চার্বাক দর্শন কাকে বলে | চার্বাক দর্শনের শিক্ষাগত তাৎপর্য | Educational Implications of Charvaka Philosophy

ভারতীয় দর্শনের মধ্যে নাস্তিক বা অবৈধিক দর্শন সম্প্রদায় হল চার্বাক দর্শন। এটি নাস্তিক দর্শন সম্প্রদায় হলেও আধুনিক শিক্ষায় চার্বাক দর্শনের শিক্ষাগত তাৎপর্য (Educational Implications of Charvaka Philosophy) বা প্রভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়।

চার্বাক দর্শন কাকে বলে | Charvaka Philosophy

চার্বাক দর্শন কাকে বলে এ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা পাওয়া যায় না। তবে যে দর্শনে বা দর্শন সম্প্রদায়ে ইন্দ্রিয় ভোগকে বা বস্তুজগতকে পুরুষার্থ বলা হয়েছে এবং যে দর্শন সম্প্রদায় নাস্তিক প্রকৃতির সেই দর্শনটিকে চার্বাক দর্শন বলা হয়।

চার্বাক দর্শন বস্তুবাদী দর্শনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তাই বাস্তববাদের প্রবক্তা হিসেবে বৃহস্পতিলৈক্য বা ব্রাহ্মণস্পতি চার্বাককে চার্বাক দর্শনের প্রবক্তা হিসেবে গণ্য করা হয়।

চার্বাক দর্শনে চার্বাক শব্দটির উৎস সম্পর্কে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে। কোন কোন দার্শনিক বলেন চার্বাক নামে এক ঋষি নাম অনুসারে চার্বাক শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। আবার চার্বাক শব্দটি সর্ব ধাতু থেকে এসেছে যার অর্থ হল – ‘ খাও দাও ও আনন্দ করো’।

আবার চার্বাক দার্শনিকগনের মতে –

“ঋণং কৃত্তা ঘৃতং পিবেত্, যাবৎ জীবং সুখং জীবেত্,
ভস্মীভূতস্য দেহস্য, পুনরাগমনং কুতঃ।”

অর্থাৎ যতদিন বাঁচবে ঋণ করে ঘি খাও, যতদিন বাঁচবে সুখে বাঁচো। কারণ, দেহ যখন ভস্ম হয়ে যাবে, তখন পুনর্জন্মের কোনো প্রশ্নই নেই।

চার্বাক দর্শনের বৈশিষ্ট্য

চার্বাক দর্শনের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়, সেগুলি হল –

i) শুধু প্রত্যক্ষ প্রমাণ – চার্বাক দর্শনে যথার্থ জ্ঞানকে প্রমা আর যথার্থ জ্ঞানের উৎস কে প্রমাণ বলে। তাই চারবার দর্শন সম্প্রদায় প্রত্যক্ষকে একমাত্র প্রমাণ বলে গ্রহণ করেন।

ii) চারটি মহাভূত বর্তমান – চার্বাক দর্শনে প্রত্যক্ষের বাইরে কিছু অস্তিত্ব নেই একথা স্বীকার করা হয়। তাই। এই দর্শন পাঁচটি মহাভূতের মধ্যে চারটি মহাভূতকে স্বীকার করেছেন। যথা – ক্ষিতি, অব, তেজ, মরুৎ। চার্বাকগণ বোমকে বা আকাশকে অস্বীকার করেন কেননা এটি প্রত্যক্ষ যোগ্য নয়।

iii) পুরুষার্ত দুটি – চার্বাক দর্শন সম্প্রদায় শুধুমাত্র অর্থ এবং কামকে জীবনের লক্ষ্য বা পুরুষার্থ হিসাবে স্বীকার করেন। কারণ চার্বাক দার্শনিকগনের কাছে ইন্দ্রিয় সুখ এবং ভোগই একমাত্র কামনার বস্তু। তাই এই দর্শনকে সুখবাদী (Hedonism) দর্শনও বলা হয়ে থাকে।

চার্বাক দর্শনের শিক্ষাগত তাৎপর্য | Educational Implications of Charvaka Philosophy

চার্বাক দর্শন নাস্তিক সম্প্রদায়ভুক্ত হলেও শিক্ষাগত দিক থেকে এটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তাই চার্বাক দর্শনের শিক্ষাগত তাৎপর্য বা শিক্ষাক্ষেত্রে চার্বাক দর্শনের প্রভাব যে সমস্ত দিক থেকে পরিলক্ষিত হয়, সেগুলি হল –

শিক্ষার লক্ষ্য ও চার্বাক দর্শন

আধুনিক শিক্ষার লক্ষ্য হল বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি। এগুলির মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আর্থসামাজিক উন্নতি সম্ভব। চার্বাক দর্শন বস্তুবাদী দর্শন। আর এর লক্ষ্য হল ব্যক্তির ও সমাজের বাস্তব ক্ষেত্রে উন্নতি সাধন।

