সমাজ সংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান | Vidyasagar as a Social Reformer

ভারতবর্ষের শিক্ষা ক্ষেত্রে তথা সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে যে সমস্ত মনীষী এবং চিন্তাবিদগণ তাদের স্বাক্ষর রেখেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি ছিলেন রাজা রামমোহন রায়ের উত্তরসূরী। যিনি সমাজ সংস্কারে (Vidyasagar as a Social Reformer) বিশেষ অবদান রাখেন।

সামাজিক কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, গোড়ামী প্রভৃতি থেকে সমাজের মানুষদের মুক্তি দেয়ার জন্য বিদ্যাসাগর আজীবন লড়াই করে গেছেন। বিদ্যাসাগর একদিকে যেমন শিক্ষার বিস্তার সাধন করেছিলেন অন্যদিকে সমাজ সংস্কারে বাংলা তথা ভারত ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।

সমাজ সংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান |Vidyasagar as a Social Reformer

সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায়ের পর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন তৎকালীন সমাজ গঠনের অন্যতম কারিগর। সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া, অবহেলিত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত মানুষদের জন্য তিনি তার সর্বস্ব দিয়ে আত্মত্যাগ করেছিলেন।

বিদ্যাসাগর একদিকে শিক্ষা সংস্কার যেমন করেছিলেন অন্যদিকে সমাজ সংস্কারের কাজে ব্রতি হয়েছিলেন। সমাজ সংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান যে সমস্ত দিক থেকে বিদ্যমান, সেগুলি হল নিম্নলিখিত –

1. নারী শিক্ষার বিস্তার

সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন – মেয়েদেরকে শিক্ষা দিতে হবে। না হলে সমাজ উন্নতি হবে না। অর্থাৎ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, অবহেলিত নারী জাতির মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য বিদ্যাসাগর নারী শিক্ষার বিস্তার সাধনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

বিদ্যাসাগর নারী শিক্ষার বিস্তারের জন্য বিভিন্ন জেলায় পৃথক পৃথক নারী শিক্ষার বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮৫৭ সালে বিদ্যাসাগর যোগ আমি একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করে। বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় মোট ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। যেটি শিক্ষার ইতিহাসে এবং সমাজ সংস্কার বা নারী মুক্তির জন্য উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

2. বিধবা বিবাহ

তৎকালীন সমাজে স্বামী মারা গেলে নারীদেরকে আজীবন বৈধব্য জীবন পালন করতে হতো। কিন্তু বিদ্যাসাগর এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন এবং ফলস্বরূপ বিধবা বিবাহ প্রচলন করেন।

বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের ক্ষেত্রে হিন্দু শাস্ত্রের বিভিন্ন উক্তি তুলে প্রমাণ করেন যে শাস্ত্র অনুযায়ী বিধবা বিবাহ অনুচিত কর্ম নয়। অর্থাৎ হিন্দু শাস্ত্রে বিশেষ করে পরাশর সংহিতায় বিধবা বিবাহ দেওয়ার বিধান রয়েছে।

তাছাড়া বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এ বিষয়ে ১৮৫৫ সালে এতদবিষয়ক প্রস্তাব নামক পুস্তক রচনা করেন। এই পুস্তকটি তৎকালীন সময়ে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছিল এবং হাজার হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল।

তাই বিদ্যাসাগরের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ১৮৫৬ সালে জুলাই মাসে বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়। তিনি কেবলমাত্র আইন পাস করেননি তার একমাত্র পুত্রের সঙ্গে বিধবার বিবাহ দিয়ে প্রমাণ করেও দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে তাই সমাজ সংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়।

3. বহুবিবাহ নিবারণ

সমাজ সংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান গুলির মধ্যে অন্যতম হল বহুবিবাহ নিবারণ। তৎকালীন পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষেরা একের অধিক বিবাহ করতে পারত। কিন্তু বিদ্যাসাগর ১৮৫৬ সালে বহুবিবাহ নিবারণ আন্দোলনের সূচনা করেন। এবং বহুবিবাহ আন্দোলন অনেকাংশে সফল করে তোলেন।

4. বাল্যবিবাহ রোধ

বিদ্যাসাগরের সময়ে সমাজ ব্যবস্থায় বাল্যবিবাহ একটি সামাজিক ব্যাধি হিসেবে পরিগণিত হতো। বিদ্যাসাগর প্রথম তৎকালীন সময়ে বাল্যবিবাহ রোধে বিশেষ প্রচেষ্টা করেন। যেটি সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বিদ্যাসাগর নারী শিক্ষার মাধ্যমে এই বাল্যবিবাহ রোধ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। তিনি বলেন নারীরা শিক্ষিত হলে স্বাভাবিকভাবেই বাল্যবিবাহ রোধ হবে।

