ভারতীয় দর্শন হল বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ দর্শন। ভারতীয় দর্শনকে বিভিন্নভাবে ভাগ করা হয়ে থাকে। তাদের মধ্যে অন্যতম হল বৈদিক দর্শন (Vedic Philosophy).
ভারতীয় দর্শন বলতে ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায়কে বোঝানো হয়ে থাকে। ভারতীয় দার্শনিকগণ ভারতীয় দর্শনকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করেন। যথা – আস্তিক বা বৈদিক দর্শন এবং নাস্তিক বা অবৈদিক দর্শন। এখানে আস্তিক বা বৈদিক দর্শন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করা হলো।
বৈদিক দর্শন | Vedic Philosophy
ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি অন্যতম দর্শন সম্প্রদায় হল বৈদিক দর্শন। এটি আস্তিক দর্শন নামে পরিচিত। যে সকল দার্শনিক সম্প্রদায়গুলি বেদের প্রামাণ্যকে স্বীকার করে বা বেদকে বিশ্বাস করে সেই দার্শনিক সম্প্রদায়কে বৈদিক দর্শন বা আস্তিক দর্শন বলা হয়ে থাকে।
বৈদিক দর্শনের শাখা
যে সমস্ত দার্শনিক সম্প্রদায় বেদের প্রামাণ্যকে স্বীকার করে, তাদের বৈদিক দর্শন বা আস্তিক দর্শন বলে। এই দর্শনকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যথা –
1. বেদ অনুগত দর্শন
যে সকল দর্শন সম্প্রদায় সম্পূর্ণভাবে ব্রেদের প্রামাণ্যকে স্বীকার করে এবং বেদের উপর প্রতিষ্ঠিত, তাকে বেদ অনুগত দর্শন সম্প্রদায় বলে। বেদ অনুগত দর্শন সম্প্রদায়গুলি হল – মীমাংসা দর্শন এবং বেদান্ত দর্শন।
মীমাংসা দর্শন
ভারতীয় দর্শনে সম্পূর্ণ বেদ নির্ভর দর্শন হল মীমাংসা দর্শন। মীমাংসা দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মহর্ষি জৈমিনি। এই দর্শনের উদ্দেশ্য হল বৈদিক যাগযজ্ঞ, ক্রিয়া কলাপ এবং বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে সেগুলিকে সমর্থন করা। অর্থাৎ বৈদিক কর্মকান্ডের একটি দার্শনিক ভিত্তি প্রদান করা।
মীমাংসা দর্শন প্রত্যক্ষভাবে বেদভিত্তিক দর্শন। এখানে বেদকে অপৌরুষেয় বলা হয়েছে। তাই বেদ নিত্য ও স্বনির্ভর। মীমাংসা দর্শনের মূল ভিত্তি হল কর্মকান্ড বা পূর্ব কান্ড। এই কারণে মীমাংসা দর্শনকে পূর্ব মীমাংসা দর্শনও বলা হয়।
বেদান্ত দর্শন
ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীনতম দর্শন হল বেদান্ত দর্শন। বর্তমানে এই দর্শনের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ এটি ভারতীয় দর্শনের এমন শাখা যেটি ভারতবর্ষের ধর্মীয় সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
আক্ষরিক অর্থে বেদান্ত শব্দের অর্থ হল বেদের অন্ত বা বেদের উপসংহার মূলক ক্ষেত্র। এটি জ্ঞানের চরম সীমাকে নির্দেশিত করে।
বেদান্ত দর্শনের মূল ভিত্তি হল জ্ঞানকাণ্ড বা উত্তর কান্ড। বেদান্ত দর্শনের মধ্যে উপনিষদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ব্যাখ্যা উপস্থাপিত হয়েছে। উপনিষদকে ভিত্তি করে বেদান্ত দর্শনের সৃষ্টি হয়েছে তাই বেদান্ত দর্শনকে উত্তর মীমাংসা বলা হয়ে থাকে। যার অর্থ হল সর্বশেষ বা উচ্চ স্তরের অনুসন্ধান।
বেদান্ত দর্শনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য শাখা বর্তমান। যথা –
