শিশুর সামাজিকীকরণে পরিবারের ভূমিকা (Role of Family in Socialization Process)

সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া এমন যেটি শিশুর জন্মমুহূর্ত থেকে শুরু হয় এবং সারা জীবন পর্যন্ত চলতে থাকে। সমাজের সঙ্গে শিশুর পারস্পরিক মেলবন্ধনই হল সামাজিকীকরণ। শিশুর সামাজিকীকরণে পরিবার (Role of Family in Socialization Process) বিভিন্ন দিক থেকে অনবদ্য ভূমিকা পালন করে।

সামাজিকীকরণ (Samajikikoron) এর ইংরেজি অর্থ হল – ‘Socialization’. জন্ম মুহূর্তে শিশুরা থাকে সম্পূর্ণ অসহায়। আর অসহায় শিশুকে পরিবার তার স্নেহের বাঁধনে শিশুকে বেঁধে ফেলে এবং ধীরে ধীরে শিশুকে বড় করার মধ্য দিয়ে তাকে সামাজিক করে গড়ে তোলে। সাধারণ অর্থেসামাজিকীকরণ হল সমাজের সঙ্গে বা পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা।

পরিবারের সংজ্ঞা (Definition of Family)

বিভিন্ন সমাজতাত্ত্বিক বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবারকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। সেগুলি হল –

1. Maclver বলেছেন – পরিবার হল যৌন সম্পর্ক দ্বারা সংজ্ঞায়িত একটি গোষ্ঠী, যা শিশুদের প্রজনন এবং লালন-পালনের জন্য যথেষ্ট সুনির্দিষ্ট এবং স্থায়ী। (“Family is a group defined by sexual relationship, sufficiently precise and enduring to provide for the procreation and upbringing of children.”)

2. Kingsley Davis বলেছেন – “Family is a group of persons, whose relations to one another are based upon con­sanguinity and who are therefore kin to one another.”

3. Eliot and Merrill বলেছন – ‘Family is the biological social unit composed of husband, wife and children.’ অর্থাৎ পরিবার হল স্বামী, স্ত্রী ও সন্তানদের সমন্বয়ে গঠিত জৈবিক সামাজিক একক।

সামাজিকীকরণের ধারণা (Concept of Socialization Process)

সামাজিকীকরণ (Samajikikoron) পরিবর্তনশীল সমাজের সঙ্গে সার্থক অভিযোজনের মাধ্যমে শিশুকে উপযুক্ত হিসেবে গড়ে তোলে। অর্থাৎ সামাজিকীকরণ হল শিশুকে সতত পরিবর্তনশীল সমাজের সঙ্গে অভিযোজনে বিশেষভাবে সহায়তা করা।

এই সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিশু সমাজ ও সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক যেমন – সামাজিক রীতিনীতি, সামাজিক নিয়ম-শৃঙ্খলা, মূল্যবোধ, প্রভৃতি বিষয় সহজে আয়ত্ত করার মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণ মানুষ হিসাবে গড়ে ওঠে।

শিশু জন্ম মুহূর্তে সামাজিক হয়ে জন্মগ্রহণ করে না। শিশু যে পরিবেশে বা যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করে সেই পরিবেশ ও পরিবার শিশুকে সমাজ উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলে।

অর্থাৎ সমাজের নিয়ম কানুন, আচার-আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ, নৈতিকতা প্রভৃতির উপযুক্ত বিকাশের মধ্য দিয়ে শিশুকে সমাজ উপযোগী বা সামাজিকীকরণে বিশেষভাবে সাহায্য করে।

সামাজিকীকরণের সংজ্ঞা (Definition of Socialization Process)

বিভিন্ন সমাজতাত্ত্বিক বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সামাজিকীকরণকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। সেগুলি হল –

1. সামাজিকীকরণের সংজ্ঞা হিসেবে বিশিষ্ট সমাজবিদ কিংসলে ডেভিসের (Kingsley Device) বলেছেন – সামাজিকীকরণ হল এমন পদ্ধতি যার মাধ্যমে মানব শিশু ক্রমশ সামাজিক মানুষে পরিণত হয়ে ওঠে।

2. আবার পিটার ওরস্‌লে (Peter Worsley) – এর মতে, “Socialization as the process of transmission of culture the process whereby men learn the rules and practices of social group.”

