ভারতবর্ষের ইতিহাসে শিক্ষা সংস্কার ও সমাজ সংস্কারের কাজে যে সমস্ত মহান মানুষের কৃতিত্ব এবং অবদান রয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম হল নবজাগরণের অন্যতম প্রাণপুরুষ রাজা রামমোহন রায় (Raja Rammohan Roy Contribution)।
আধুনিক ভারতবর্ষের জনক, ভারত পথিক এবং নবজাগরণের সূচনাকারী রাজা রামমোহন রায়, ১৭৭৪ সালে 22শে মে হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামে রক্ষণশীল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেনরামকান্ত রায় এবং মা ছিলেন তারিনী দেবী। ছোটবেলা থেকে রাজা রামমোহন রায় খুব মেধাবী ছিলেন। তিনি পাটনা ও কাশিতে গিয়ে সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি ভাষায় উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন।
সমাজ ও শিক্ষা সংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান | Raja Rammohan Roy Contribution
ভারতবর্ষের সমাজ এবং শিক্ষার সংস্কারে বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ প্রমূখ তাদের অবদানের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। আর এই সমস্ত মনীষীদের মধ্যে অন্যতম হলেন রাজা রামমোহন রায়।
রাজা রামমোহন রায় হিন্দু ধর্মের গোড়ামী ও কুসংস্কারের প্রতি প্রতিবাদ করার পিতার সঙ্গে তার মনোমালিন্য তৈরি হয়। এর ফলে তিনি নিজ গৃহ ত্যাগ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ান। পরবর্তীকালে তিনি বিভিন্ন সমাজ সংস্কারের কাজে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেন।
সমাজ ও শিক্ষা সংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান এবং কৃতিত্ব নিম্নে আলোচনা করা হল –
সমাজ সংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান
তৎকালীন ভারতবর্ষের সমাজব্যবস্থা ছিল বিভিন্ন অন্ধবিশ্বাস এবং কুসংস্কারের দ্বারা নিমজ্জিত। যেমন – গঙ্গায় সন্তানকে বিসর্জন, সতীদাহ প্রথা, নারীদের রক্ষণশীলতা প্রভৃতি। এই রকম অন্ধকারচ্ছন্ন এবং কুসংস্কার যুক্ত সমাজের আমুল সংস্কারের মূল কান্ডারী হলেন রাজা রামমোহন রায়।
সমাজ সংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান যে সমস্ত দিক থেকে পরিলক্ষিত হয়, সেগুলি হল –
1. সতীদাহ প্রথা রদ
রাজা রামমোহন রায়ের সমাজ সংস্কার মূলক কাজের মধ্যে অন্যতম এবং গুরুত্বপূর্ণ হল তৎকালীন হিন্দু সমাজে প্রচলিত নিষ্ঠুর এবং অমানবিক প্রতিদাহ প্রথার রদ বা বিলোপ সাধন।
হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী বা ব্রাহ্মণদের বিধান অনুযায়ী স্বামীর মৃত্যুর পর তার সহধর্মীকে সহমরণে যেতে হতো। এটি ছিল তৎকালীন সমাজের সতীদাহ প্রথা।
রাজা রামমোহন রায় কঠোর সংগ্রামের ফসল হিসেবে ১৮২৯ সালে ৪ই ডিসেম্বর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিং সতীদাহ প্রথাকে আইন করে বন্ধ করেন। তাই সতিদাহ প্রথা রদের মাধ্যমে সমাজ সংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
2. ধর্ম সংস্কার
রাজা রামমোহন রায় ধর্ম সংস্কারের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। তিনি হিন্দু ধর্মের যাবতীয় কুসংস্কার যুক্ত ধর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। বিশেষ করে মূর্তি পূজা, পৌত্তলিকতা প্রভৃতিকে কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। অর্থাৎ ধর্ম সংস্কারের মাধ্যমে সমাজ সংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান উল্লেখযোগ্য।
3. নারীর অধিকার রক্ষা
তৎকালীন সময়ে সমাজে নারীদের কোনো অধিকার ছিল না। রাজা রামমোহন রায় নারীর অধিকার রক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রচেষ্টা চালিয়ে যান এবং তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। বিশেষ করে সমাজে নারীর উপযুক্ত স্থান এবং সম্পত্তিতে নারীর অধিকারের জন্য রামমোহন রায় বিশেষ প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন।