i) অদ্বৈতবাদ (প্রবক্তা – আদি শংকরাচার্য)
ii) বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ (প্রবক্তা – আচার্য রামানুজ),
iii) দ্বৈতাদ্বৈতবাদ ( প্রবক্তা – আচার্য নিম্বার্ক),
iv) দ্বৈতবাদ ( প্রবক্তা – আচার্য মাধব),
v) শুদ্ধাদ্বৈতবাদ ( প্রবক্তা – আচার্য বল্লভ),
vi) অচিন্ত্য ভেদাভেদ ( প্রবক্তা – চৈতন্য মহাপ্রভু)।
2. বেদ স্বতন্ত্র দর্শন
যে সকল দর্শন সম্প্রদায় বেদের প্রামাণ্যকে স্বীকার করলেও সরাসরি বা প্রত্যক্ষভাবে বেদের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়, সেই সকল দর্শন সম্প্রদায়কে বেদ স্বতন্ত্র দর্শন বলে। বেদ স্বতন্ত্র দর্শন সম্প্রদায়গুলি হল চার প্রকারের। যথা – সাংখ্য দর্শন, যোগ দর্শন, ন্যায় দর্শন ও বৈশেষিক দর্শন।
সাংখ্য দর্শন
ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীনতম এবং অন্যতম বৈদিক বা আস্তিক দর্শন হল সাংখ্য দর্শন। সাংখ্য দর্শনের প্রবক্তা এবং প্রতিষ্ঠাতা হলেন মহর্ষি কপিল। অনেক দার্শনিকগণের মতে সাংখ্য দর্শনের সূচনাকাল ৪৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। আবার অনেকে বলেন সাংখ্য দর্শনের উৎপত্তি খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ বা সপ্তম শতাব্দীতে। সাংখ্য দর্শন বেদ স্বতন্ত্র হলেও ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করে না
সাংখ্য দর্শনের কয়েকটি মূলনীতি হল – কার্যকারণবাদ, দ্বৈতবাদী দর্শন, পুরুষবহুত্ববাদ, মোক্ষলাভ, পরিনামবাদ প্রভৃতি।
এছাড়া সাংখ্য জ্ঞানবিদ্যা অনুযায়ী প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ প্রমানকে একমাত্র জ্ঞানলাভের উৎস হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
যোগ দর্শন
যোগ দর্শন হল ভারতীয় বৈদিক দর্শন বা আস্তিক দর্শন সম্প্রদায়গুলির মধ্যে অন্যতম। এই দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মহর্ষি পতঞ্জলি। এই যোগ দর্শন বিজ্ঞানসম্মত দর্শন। এই দর্শনে শরীর ও মন উভয়ের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। মহর্ষি পতঞ্জলি বলেছেন – যোগের অর্থ হল চিত্ত বৃত্তির নিরোধ। অর্থাৎ ” যোগশ্ব চিত্তবৃত্তি নিরোধঃ”।
যোগ দর্শন অনুযায়ী চিত্তবৃত্তি নিরোধের জন্য অষ্টবিধ সাধন বা উপায় অনুশীলনের কথা বলা হয়েছে। এদেরকে একত্রে অষ্ট যোগ বা অষ্ট যোগাঙ্গ বলা হয়ে থাকে। এগুলি হল – যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, , ধারণা, ধ্যান এবং সমাধি।
আবার, পতঞ্জলির যোগদর্শন অনুযায়ী যোগসূত্র ৪টি পাদ বা খন্ডে বিভক্ত। যথা – সমাধিপাদ, সাধনপাদ, বিভূতিপাদ এবং কৈবল্যপাদ।
ন্যায় দর্শন
ন্যায় দর্শন হল একটি অন্যতম বৈদিক দর্শন সম্প্রদায়। এই ন্যায় দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মহর্ষি গৌতম। তিনি ‘অক্ষপাদ’ নামেও অধিক পরিচিত। ন্যায় দর্শনের প্রথম ও প্রধান গ্রন্থ হল মহর্ষি গৌতম দ্বারা প্রণীত ন্যায় সূত্র।
ন্যায় শব্দটি একটি সংস্কৃত শব্দ। যার অর্থ হল নিয়ম বা বিধান বা পদ্ধতি। যে প্রণালীর দ্বারা বা নিয়মের দ্বারা কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় তাকে নেয় বলে। তাই ভাষ্যকার বাৎস্যায়ন বলেছেন – ” নিয়তে অনেন ইতি ন্যায়ঃ”।
