Share on WhatsApp Share on Telegram

শিক্ষায় স্বামী বিবেকানন্দের অবদান | Swami Vivekananda’s Contribution to Education

Join Our Channels

ঊনবিংশ শতকের বিভিন্ন মনীষীদের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দ ছিল শিক্ষার অন্যতম অগ্রদূত। যিনি ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও ভারতবর্ষের সমাজকে শিক্ষার মাধ্যমে জ্ঞানের আলো জ্বালাতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষা চিন্তা বা শিক্ষায় স্বামী বিবেকানন্দের অবদান (Swami Vivekananda’s Contribution to Education) আজও বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে।

শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের প্রিয় শিষ্য ও যুগপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন উনবিংশ শতকের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। যার আলোতে আলোকিত হয়ে সমাজ ব্যবস্থা আলোকিত হয়েছিল। অর্থাৎ শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের গতি নির্ধারণ হয়েছিল। স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের কলকাতার সিমলায় দত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম ছিল বিশ্বনাথ দত্ত ও মাতা ছিলেন ভুবনেশ্বরী দেবী। এখানে শিক্ষায় স্বামী বিবেকানন্দের অবদান উল্লেখ করা হল।

শিক্ষায় স্বামী বিবেকানন্দের অবদান (Swami Vivekananda’s Contribution to Education)

শিক্ষায় স্বামী বিবেকানন্দের অবদান বিভিন্ন দিক থেকে বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। যে সমস্ত দিক থেকে স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষায় অবদান পরিলক্ষিত হয়, সেগুলি হল –

1. বিবেকানন্দের মতে শিক্ষার লক্ষ্য

স্বামী বিবেকানন্দের মতে – শিক্ষার লক্ষ্য হল শিশুর অন্তর্নিহিত সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন। (“Education is the manifestation of perfection already in man.”) অর্থাৎ শিশুর মধ্যে যে সুপ্ত সম্ভাবনা আগে থেকে বিদ্যমান তার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন হল শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য।

বিবেকানন্দের মতে শিক্ষার লক্ষ্য দুই প্রকার, যথা –

i) শিক্ষার আপাত লক্ষ্য – শিক্ষার আপাত লক্ষ্যের মধ্যে অন্যতম হল – দৈহিক বিকাশ সাধন, মানসিক বিকাশ সাধন, চারিত্রিক বিকাশ সাধন, বৃত্তি শিক্ষা প্রদান প্রভৃতি এবং

ii) শিক্ষার চরম লক্ষ্য – শিক্ষার চরম লক্ষ্যের মধ্যে অন্যতম হল – ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধন, নিজের প্রতি বিশ্বাস বা আত্মবিশ্বাস গঠন, আত্ম উপলব্ধি প্রভৃতি।

2. শিক্ষার পাঠক্রম

শিক্ষায় স্বামী বিবেকানন্দের অবদান এর মধ্যে অন্যতম হল শিক্ষার পাঠক্রম। পাঠক্রম হিসেবে স্বামী বিবেকানন্দ বলেন – নতুন প্রজন্মের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলীর বিকাশ সাধনের যাবতীয় উপাদান পাঠক্রমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

স্বামী বিবেকানন্দের মতে, পাঠক্রমের মধ্যে যে সমস্ত বিষয় থাকবে সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – ভাষা বা সাহিত্য, শারীরিক শিক্ষা, বৃত্তিমূলক শিক্ষা, সংগীত, নাটক, অংকন প্রভৃতি।

তাছাড়া নারী শিক্ষার জন্য বিবেকানন্দ ভারতীয় ধর্মশাস্ত্র, সংস্কৃত ভাষা, ব্যাকরণ, হাতের কাজ, গৃহ পরিচর্যার কাজ, সেলাইয়ের কাজ প্রভৃতি পাঠক্রমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছেন।

3. শিক্ষক

শিক্ষক সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দ গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রদান করেন। তিনি বলেন শিক্ষক হবেন তপস্বীর মতন। যাকে অনুসরণ করার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীর পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন সম্ভবপর হবে।

তিনি আরোও বলেন শিক্ষক হবেন জ্ঞানবান, চরিত্রবান ও মানবতাবাদী। তার মতে একজন আদর্শ শিক্ষকের যা যা গুণাবলী প্রয়োজন সবকিছু শিক্ষকের মধ্যে থাকতে হবে।

শিক্ষক সম্পর্কে স্বামীজি আরো বলেন – শিক্ষক হবেন সর্বত্যাগী ও সর্বজ্ঞ জ্ঞানের অধিকারী। শিক্ষকের মধ্যে কোনো মোহ থাকবে না। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে সাহায্য করবে। শিক্ষকের মধ্যে, নাম, যশ ও সম্পদের প্রতি আকাঙ্ক্ষা থাকবে না।