তাই যে জ্ঞান ব্যক্তিকে সুখ স্বাচ্ছন্দের দিকে নিয়ে যায় তা অর্জন করা হল শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে চার্বাক দর্শনে অনুসরণ করা হয়। তাই চার্বাক দর্শন উপযোগিতাবাদী বা জীবন চর্চায় উপযোগিতা রয়েছে এমন তথ্যগুলি সংগ্রহ করে থাকে।

শিক্ষার পাঠক্রম ও চার্বাক দর্শন

শিক্ষার পাঠক্রম রচনার ক্ষেত্রে চার্বাক দর্শনের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দিক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ক চার্বাক দর্শন অনুযায়ী জীবনের সঙ্গে যুক্ত সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখার চর্চা ও জীবন উপযোগী কর্ম পাঠক্রমের স্থান পাবে।

শিক্ষার আধুনিক পাঠক্রম রচনার মূল নীতিগুলি পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, চার্বাক দর্শনের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এই নীতি গুলির প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। এই নীতিগুলি হল – কর্মকেন্দ্রিকতা, ব্যক্তির অভিজ্ঞতায় প্রাধান্য, বৃত্তিমুখীনতা, অবসর যাপনমূলক, বিভিন্ন শিল্পচর্চা প্রভৃতি।

শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতা ও চার্বাক দর্শন

শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে চার্বাক দর্শন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আধুনিক শিক্ষা ক্ষেত্রে শিশুর অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার বিকাশের জন্য স্বাধীনতা একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। তাই চার্বাক দর্শনের ব্যক্তির সচ্ছন্দ ও স্বাধীন বিকাশ পরিলক্ষিত হয়।

তাছাড়া জীবনের প্রেক্ষিতে শিক্ষার স্বরূপ নির্ণয়ের গভীর প্রভাব বিস্তার করে। তাই আধুনিক শিক্ষার লক্ষ্য যেখানে শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতা প্রদান করা সেখানে চারবার দর্শনের শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতা প্রদানের দিকটি শিক্ষাগত দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ।

ইন্দ্রিয়ের পরিমার্জনা ও চার্বাক দর্শন

চার্বাক দর্শন অনুযায়ী জ্ঞান লাভের অন্যতম উৎস হল প্রত্যক্ষ। তাই যা ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রত্যক্ষযোগ্য সেই জ্ঞানকে সত্য বলে স্বীকার করা হয়। আর যার ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রত্যক্ষ যোগ্য নয় সেই জ্ঞানের অস্তিত্ব নেই।

আবার আধুনিক শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ইন্দ্রিয় প্রশিক্ষণের উপর বিভিন্ন গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন। এদিক থেকে বলা যায় চার্বাক দর্শন ইন্দ্রিয়ের পরিমার্জনের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে থাকে। যা বর্তমান শিক্ষা ক্ষেত্রে অধিক গ্রহণযোগ্য।

উপসংহার (Conclusion)

পরিশেষে বলা যায়, চার্বাক দর্শনের নীতিগুলি শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ করে আধুনিক শিক্ষা ক্ষেত্রে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। অর্থাৎ চার্বাক মতে জীবন যাপনের পদ্ধতি হবে সহজ, স্বাভাবিক ও আনন্দময়, যা আধুনিক শিক্ষা ক্ষেত্রে অধিক গ্রহণযোগ্য। তাই চার্বাক দর্শনে আনন্দময় শিক্ষা পদ্ধতি বর্তমানে থর্নডাইকের শিখন পদ্ধতির মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

তথ্যসূত্র (References)

  • Aggarwal, J. C., Theory and Principles of Education. 13th Ed. Vikas Publishing House Pvt. Ltd.
  • V.R. Taneja, Educational Thoughts & Practice. Sterling Publication Pvt. Ltd. New Delhi
  • Nayak, B.K, Text Book of Foundation of Education. Cuttack, Odisha: KitabMhal
  • Ravi, S. Samuel, A Comprehensive Study of Education, Fourth Printing-May 2016, Delhi – 110092, ISBN – 978-81-203-4182-1,
  • Educational Implications of Charvaka Philosophy
  • Internet sources

প্রশ্ন – চার্বাক দর্শন প্রতিষ্ঠাতা কে

উত্তর – চার্বাক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন ঋষি চার্বাক।

প্রশ্ন – চার্বাক দর্শন কোন ধরনের দর্শন

উত্তর – চার্বাক দর্শন নাস্তিক দর্শন সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ চার্বাক দর্শন চরমপন্থী নাস্তিক বা অবৈধিক দর্শন সম্প্রদায়ভুক্ত দর্শন।

প্রশ্ন – চার্বাক দর্শনের অপর নাম কী

উত্তর – চার্বাক দর্শনের অপর নাম হল লোকায়ত বা লৌকিক দর্শন।

আরোও পড়ুন

Leave a Comment

close