ভারতীয় ন্যায় দর্শনের দুটি শাখা পরিলক্ষিত হয়। যথা – প্রাচীন ন্যায় দর্শন এবং নব্য ন্যায় দর্শন।
ন্যায় দর্শনের মূলনীতি গুলি হল – বেদানুগত, বস্তুবাদী দর্শন, তত্ত্ববিদ্যা নির্ভর, আধ্যাত্মবাদী প্রভৃতি।
ন্যায় দর্শনে জ্ঞানতত্ত্ব হল – প্রত্যক্ষ, অনুমান, শব্দ ও উপমান।
বৈশেষিক দর্শন
ভারতীয় বৈদিক দর্শন সম্প্রদায়গুলির মধ্যে বৈশেষিক দর্শন হল একটি অন্যতম দর্শন সম্প্রদায়। এই দর্শনের প্রবক্তা হলেন ঋষি কনাদ। অনেক দার্শনিকগণ বলেন বিশেষ নামক পদার্থের উপর গুরুত্ব আরোপ করার জন্যই এই দর্শনকেই বৈশেষিক দর্শন বলা হয়ে থাকে।
বৈশেষিক দর্শনের বিস্তৃত ধারণা পাওয়া যায় কনাদ মুনি রচিত বৈশেষিক সূত্র নামক গ্রন্থ থেকে। এই গ্রন্থে মোট সূত্রের সংখ্যা ৩৮০ টি। যেগুলি দশটি অধ্যায়ে বিভক্ত এবং প্রতিটি অধ্যায় দুটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত।
বৈশেষিক দর্শনে জ্ঞানতত্ত্ব হল – প্রত্যক্ষ ও অনুমান।
উপসংহার (Conclusion)
পরিশেষে বলা যায়, বৈদিক দর্শন বা আস্তিক দর্শন ছয়টি সম্প্রদায়ভুক্ত। এগুলিকে অনেকে ষড়দর্শন হিসেবে গণ্য করে থাকেন। ভারতীয় দর্শনের বৈদিক দর্শন বা আস্তিক দর্শন সম্প্রদায় সম্পূর্ণ রূপে বেদের প্রামাণ্যকে স্বীকার করে। অর্থাৎ এই দর্শন অনুযায়ী ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস করে থাকে। তাই এই দর্শন সর্বদা ধর্মের সঙ্গে যুক্ত এবং এই দর্শনের লক্ষ্য হল মোক্ষলাভ বা মুক্তি লাভ করা।
তথ্যসূত্র (References)
- Aggarwal, J. C., Theory and Principles of Education. 13th Ed. Vikas Publishing House Pvt. Ltd.
- V.R. Taneja, Educational Thoughts & Practice. Sterling Publication Pvt. Ltd. New Delhi
- Nayak, B.K, Text Book of Foundation of Education. Cuttack, Odisha: KitabMhal
- Ravi, S. Samuel, A Comprehensive Study of Education, Fourth Printing-May 2016, Delhi – 110092, ISBN – 978-81-203-4182-1,
- Internet sources
প্রশ্ন – বৈদিক দর্শন কত প্রকার?
উত্তর – বৈদিক দর্শন প্রধানত ছয় প্রকারের হয়ে থাকে। যথা – সাংখ্য দর্শন, যোগ দর্শন, ন্যায় দর্শন, বেদান্ত এবং মীমাংসা দর্শন।
প্রশ্ন – ভারতীয় দর্শন কয় প্রকার ও কি কি
উত্তর – ভারতীয় দর্শন দুই প্রকার। যথা – আস্তিক দর্শন বা বৈদিক দর্শন এবং অবৈধিক দর্শন বা নাস্তিক দর্শন।
প্রশ্ন – আস্তিক দর্শন কয় প্রকার
উত্তর – আস্তিক দর্শন প্রধানত ছয় প্রকারের হয়ে থাকে। যথা – সাংখ্য দর্শন, যোগ দর্শন, ন্যায় দর্শন, বেদান্ত এবং মীমাংসা দর্শন।
আরোও পড়ুন
- Idealism : ভাববাদ কাকে বলে | ভাববাদের মূলনীতি ও শিক্ষায় প্রভাব
- Naturalism : প্রকৃতিবাদের ধারণা, সংজ্ঞা, মূলনীতি ও শিক্ষায় প্রভাব
- Pragmatism : প্রয়োগবাদের ধারণা, সংজ্ঞা, মূলনীতি ও শিক্ষায় প্রভাব
- Realism: বাস্তববাদ কি | বাস্তববাদের বৈশিষ্ট্য | শিক্ষায় প্রভাব
- আর্যসত্য কি | বৌদ্ধ দর্শনের চারটি আর্য সত্য | 4 Noble Truths of Buddhism
- বৈদিক দর্শন টীকা | Vedic Philosophy of Education