4. শিক্ষক শিক্ষার্থীর সম্পর্ক

স্বামী বিবেকানন্দের মতে – শিক্ষক শিক্ষার্থীর সম্পর্ক হবে পিতা পুত্রের ন্যায় মধুর প্রকৃতির এবং বন্ধুসুলভ। শিক্ষা ক্ষেত্রে তাই শিক্ষক শিক্ষার্থীরদের মধ্যে তিনি সম্পর্ক যাতে বজায় থাকে এসবের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করার কথা বলা হয়।

বিবেকানন্দের মতে, শিক্ষকের কাজ হবে শিক্ষার্থীদের সুঅভ্যাস গঠন করা, চরিত্র গঠনে সাহায্য করা, অপরকে শ্রদ্ধা করা বা গুরুজনকে সম্মান করা, সমাজসেবায় অংশগ্রহণ করা প্রভৃতি।

5. শিক্ষাদান পদ্ধতি

শিক্ষায় স্বামী বিবেকানন্দের অবদান গুলির মধ্যে শিক্ষাদান পদ্ধতি একটি বিশেষ দিক। শিক্ষাদান পদ্ধতির মধ্যে স্বামীজি ‘একাগ্রতার’ ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাই তিনি বলেন কেন যেন অন্যতম পদ্ধতি হল একাগ্রচিত্র (Concentration) হওয়া।

স্বামী বিবেকানন্দ শিক্ষাদান পদ্ধতির মধ্যে আরও যে সমস্ত পদ্ধতি উল্লেখযোগ্য তা হল – আত্ম উপলব্ধির মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান, আলোচনা পদ্ধতি, অনুকরণ পদ্ধতি, বক্তৃতা পদ্ধতি, সক্রিয়তা ভিত্তিক পদ্ধতি প্রভৃতি।

বিবেকানন্দের শিক্ষা পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করলে বলা যায় যে – আধুনিক কালের আবিষ্কার পদ্ধতির সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষা পদ্ধতি সাদৃশ্য বর্তমান। তার শিক্ষাদান পদ্ধতিতে শিক্ষক শিশুর মধ্যে অনুসন্ধানের বা অনুসন্ধান স্পৃহা জাগিয়ে তুলতে সচেষ্ট হবেন। যার ফলে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই শিক্ষকের তত্ত্বাবধান ব্যতীত শিক্ষাদান কার্য সম্পন্ন করতে পারবে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা চিন্তা

6. শৃঙ্খলা

শিক্ষায় স্বামী বিবেকানন্দের অবদান মধ্যে অন্যতম হল শৃঙ্খলা। স্বামীজীর মতে শিক্ষায় সুশৃংখলার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জন করবে।

অর্থাৎ সামাজিক শিক্ষা চিন্তায় শৃঙ্খলার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তাই তিনি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ব্রহ্মচর্য পালনের কথা বলে থাকেন।

7. বিবেকানন্দের মতে গণশিক্ষা বা জনশিক্ষা

শিক্ষায় স্বামী বিবেকানন্দের অবদান এর মধ্যে অন্যতম হল গণশিক্ষা বা জনশিক্ষা। অর্থাৎ স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষা চিন্তায় গণশিক্ষা বা জনশিক্ষার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তিনি বলেন – জনগণকে সুশিক্ষিত না করতে পারলে সমাজের অগ্রগতি কখনোই সম্ভব নয়। জনশিক্ষার ফলে নতুন ভারতের জন্ম হবে এ কথা স্বামীজি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন।

তাই তিনি বলেছিলেন – “নতুন ভারত বেরুক – বেরুক নাঙল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে, মুচি, মেথরের ঝুবড়ির মধ্য হতে, মুদির দোকান থেকে, বেরুক কারখানা থেকে, হাট বাজার থেকে, ঝোপ জঙ্গল আর পাহাড় পর্বত থেকে”।

8. বিবেকানন্দের মতে নারী শিক্ষা

শিক্ষায় স্বামী বিবেকানন্দের অবদান হল নারী শিক্ষার বিস্তার সাধন করা। তাই নারী শিক্ষার বিস্তার সাধনের ক্ষেত্রে স্বামীজীর অসামান্য অবদান পরিলক্ষিত হয়। বিবেকানন্দ বলেছিলেন – মেয়েদের জন্য গ্রামে গ্রামে পাঠশালা খুলে তাদের মানুষ করতে হবে। মেয়েরা মানুষ হলে তবেই তাদের সন্তান-সন্ততির দ্বারা দেশের মুখ উজ্জ্বল হবে।

নারী শিক্ষা প্রসঙ্গে বিবেকানন্দ বলেছিলেন – একটি ডানার সাহায্যে পাখিরা যেমন আকাশে উড়তে পারেনা, ঠিক তেমনি কেবলমাত্র পুরুষজাতি শিক্ষিত হলে সমাজ কখনো চলতে পারে না। তাই শিক্ষার মাধ্যমে মেয়েদেরকে এগিয়ে আনতে হবে।

নারী শিক্ষার পাঠক্রম হিসাবে স্বামীজি বলেন ধর্ম, শিল্প, বিজ্ঞান, গার্হস্থ্য বিজ্ঞান, রন্ধন বিদ্যা, ভাষা, সাহিত্য, গনিত, শারীর বিদ্যা প্রভৃতি পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