শিশুর মাজিকীকরণে পরিবারের ভূমিকা (Role of Family in Socialization Process)

Role of Family in Socialization Process
Role of Family in Socialization Process

শিশুর সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে শিশুকে বিশেষভাবে সাহায্য করে পরিবার (Family), বিদ্যালয় (School) বন্ধু দল, প্রতিবেশী প্রভৃতি। শিশুর সামাজিকীকরণে পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

শিশুর সামাজিকীকরণে পরিবারের ভূমিকা (Role of Family in Socialization Process) যে সমস্ত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলি আলোচনা করা হল –

1. দৈহিক নিরাপত্তা দান

জন্ম মুহূর্তে শিশু থাকে অসহায় ও সহায় সম্বলিহীন। আর এই অসহায় শিশুকে দৈহিক নিরাপত্তা দানের মধ্য দিয়ে পরিবার শিশুকে যথাযথ সামাজিকীকরণে (Socialization) সহায়তা করে থাকে।

অর্থাৎ দৈহিক নিরাপত্তা দানের মধ্য দিয়ে পরিবার শিশুকে সমাজ উপযোগী করে গড়ে তোলে। তাই দৈহিক নিরাপত্তা দানের মধ্য দিয়ে শিশুর সামাজিকীকরণে পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

2. জৈবিক চাহিদার পরিপূরণ

পরিবার শিশুকে প্রাথমিক জৈবিক চাহিদাগুলি (যেমন – খাদ্য, ঘুম ও বাসস্থান) পরিপূরণের মধ্য দিয়ে ছোট থেকে বড় করে তোলে। অর্থাৎ পরিবার হল শিশুর প্রথম অভিভাবক।

পরিবারের মধ্য দিয়েই শিশু তার জৈবিক চাহিদাগুলির যথাযথ পূরণ করতে সক্ষম হয়। সুতরাং একটি শিশুকে সামাজিকীকরণে পরিবারের ভূমিকা অনবদ্য।

3. ব্যক্তিত্বের বিকাশ

ব্যক্তিত্বের যথাযথ বিকাশ সাধনের ক্ষেত্রে পরিবার মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। কিছু বড় হওয়ার সাথে সাথে বাবা মায়ের ভালো গুণগুলি শিশুর মধ্যে বিকশিত হতে থাকে।

ফলে শিশুর মধ্যে যথাযথ ব্যক্তিত্বের বা সুব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধন ঘটে। যা সমাজের ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে প্রয়োজন। তাই ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধনের মধ্য দিয়ে পরিবার সমাজের যোগ্য করে শিশুকে গড়ে তোলে।

4. বৃত্তিশিক্ষা প্রদান

পরিবার শিশুকে সমাজ জীবনের উপযোগী করে গড়ে তোলে। অর্থাৎ ভবিষ্যৎ জীবনের উপযোগী করে বা বৃত্তি শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা রয়েছে। তাই পরিবারের পেশা নিয়ে বা জীবিকা নিয়ে অনেক শিশু ভবিষ্যতে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।

সুতরাং পরিবার তার পারিবারিক বৃত্তি শিক্ষার মধ্য দিয়ে শিশুকে উপযোগী করে গড়ে তোলে। ফলে শিশু বৃহত্তর সমাজের মধ্যে পরিচিতি লাভ করতে পারে বা সামাজিকীকরণ করতে পারে।

5. অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার বর্জন

পরিবার শিশুকে বিভিন্ন সামাজিক অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার বর্জন করতে বিশেষভাবে সাহায্য করে থাকে। ফলে শিশুরা আধুনিক সমাজের সঙ্গে দ্রুত অভিযোজন বা মানিয়ে চলতে পারে।

6. অভিযোজনে সহায়তা

আধুনিক সমাজ দ্রুত পরিবর্তনশীল। আর এই পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে যারা সহজে অভিযোজন করতে পারে তারাই টিকে থাকে। তাই ডারউইন বলেছিলেন – যোগ্যতামেরাই টিকে থাকে।

সুতরাং পরিবার শিশুকে এই পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে সহজে অভিযোজন করতে সাহায্য করে। তাই পরিবার শিশুকে যথাযথ অভিযোজনের মধ্য দিয়ে সামাজিকীকরণে (Socialization) সহায়তা করে।

7. আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন

শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে তখন তার চারিপাশের পরিবেশ বলতে পরিবারকেই বোঝায়। প্রথমদিকে শিশুরা পরিবারের মধ্যে আবদ্ধ থাকলেও বড় হওয়ার সাথে সাথে পরিবারই শিশুকে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে বিশেষভাবে সাহায্য করে।