এ ছাড়া তৎকালীন সমাজে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ প্রভৃতির প্রতি রামমোহন রায় তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। যেগুলি পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় বন্ধ হয়েছিল।
4. জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা
তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় জাতিভেদ প্রথা তীব্র আকার ধারণ করেছিল। অর্থাৎ সমাজে নিচু জাত, উঁচু জাত এইভাবে বিচার বিবেচনা করা হতো। এমনকি নিচু জাতের মানুষদের সমাজে কোন অধিকার ছিল না। তারা সর্বদা লাঞ্ছিত, বঞ্চিত এবং অবহেলিত হতেন। রাজা রামমোহন রায় এই অমানবিক জাতিভেদ কথার বিরোধিতা করেন।
5. অন্ধধর্ম বিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরোধিতা
রাজা রামমোহন রায় একদিকে যেমন জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা করেছিলেন। তেমনি অন্যদিকে সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার রোধ করার চেষ্টা করেছিলেন। এদের মধ্যে অন্যতম হল – গঙ্গায় সন্তানকে বিসর্জন, সতীদাহ প্রথা, নারীদের রক্ষণশীলতা প্রভৃতি
শিক্ষা সংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান
রাজা রামমোহন রায় কেবলমাত্র সমাজ সংস্কারে সচেষ্টা হয়েছিলেন তা নয়। পাশাপাশি তিনি শিক্ষা সংস্কারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি মনে করতেন সমাজে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রসার না করলে সমাজ সংস্কার বা সমাজের উন্নতি কখনোই সম্ভব নয়।
শিক্ষা সংস্কারের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান, যে সমস্ত দিক থেকে পরিলক্ষিত হয় সেগুলি হল –
1. শিক্ষার প্রসার
সমাজে শিক্ষার প্রসার ঘটনার ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা অনবদ্য। তিনি শিক্ষার মাধ্যমে তৎকালীন সমাজকে কুসংস্কার মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তাই রাজা রামমোহনের মতে শিক্ষার লক্ষ্য হবে –
i) জাগতিক এবং সমাজকল্যাণমূলক,
ii) শিক্ষার মাধ্যমে কুসংস্কার দূর করা,
iii) যুক্তিবাদী মানসিকতা গঠন,
iv) ব্যক্তির পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন ও উন্নয়ন প্রভৃতি।
2. নারী শিক্ষার প্রসার
তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের শিক্ষার কোনো অধিকার ছিল না। ফলে নারীরা শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। তাই রাজা রামমোহন রায়ের অন্যতম ভূমিকা হল নারী শিক্ষার প্রসার ঘটানো।
নারী শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন। নারী শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে তিনি হিন্দু শাস্ত্রের বিভিন্ন অংশকে বিশ্লেষণ করে সমাজকে জাগিয়ে তুলেছিলেন।
3. পত্রপত্রিকা প্রকাশ
রামমোহন রায় বিভিন্ন পত্রপত্রিকার মাধ্যমে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার সমালোচনা করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন আধুনিক চেতনা সম্পন্ন সমাজ গঠন করতে।
এর জন্য তিনি বাংলা ভাষায় ‘সংবাদ কৌমুদী’ এবং ফারসি ভাষায় ‘মিরাৎ-উল-আকবর’ নামক দুটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। এখানে তিনি বিভিন্ন বিতর্কমূলক ও সমালোচনামূলক প্রবন্ধ প্রকাশ করতেন।
4. বিদ্যালয় স্থাপন
শিক্ষা সংস্কারের ক্ষেত্রে রামমোহন রায় বিভিন্ন বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এর মধ্যে ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে ‘ অ্যাংলো হিন্দু স্কুল’ স্থাপন করে। তাছাড়া শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান করার জন্য বিভিন্ন বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
5. বাংলা সাহিত্যের উন্নয়ন