আরোও পোস্ট পড়ুন – Click Here Now

9. ভাষা শিক্ষা

স্বামীজি শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। কিন্তু পাশাপাশি পাশ্চাত্য বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য ইংরেজি ভাষার প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন।

তাছাড়া বিবেকানন্দ আরো বলেন – প্রাচীন ভারতের শাস্ত্র ভান্ডারে যে সমস্ত সুগভীর তত্ত্ব সঞ্চিত আছে সেগুলিকে যথাযথভাবে জনসাধারণের সামনে নিয়ে আসতে হবে। অর্থাৎ মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার মধ্য দিয়ে শিক্ষার বিস্তার সাধন ঘটাতে হবে।

10. কারিগরি ও বৃত্তিশিক্ষা

বিবেকানন্দ কেবলমাত্র প্রথাগত শিক্ষার কথা বলেননি। তিনি শিক্ষায় কারিগরি ও বৃত্তি শিক্ষা কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি একান্তভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে ভারতবাসীকে কেবল শিক্ষার মাধ্যমে এগিয়ে আনা সম্ভব নয় পাশাপাশি কারিগরি ও বৃত্তি শিক্ষার মাধ্যমে স্বনির্ভর করে তুলতে হবে।

নারী শিক্ষায় রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকানারী শিক্ষায় বিদ্যাসাগরের ভূমিকা
নারী শিক্ষা বিষয়ে ভক্তবৎসলম কমিটির সুপারিশনারী শিক্ষা সংক্রান্ত হংসরাজ মেহেতা কমিটির সুপারিশ
নারী শিক্ষায় দূর্গাবাঈ দেশমুখ কমিটির সুপারিশনারী শিক্ষায় মিশনারীদের অবদান

উপসংহার (Conclusion)

সর্বোপরি বলা যায়, শিক্ষায় স্বামী বিবেকানন্দের অবদান (Swami Vivekananda’s Contribution to Education) বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে। তিনি শুধু আধ্যাত্মবাদী ছিলেন তা নয়, তিনি ভারতবর্ষকে বিশ্বের কাছে বা বিশ্বের দরবারে পরিচিতি করার জন্য শিক্ষার প্রচার ও প্রসার করেছিলেন। দরিদ্র, নিপীড়িত ভারতবর্ষের আদর্শ শিক্ষা কি হবে, শিক্ষার লক্ষ্য কি হবে, নারী শিক্ষা কিভাবে সম্পন্ন হবে সেগুলি যথাযথভাবে স্বামীজি উল্লেখ করেছেন।

তাই তিনি বলেছিলেন – ‘ভারত আবার উঠিবে, কিন্তু জড়ের শক্তিতে নয়, চৈতন্যের শক্তিতে। বিনাশের বিজয় পতাকা লইয়া নয়, শান্তি ও সত্যের পতাকা লইয়া’।

তথ্যসূত্র (References)

  • Ravi, S. Samuel, A Comprehensive Study of Education, Fourth Printing-May 2016, Delhi – 110092, ISBN – 978-81-203-4182-1
  • Internet Sources

প্রশ্ন – বিবেকানন্দের মতে শিক্ষার লক্ষ্য কি

উত্তর – বিবেকানন্দের মতে শিক্ষার লক্ষ্য হল শিশুর মধ্যে যে অন্তর্নিহিত সত্তা আগে থেকে বিদ্যমান তার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন করা।

প্রশ্ন – স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষাচিন্তায় একাগ্রতার উপর কেন গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে

উত্তর – স্বামীজি বলেছিলেন একাগ্রতার মাধ্যমে শিক্ষায় সম্পূর্ণ মননিবেশ করা সম্ভবপর হয়। অর্থাৎ একাগ্রতা সাফল্যের চাবিকাঠি। তাই স্বামী বিবেকানন্দ তার শিক্ষা চিন্তায় শিক্ষার্থীদের একাগ্রতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।

প্রশ্ন – ‘মানুষ গড়ার শিক্ষা’ বলতে কী বোঝায়

উত্তর – বিবেকানন্দের মানুষ গড়ার শিক্ষা হল প্রকৃত মানুষ তৈরি করা। কারণ তিনি বলেছিলেন প্রকৃত মানুষ সমাজ গঠনের কারিগর। তাই সমাজের সর্বস্তরের মানুষের শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের হিত সাধন করা ছিল মানুষ গড়ার শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য।
বিবেকানন্দের মানুষ গড়ার শিক্ষা সংক্রান্ত ধারণাটি বিস্তারিত জানতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন – Click here

আরোও পড়ুন

5/5 - (5 votes)

Author Photo

Mr. Debkumar – Founder of Edutiips.com

A teacher and author of several books published by Aheli Publication, including Communication Skills, Aspect of Democratic Citizenship, Sociological Foundation of Education, Computer Applications, Fundamentals of Education, Educational Organization and Planning, and Educational Research.

3 thoughts on “শিক্ষায় স্বামী বিবেকানন্দের অবদান | Swami Vivekananda’s Contribution to Education”

Leave a Comment

close