বাল্যবিবাহ রোধ করার স্বপক্ষে তিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও করতেন। তিনি ১৮৫০ সালে মতিলাল চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত সর্বশুভকরি পত্রিকায় ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ নামক প্রবন্ধ লেখার মাধ্যমে বাল্যবিবাহ সম্পর্কে প্রকটভাবে সমালোচনা করেন। সমাজ সংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান গুলির মধ্যে বাল্যবিবাহ রোধের প্রচেষ্টা হল অন্যতম।

5. সুরাপান নিবারণ

বিদ্যাসাগর ইয়ংবেঙ্গলদের প্রগতিশীল চিন্তা ও তাদের কুসংস্কারমূলক দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করলেও তাদের আচার ব্যবহার মোটেই সমর্থন করতেন না। বিশেষ করে তৎকালীন ইয়ংবেঙ্গল দের অনাচার এবং সুরাপানকে বিদ্যাসাগর মোটেই পছন্দ করতেন না।

তিনি এটিকে সামাজিক অবক্ষয় হিসেবে সমালোচনা করতেন। তাই ১৮৬৪ সালে প্যারীচরণ সরকার সুরাপান বিরোধী একটি সমিতি স্থাপন করেন, যেখানে বিদ্যাসাগর সক্রিয় সদস্য হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

উপসংহার (Conclusion)

সর্বোপরি বলা যায়, বিদ্যাসাগরের সময়ে সমাজে যে সমস্ত কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাস দানা বেঁধেছিল ও বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষেরা লাঞ্ছিত, বঞ্চিত হতো, বিশেষ করে নারী জাতি তাদের প্রতি বিদ্যাসাগরের মানবদরদি মনের পরিচয় পাওয়া যায়।

তাই বিদ্যাসাগর এই সমস্ত মানুষদের তথা সমাজের উন্নতির জন্য বিভিন্ন সমাজ সংস্কার মূলক (Vidyasagar as a Social Reformer) কাজে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। তাই তাই গ্রামাঞ্চলের শিক্ষা প্রসার এবং সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের অবদান আজও স্মরণীয় হয়ে আছে, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

তথ্যসূত্র (References)

  • Ravi, S. Samuel, A Comprehensive Study of Education, Fourth Printing-May 2016, Delhi – 110092, ISBN – 978-81-203-4182-1
  • Education in India-Past-Present-Future, Vol. I and II, J. P. Banerjee
  • Landmarks in the History of Modern Indian Education, J. C. Aggarwal
  • Internet Sources

প্রশ্ন – বিদ্যাসাগর কে কেন বাংলার অন্যতম সমাজ সংস্কারক বলা হয়?

উত্তর – রাজা রামমোহন রায়ের পর বিদ্যাসাগর তৎকালীন ঘুণ ধরা, কুসংস্কার যুক্ত এবং অন্ধবিশ্বাস যুক্ত সমাজকে মুক্তির আলো দেখিয়েছিলেন। অর্থাৎ বিদ্যাসাগর নারী শিক্ষার বিস্তার, বহুবিবাহ প্রচলন এবং আইন পাস, বাল্যবিবাহ রোধ, সুরাপান রোধ প্রভৃতির মাধ্যমে সমাজকে নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। তাই বিদ্যাসাগরকে বাংলার অন্যতম সমাজ সংস্কার বলা হয়।

প্রশ্ন – ব্যাকরণ কৌমুদী গ্রন্থের রচয়িতা কে?

উত্তর – ব্যাকরণ কৌমুদী গ্রন্থের রচয়িতা হলেন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর। বাংলা ভাষায় সংস্কৃত ব্যাকরণ পুস্তকের অভাব থাকায় তিনি সহজ সরল ভাষায় সংস্কৃত শিক্ষার জন্য ব্যাকরণ কৌমুদী গ্রন্থের রচনা করেন।

প্রশ্ন – বিধবা বিবাহ প্রথা চালু করেন কে?

উত্তর – বিধবা বিবাহ প্রথা চালু করেন শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারক ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগরের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ১৮৫৬ সালে জুলাই মাসে বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়। তিনি কেবলমাত্র আইন পাস করেননি তার একমাত্র পুত্রের সঙ্গে বিধবার বিবাহ দিয়ে প্রমাণ করেও দিয়েছিলেন।

প্রশ্ন – বিধবা বিবাহের ধারণা কি

উত্তর – বিবাহের কিছুদিন পর বা বিবাহের পর কোন স্ত্রীলোকের স্বামী মারা গেলে পুনরায় তাকে সামাজিক নিয়মের মধ্যে বিয়ে দেওয়াকে বিধবা বিবাহ বলে। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর সর্বপ্রথম ভারতবর্ষে বিধবা বিবাহের ধারণার প্রবর্তন করেন।

প্রশ্ন – বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কারমূলক গ্রন্থ

উত্তর – বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কারমূলক গ্রন্থ হল – বাল্যবিবাহের দোষ (প্রবন্ধ), বিধবা বিবাহ উচিত কিনা এ বিষয়ে এতদবিষয়ক প্রস্তাব নামক গ্রন্থ প্রভৃতি।

আরোও পড়ুন

Leave a Comment

close