শিক্ষার প্রচার ও প্রসারের জন্য তিনি বাংলা সাহিত্যের উন্নয়নের প্রতি মনোযোগী হন। তিনি বিভিন্ন গ্রন্থ অনুবাদ ও রচনা করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – বেদ-বেদান্ত, উপনিষদের অনুবাদ, এবং কুসংস্কারের প্রতি লেখা অন্যতম হল গৌড়ীয় ব্যাকরণ।
6. প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষার সমন্বয়
পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে রামমোহন রায়ের ভূমিকা ছিল অনবদ্য। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষার মধ্যে সমন্বয় সাধনের কথা বলেন। এর ফলে একদিকে যেমন ভারতীয় প্রাচীন সংস্কৃতির সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে, অপরদিকে তেমনি পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষা হবে বিজ্ঞান সম্মত। তাই শিক্ষা সংস্কারক হিসেবে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার এবং সমোন্নয়নের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা অনবদ্য।
7. ইংরেজি ভাষার চর্চা ও প্রসার
পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায় ইংরেজি ভাষার চর্চা ও প্রসারের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি দেখেছিলেন ইউরোপের নবজাগরণের প্রধান দিক হল ইংরেজি শিক্ষা। এইজন্য 1823 সালে রামমোহন লর্ড আমহাস্টের কাছে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের জন্য আর্থিক সাহায্য চেয়েছিলেন।
তাই রাজা রামমোহন রায় তৎকালীন সমাজে শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষা চর্চা ও প্রসারের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।
উপসংহার (Conclusion)
সর্বোপরি বলা যায়, ভারত পথিক রামমোহন রায় ছিলেন তৎকালীন অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার জর্জরিত সমাজ ব্যবস্থার উন্নতির প্রধান কারিগর। তিনি সামাজিক বিভিন্ন ব্যাধি থেকে সমাজের মানুষকে মুক্ত করতে বিশেষভাবে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তাই অনেকে রাজা রামমোহন রায়কে নবজাগরণের প্রধান প্রাণপুরুষ হিসাবে গণ্য করে থাকেন। এদিক থেকে শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান (Raja Rammohan Roy Contribution) অনস্বীকার্য।
রাজা রামমোহন রায়ের কৃতিত্ব সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাজা রামমোহন রায়কে ‘ভারতপথিক’ বলে সম্বোধন করেছিলেন।
আবার, বিপিনচন্দ্র পাল বলেছেন – “ভারতবর্ষের শিক্ষার ইতিহাসে রাজা রামমোহন রায় আধুনিকতার অগ্রদূত”।
তথ্যসূত্র (References)
- Ravi, S. Samuel, A Comprehensive Study of Education, Fourth Printing-May 2016, Delhi – 110092, ISBN – 978-81-203-4182-1
- Education in India-Past-Present-Future, Vol. I and II, J. P. Banerjee
- Landmarks in the History of Modern Indian Education, J. C. Aggarwal
- Internet Sources
প্রশ্ন – বাংলার নবজাগরণের জনক কে?
উত্তর – বাংলার নবজাগরণের জনক রাজা রামমোহন রায়কে বলা হয়। কারণ তিনি তৎকালীন সময়ে সমাজ ব্যবস্থার সংস্কারে অগ্রসর হয়েছিলেন। যার ফলস্বরূপ সমাজে বিভিন্ন কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, সতীদাহ প্রথা রদ প্রভৃতি সম্ভব হয় এবং ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধিত হয়।
আরোও পড়ুন
- স্বামী বিবেকানন্দের মানুষ গড়ার শিক্ষা সংক্রান্ত ধারণাটি ব্যাখ্যা করো | Man Making Education
- মহাত্মা গান্ধীর শিক্ষা দর্শন | Mahatma Gandhi Philosophy of Education
- সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন শিক্ষা দর্শন | Contribution of Radhakrishnan in Education
- হার্বাট স্পেন্সারের শিক্ষা চিন্তা | Herbert Spencer Contribution to Education
- প্লেটোর শিক্ষা দর্শন ও শিক্ষা তত্ত্ব | Plato Philosophy of Education
- ফ্রয়েবেলের শিক্ষা দর্শন বা শিক্ষা চিন্তা | Froebel Contribution to Education