অক্ষমতা
শারীরিক অক্ষমতা বা প্রতিবন্ধকতা বিস্মৃতির অন্যতম কারণ। কারণ কোনো ব্যক্তি যদি শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকে তাহলে সে সঠিক সময়ে সঠিক তথ্য মনে করতে পারে না। ফলে ব্যক্তির মধ্যে বিস্মৃতি দেখা দেয়।
2. সংকেতকনের অক্ষম
যদি কোনো ব্যক্তি কোনো তথ্য সঠিকভাবে সংকেতকরন বা Encoding করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেই তথ্য পরবর্তীকালে মনে পরেনা। একটি বিস্মৃতির বিশেষ কারণ।
3. অন্তরায় বা বাধা
অন্তরায় বা বাধা বিস্মৃতির কারণ গুলির মধ্যে অন্যতম। এই তথ্য অনুযায়ী কোনো শেখা জিনিস বা বিষয় বা তথ্য ব্যক্তির ভুলে যায়, তার কারণ হল অন্তরায়। অর্থাৎ কোনো শিখনের ক্ষেত্রে আগের বিষয় দ্বারা বাধা প্রাপ্ত হয়। এই অন্তরায়কে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা –
(i) পশ্চাৎমুখী অন্তরায় বা প্রতিরোধ – যখন নতুন শেখা বিষয়বস্তুর ফলে পুরনো শেখা বিষয়ের বিস্মরণ ঘটে, তখন তাকে পশ্চাৎমুখী প্রতিরোধ বলে।
Jenkins এবং Dallenback পরীক্ষা থেকে জানা যায় যে, কোনো বিষয় শেখার পর ঘুমালে পশ্চাদমুখী অন্তরায় এর পরিমাণ অনেক কম হয়।
(ii) সম্মুখবর্তী প্রতিরোধ বা বাধা – যখন পুরানো কোনো শেখা বিষয়বস্তুর ফলে নতুন শেখা বিষয়বস্তুর বিস্মরণ ঘটে, তখন তাকে সম্মুখবর্তী প্রতিরোধ বলে। এটি বিস্মৃতির অন্যতম কারণ।
4. মানসিক আঘাত
মানসিক আঘাত বিস্মৃতির কারণগুলির মধ্যে অন্যতম। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি মানসিকভাবে আঘাত পেলে পূর্বের বিষয় ভুলে যেতে পারে। তাই মানসিক আঘাত মনে রাখার ক্ষেত্রে অন্তরায়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় – কোনো নিকট আত্মীয় মৃত্যুর কারণে কোনো ব্যক্তি প্রচন্ডভাবে মানসিক আঘাত পেতে পারে বা প্রেমে ব্যর্থতা প্রভৃতি কারণে মানসিক আঘাত ঘটে থাকে। এ ক্ষেত্রে বিস্মরণ ঘটতে পারে।
5. দুর্ঘটনা
যেকোনো দুর্ঘটনা ব্যক্তির ক্ষেত্রে খারাপ ফল দিতে পারে। অর্থাৎ দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তি পূর্বের শেখা কোন বিষয় বা অতীত বিষয় সম্পূর্ণ ভুলে যেতে পারে। এই দুর্ঘটনা বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। যেমন – ট্রেন এক্সিডেন্ট, আগুনে পুড়ে যাওয়া প্রভৃতি। তারা দুর্ঘটনার প্রকৃতি অনুযায়ী বিস্মৃতি বা ভুলে যাওয়া নির্ভর করে।
6. পুনরুত্থাপনে ব্যর্থতা
সঠিক সময়ে সঠিক বিষয় মনে করতে না পারাই হল বিস্মৃতি। অর্থাৎ পুনরুত্থাপনে ব্যর্থতা বিস্মৃতির অন্যতম কারণ। যদি কোনো ব্যক্তি সঠিক সময়ে কোনো বিষয় মনে করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেই বিষয়টি পুনরুদ্রেক বা পুনরুত্থাপন করতে ব্যর্থ হবে।
7. নেশাকর বস্তু সেবন
গবেষণায় দেখা গেছে যে, বিভিন্ন নেশাকর বস্তু যেমন – আফিম, মাদক প্রভৃতি বিস্মৃতির অন্যতম কারণ। এগুলি মানুষের স্নায়ুতন্ত্রে একপ্রকার বিরূপ প্রভাব ফেলে। ফলে ব্যক্তিরা কোনো কিছু মনে রাখতে পারে না বা ভুলে যেতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় যে, বিপদগ্রস্ত অচেনা কোনো ব্যক্তি প্রচন্ড নেশার কারণে তার বাড়ির ঠিকানা সঠিকভাবে বলতে পারছে না। ফলে তাকে সেই সময় সাহায্য করা সম্ভব হয় না।
8. মনোযোগ ও আগ্রহের অভাব
বিস্মৃতির কারণ হিসাবে মনোযোগ ও আগ্রহের অভাব এই দুটি উপাদান বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করে। কারণ কোনো বিষয়ের প্রতি ব্যক্তির বা শিক্ষার্থীর মনোযোগ ও আগ্রহ না থাকে। তাহলে সেই বিষয়টি ভালোভাবে আয়ত্ত করা সম্ভব হয় না। সে ক্ষেত্রে ভুলে যাওয়া সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ বিস্মৃতি দেখা দেয়।
9. অনুশীলনের অভাব
কোনো বিষয়ে একবার শেখার পর যদি তা অনুশীলন করা না হয়, তাহলে সেই বিষয়টি ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। তাই বারবার অনুশীলন করলে যে-কোনো বিষয় দীর্ঘদিন মনে থাকে। কিন্তু অনুশীলনের অভাবের ফলে তা বিস্মৃতির অন্তরালে চলে যায়।