অর্থাৎ পরিবার শিশুকে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মধ্য দিয়ে শিশুর সামাজিকীকরণের (Socialization process) পথকে সুগম করে।

আরোও পোস্ট পড়ুন – Click Here Now

উপসংহার (Conclusion)

সর্বোপরি বলা যায়, শিশুর সামাজিকীকরণের (Socialization) অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হল পরিবার। শিশু জন্মগ্রহণ করার সাথে সাথে পরিবারের সাথে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বড় হতে থাকে। অর্থাৎ পরিবারের মধ্যে বড় হওয়ার রসদ শিশু পেয়ে থাকে। একটি শিশুর প্রাথমিক চাহিদা থেকে শুরু করে সমস্ত রকম চাহিদা পরিবার বহন করে।

তাই পরিবার শিশুকে যথাযথ লালন-পালনের মধ্য দিয়ে উপযুক্ত করে গড়ে তোলে। শিশু বৃহত্তর সমাজের মধ্যে সহজে পরিচিতি লাভ করতে পারে। তাই পরিবার শিশুকে সামাজিকীকরণের সাথে সাথে উপযুক্ত করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

সামাজিকীকরণে পরিবারের ভূমিকা প্রসঙ্গে  Robert. K. Merton মন্তব্য করেছেন – “Family is a major transmission belt for the diffusion of cultural standards to the oncoming generation”.

তথ্যসূত্র (Reference)

  • Brown, F. J. (1954). Educational Sociology. New York: Prentice-Hall.
  • Bhattacharjee, Srinivas. (1996). Philosophical & Sociological Foundation of Education. Herald book service.
  • Das, P. (2007). Sociological Foundation of Education. New Delhi: Authorspress
  • Shukla, S & K Kumar. (1985). Sociological Perspective in Education. New Delhi, Chanakya
    Publications
  • Sodhi, T.S & Suri, Aruna. (1998). Philosophical & Sociological Foundations of Education, H.P Bhargav Book House, Agra,

প্রশ্ন – সামাজিকীকরণ (Socialization) কাকে বলে?

উত্তর – সমাজবিদ কিংসলে ডেভিসের (Kingsley Device) বলেছেন – সামাজিকীকরণ হল এমন পদ্ধতি যার মাধ্যমে মানব শিশু ক্রমশ সামাজিক মানুষে পরিণত হয়ে ওঠে।

প্রশ্ন – পরিবার কিভাবে শিশুদের সামাজিকীকরণের প্রাথমিক এজেন্ট?

উত্তর – পরিবার শিশুদের সামাজিকীকরণের প্রাথমিক এজেন্ট বা সংস্থা। কারণ জন্ম মুহূর্ত থেকে শেষ পর্যন্ত শিশু পরিবারের মধ্যেই যাবতীয় জ্ঞান অর্জন করে থাকে। অর্থাৎ শিশু জন্মগ্রহণ করার সাথে সাথে পরিবারই একমাত্র সংস্থা যেটি শিশুকে যথাযথ লালন-পালনের মধ্য দিয়ে সহজে বড় করে তোলে। অর্থাৎ পরিবার স্বার্থ ছাড়াই একটি শিশুকে সমাজ উপযোগী করে বা সামাজিকীকরণে বিশেষভাবে সক্ষম করে তোলে।

প্রশ্ন – পরিবারের দুটি সীমাবদ্ধতা লেখো।

উত্তর – পরিবারের দুটি সীমাবদ্ধতা হল – অর্থনৈতিক সমস্যা বা বাধা, পরিবার ভেঙে যাওয়া বা ক্ষুদ্র হয়ে যাওয়া যেমন -একক পরিবার, বৃত্তিগত অসুবিধা।

প্রশ্ন – পরিবারের ভূমিকা কি কি

উত্তর – পরিবারের ভূমিকা হল শিশুকে যথাযথ লালন পালনের মধ্য দিয়ে পরিবেশ উপযোগী করে গড়ে তোলা ও শিশুকে যথাযথ সামাজিকীকরণে সহায়তা করে। অর্থাৎ পরিবার শিশুর সর্বাঙ্গীন বিকাশ সাধনের মধ্য দিয়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

আরোও পড়ুন

1 thought on “শিশুর সামাজিকীকরণে পরিবারের ভূমিকা (Role of Family in Socialization Process)”

Leave a Comment

close