দৃঢ় ও সাহসী মনোভাব এবং কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিদ্যাসাগার সেই যুগের নারীদেরকে শিক্ষার (Vidyasagar in Women Education) সুব্যবস্থা করেছিলেন।
পুরুষশাসিত সমাজে দীর্ঘদিন অবহেলিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত নারীদের যাবতীয় অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার শিক্ষানামক মূলমন্ত্র দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগর আজীবন সত্যের দ্বারা পরিচালিত হয়ে এবং সাহসের সাথে দেশের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারে জরাজীর্ণ সমাজে আলো জ্বালাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
Explore Ishwar Chandra Vidyasagar’s pioneering efforts in promoting women’s education during 19th century India, including the establishment of girls’ schools, curriculum development, and social reforms.
বিদ্যাসাগরের জীবনী | Biography of Vidyasagar
বিদ্যাসাগর ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দী তথা নবজাগরণের প্রাণপুরুষ। একদিকে বিদেশী শক্তির প্রভাব, অন্যদিকে সমাজপতিদের দ্বারা সৃষ্টি ঘুনধরা সমাজব্যবস্থা। এমন এক অন্ধকার সন্ধিক্ষনে ধুমকেতুর মতো মেদিনীপুর জেলার বীরসংহ গ্রামে ১৮২০ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর (বাংলা – ১২ই আশ্বিন, ১২২৭) মা ভগবতী দেবীর কোলে আবির্ভূত হন মানবসাগর তথা দয়ারসাগর বিদ্যাসাগর।
বিদ্যাসাগরের পিতা ছিলেন দীন দরিদ্র্য ব্রাহ্মন ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা ছিলেন ভগবতী দেবী। ছোটবেলা থেকে তিনি অত্যন্ত মেধাবী, পরিশ্রমী ও দূরদর্শী ছিলেন। পড়াশুনার জন্য মাত্র নয় বছর বয়সে বিদ্যাসাগর বাবার সঙ্গে কলকাতায় চলে আসেন। এরপর থেকে শুরু হয় বিদ্যাসাগরের জীবনে কঠিন অধ্যাবসায় ও সংগ্রাম।
১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে ১ জুন সংস্কৃত কলেজে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে বারো বছর পড়াশুনা করেন এবং সংস্কৃত ব্যাকরণ, অলংকার, সাহিত্য, শাস্ত্র প্রভৃতিতে অগাধ পান্ডিত্য অর্জন করেন।
নারী শিক্ষায় বিদ্যাসাগরের ভূমিকা | Role of Vidyasagar in Women Education
প্রাচীন ধ্যানধারনাযুক্ত সামাজিক ব্যাধি নিরসনে রাজা রামমোহন রায়ের পর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর জীবনকে সম্পূর্ন উৎসর্গ করেছিলেন।
বিদ্যাসাগর একদিকে শিক্ষাসংস্কার ও অন্যদিকে সমাজসংস্কারে নিজেকে যুক্ত করে রাখেন ও ভারতবর্ষের নারীসমাজকে শিক্ষার মাধ্যমে বাঁচার প্রেরণা (Women’s empowerment in colonial India) দিয়েছিলেন। আবার বিধবাবিবাহ প্রচলনের মাধ্যমে দিয়েছিলেন নারী মুক্তির স্বাদ।
তাছাড়া ইংরেজদের দ্বারা প্রবর্তিত ‘চুঁইয়ে পড়ানীতি’ (Leakage policy) ছিল দেশীয় শিক্ষা ও গণশিক্ষা বিস্তারের প্রধান বাধাস্বরূপ, যেটিতে বিদ্যাসাগর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে নারী শিক্ষা (Ishwar Chandra Vidyasagar women education) বিস্তারে ব্রতী হয়েছিলেন। তাই ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে নারী শিক্ষার বিস্তারের (Education for women in British India) ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর বিশেষভাবে উদ্যোগে হয়েছিলেন। সমাজের বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে উঠে তিনি বিভিন্ন জেলায় নারী শিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে তিনি বিভিন্ন বিদ্যালয় স্থাপন করেন ও নারী শিক্ষার বিস্তার সাধন করেন। অর্থাৎ ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিদ্যাসাগর নারী শিক্ষার বিস্তারের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