10. পরিবেশ পরিবর্তন
হঠাৎ করে পরিবেশ পরিবর্তনের কারণে ব্যক্তির মধ্যে পূর্বের বিষয় ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ বিস্মৃতি ঘটে থাকে। তাই পরিবেশ পরিবর্তন এর কারণে ভুলে যাওয়া একটি স্বাভাবিক ঘটনা।
আরোও পোস্ট পড়ুন – Click Here Now |
11. সময়গত বিস্মৃতি
কোনো কিছু শেখা বিষয় ও পুনরুদ্রেকের ক্ষেত্রে সময় যত কম হবে বিস্মিতির পরিমাণ তত কম হবে এবং যত সময় বেশি হবে বিস্মৃতির পরিমাণ ততো বেশি হবে।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট মনোবিদ এবিংহসের পরীক্ষা উল্লেখযোগ্য। তিনি পরীক্ষা করে দেখেছেন যে – কোনো বিষয় শেখার ফলে সময়ের ব্যবধানে সেই বিষয়ের মনে রাখা নির্ভর করে। অর্থাৎ কোনো বিষয় শিখনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীরা যতটা মনে রাখতে পারে, কুড়ি দিন পর সেই বিষয়টি অনেকাংশে ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
12. শারীরিক ক্লান্তি
কোনো ব্যক্তি যদি শারীরিকভাবে ক্লান্তি থাকে তাহলে পূর্বে শেখা বিষয় বিস্ফোরণ ঘটে বা সঠিকভাবে মনে করতে পারে না। তাই শারীরিক ক্লান্তির সঙ্গে পশ্চাদমুখী অন্তরায় এর সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ শারীরিক ক্লান্তি যত বেশি হয় পশ্চাদমুখী অন্তরায় তত বেশি হয়।
উপসংহার (Conclusion)
পরিশেষে বলা যায়, বিস্মৃতি এমন একটি প্রক্রিয়া যেটি বিভিন্ন কারনে ঘটে থাকে। তাই উপরোক্ত কারণ গুলি যদি হ্রাস করা সম্ভব করা হয়, তবে বিস্মৃতি অনেকাংশে কমতে পারে।
মনোবিদগণ বলেন যে – সম্পূর্ণভাবে বিস্মৃতিকে দূর করা সম্ভবপর নয়। কিন্তু ব্যক্তি জীবনে বিস্মৃতি একটি স্বাভাবিক ঘটনা। কারণ আমরা যতই ভুলে যাই আবার নতুন কিছু শিখে। অর্থাৎ ভুলে যাওয়ার জন্য শিখি। যদি আমাদের অতীত কোনো খারাপ অভিজ্ঞতা কিছুতেই না ভুলতে পারি তাহলে জীবন দুর্বিষহ সহ হয়ে উঠতে পারে। তাই অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের বিস্মৃতি ভালো ফল প্রদান করে।
তথ্যসূত্র (Reference)
- A. Woolfolk – Educational Psychology – Pearson Education
- J. W. Santrock – Educational Psychology – Mc Gray Hill
- J. C. Aggarwal – Essentials of Educational Psychology – Vikas publisher
- S. K. Mangal – Essentials of Educational Psychology – PHI Ltd.
- S. K. Mangal – Advanced Educational Psychology – PHI Ltd
- S. S. Chauhan – Advanced Educational Psychology – Vikas publisher
- E. B. Hurlock – Child Development – Anmol Publication Pvt. Ltd
- L. E. Berk – Child Development – PHI Ltd
- Internet Sources
প্রশ্ন – বিস্মৃতি কি আশীর্বাদ
উত্তর – মনোবিদদের মতে বিস্মৃতি হল আশীর্বাদ। কারণ ব্যক্তি জীবনে বিস্মৃতি একটি স্বাভাবিক ঘটনা। কারণ আমরা যতই ভুলে যাই আবার নতুন কিছু শিখে। অর্থাৎ ভুলে যাওয়ার জন্য শিখি। যদি আমাদের অতীত কোনো খারাপ অভিজ্ঞতা কিছুতেই না ভুলতে পারি তাহলে জীবন দুর্বিষহ সহ হয়ে উঠতে পারে। তাই অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের বিস্মৃতি ভালো ফল প্রদান করে।
আরোও পড়ুন
- শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশ | বৃদ্ধি ও বিকাশের মধ্যে পার্থক্য | 10 Difference Between Growth and Development
- বৃদ্ধি কাকে বলে | বৃদ্ধির বৈশিষ্ট্য | 4 Definition of Growth
- বৃদ্ধি ও বিকাশের বৈশিষ্ট্য | Characteristics of Growth and Development
- জীবন বিকাশের বিভিন্ন স্তর গুলি আলোচনা কর | 4 Stages of Human Development
- শিখন কাকে বলে | শিখনের বৈশিষ্ট্য | 5 Definition and Characteristics of Learning
- ব্যক্তিত্ব কাকে বলে | ভালো ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য (5 Definition and Characteristics of Personality)