নারী শিক্ষায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান যে-সমস্ত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয় সেগুলি হল –
1. বিদ্যালয় প্রতিষ্টা | Establishment of Girls’ Schools
বিদ্যাসাগর মর্মে মর্মে উপলদ্ধি করেছিলেন যে শিক্ষাসংস্কার ও সমাজসংস্কার একে অপরের পরিপূরক। সমাজের অগ্রগতি সাধন করতে গেলে শিক্ষার মধ্য দিয়ে তা করতে হবে।
তাই নারীশিক্ষা প্রসারে বিদ্যাসাগর (Vidyasagar in Women Education) বেথুন সাহেবের সহায়তায় ১৮৪৯ সালে মেয়েদের জন্য অবৈতনিক স্কুল প্রতিষ্টা করেন। যেটি পরে বেথুন বালিকা বিদ্যালয় নামে পরিচিত হয়। ১৮৫০ সালে ডিসেম্বরে বিদ্যাসাগর বেথুন বালিকা বিদ্যালয়ে সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
বিদ্যাসাগর এই বেথুন স্কুলে দীর্ঘদিন সম্পাদক হিসেবে স্কুল পরিচালনায় যথেষ্ট যোগ্যতা ও কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন।
2. বিদ্যালয় পরিচালনা | Management of Educational Institutions
বিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের বলিষ্ট মতাদর্শ পাওয়া য়ায়। বিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর যেসমস্ত সুপারিশ করেছিলেন, তা হল –
- একজন শিক্ষকের পরিবর্তে দু’জন শিক্ষক নিয়োগ,
- উপযুক্ত যোগ্যশিক্ষক (পন্ডিত) নিয়োগ ও যোগ্যতার ভিত্তিতে বেতন নির্ধারন,
- উচ্চবেতন দিয়ে (কমপক্ষে মাসিক ৫০ টাকা) একজন হেড পন্ডিত নিয়োগ,
- বিদ্যালয়গুলিতে উপযুক্ত পরিদর্শক নিয়োগ প্রভৃতি।
3. নারীশিক্ষা ভান্ডার গঠন | Formation of Nari Shiksha Bhandar
বিদ্যাসাগর কেবলমাত্র বিদ্যালয় গঠন করে থেমে থাকেনি।সরকারিভাবে আর্থিক সাহায্য পর্যাপ্ত না আসার ফলে, তিনি বিদ্যালয়গুলি সঠিকভাবে পরিচালনা ও পর্যাপ্ত পরিমানে অর্থযোগানের জন্য বেসরকারীভাবে ‘নারীশিক্ষা ভান্ডার’ নামক তহবিল গঠন করেন।
এখানে রাজা প্রতাপচন্দ্র ও আর ও অনেক শিক্ষানুরাগী ব্যাক্তিবর্গ নিয়মিত অর্থ সাহায্য করতেন। তাছাড়া তৎকালীন ছোটলাট বিডন সাহেবও মাসিক ৫৫ টাকা করে অর্থ সাহায্য করতেন।
4. শিক্ষার পাঠ্যক্রম | Curriculum Development for Women’s Education
বিদ্যালয় শিক্ষার অগ্রগতির জন্য বিদ্যাসাগর এক রিপোর্টে (১৮৬২ সালের ১৫ ই ডিসেম্বর) জানান -পড়ালেখা, অঙ্ক, জীবনচরিত, বাংলা, ইতিহাস নানা বিষয়ে মৌলিক পাঠ এবং সেলাই প্রভৃতি মেয়েদের শিক্ষা দিতে হবে।
তাছাড়া বিদ্যাসাগর শিক্ষা পাঠক্রমে এমন বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেন যার মাধ্যমে নারীরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারবে। আর তাদের জন্য বিভিন্ন বৃত্তিমুখী বিষয় শিক্ষার পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেন।
5. ভাষা মাধ্যম | Medium of Instruction
ভাষা মাধ্যম সম্পর্কে বিদ্যাসাগর বলেন – শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃভাষা (বাংলা), ইংরাজীতে নয়। তিনি আরোও বলেন – “বাংলা শিক্ষার বিস্তার ও সুব্যবস্থা একান্ত প্রয়োজনীয়, তা না হলে দেশের জন সাধারণের কল্যাণ হবে না।”
6. পাঠ্যপুস্তক রচনা | Authorship of Educational Textbooks
বিদ্যাসাগর উপলব্ধি করেছিলেন যে উপযুক্ত শিক্ষার জন্য চাই ভালো ভালো পাঠ্যপুস্তক যা শিক্ষার্থীদেরকে সমৃদ্ধ ও পরিপূর্ণ করতে সাহায্য করবে। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে পাঠ্যপুস্তকের অভাব পুরনে বিদ্যাসাগর বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন, যেমন – বর্ণপরিচয় (প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ – ১৮৫৫), বোধদয় (১৮৫১), কথামালা (১৮৫৬) প্রভৃতি।
উপসংহার | Conclusion
একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে বিদ্যাসাগর নিজেই ছিলেন রেনেসাঁস অর্থাৎ শিক্ষার মধ্য দিয়ে নারী জাগরণের নারী শিক্ষা বিস্তারের (Vidyasagar in Women Education) অন্যতম কান্ডারী। বিদ্যাসাগর নিজের সুখটুকু বিসর্জন দিয়ে, পরিবার ও গ্রামের সঙ্গে বিচ্ছেদ সাধন করে তিনি তাঁর লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন। তাই ঊনবিংশ শতাব্দীতে নারী শিক্ষা (Girls’ education in 19th century India) ও নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা ছিল অসামান্য।
বিদ্যাসাগরের আগে পর্যন্ত নারীশিক্ষা বিস্তারে (Vidyasagar in Women Education) নারীশিক্ষার বিভিন্ন স্কুল থাকলেও বিদ্যাসাগরের প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়গুলি সেই সময়ে সারা ভারতবর্ষে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছিল।
তথ্যসূত্র (References)
- Ravi, S. Samuel, A Comprehensive Study of Education, Fourth Printing-May 2016, Delhi – 110092, ISBN – 978-81-203-4182-1
- Basabi Chakrabarti, Women’s Studies: Various Aspects. Urbi Prakashani 2014
- Betty Friedan. The Feminine Mystique. New York: Norton, 1963
- Geraldine Forbes, Women in Modern India Cambridge University Press, 1996.
- Mary E. John. “Women’s Studies in India: A reader” Penguin Books. 2008
- Vidyasagar in Women Education
- Internet Sources
প্রশ্ন – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?
উত্তর – বিদ্যাসাগর মেদিনীপুর জেলার বীরসংহ গ্রামে ১৮২০ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর (বাংলা – ১২ই আশ্বিন, ১২২৭) মা ভগবতী দেবীর কোলে আবির্ভূত হন
প্রশ্ন – বিদ্যাসাগর কত সালে মারা যান?
উত্তর – দয়ারসাগর বিদ্যাসাগর 1891 সালে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরলোকে (মারা যান) গমন করেন।
প্রশ্ন – বিদ্যাসাগরের মায়ের নাম কী?
উত্তর – বিদ্যাসাগরের পিতা ছিলেন দীন দরিদ্র্য ব্রাহ্মন ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা ছিলেন ভগবতী দেবী।
প্রশ্ন – সংস্কারক হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান কি?
উত্তর – সংস্কারক হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদানগুলি হল –
1. সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা,
2. নারী শিক্ষার বিস্তার সাধন,
3. বিধবা বিবাহ প্রচলন প্রভৃতি।
প্রশ্ন – বীরসিংহ গ্রাম বর্তমানে কোথায় অবস্থিত?
উত্তর – পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলায় বীরসিংহ গ্রাম অবস্থিত।
প্রশ্ন – নারীশিক্ষা ভান্ডার কে, কি উদ্দেশ্যে গঠন করেন
উত্তর – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নারী শিক্ষা ভান্ডার গঠন করেন। এর উদ্দেশ্য হল – নারী শিক্ষার বিস্তার সাধন করা।
Vidyasagar in Women Education,
Education for women in British India,
Role of Vidyasagar in women’s rights,
আরোও পড়ুন
- নারী শিক্ষায় বেগম রোকেয়ার অবদান | Contribution of Begum Rokeya on Women Education
- নারী শিক্ষায় বিবেকানন্দের অবদান | Vivekananda on Women’s Education
- নারী শিক্ষায় জাতীয় শিক্ষানীতি 1986 এর সুপারিশ | National Education Policy 1986 on Women Education
- নারী শিক্ষায় মুদালিয়র কমিশনের সুপারিশ | Mudaliar Commission on Women Education
- নারী শিক্ষায় কোঠারি কমিশনের সুপারিশ | Kothari Commission on Women’s Education
- নারী শিক্ষায় রাধাকৃষ্ণন কমিশনের সুপারিশ | Radhakrishnan Commission on Women’s Education
নারী শিক্ষায় বিদ্যাসাগরের অবদান | Role of Vidyasagar in Women Education সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
Thanks for posting. I really enjoyed reading it, especially because it addressed my problem. It helped me a lot and I hope it will help others too.