সাংখ্য দর্শন | সাংখ্য দর্শনের শিক্ষাগত তাৎপর্য | Sankhya Philosophy of Education

দর্শনের বৈদিক শাখার মধ্যে বেদ স্বতন্ত্র দর্শন হিসেবে সাংখ্য দর্শন অধিক জনপ্রিয়। সাংখ্য দর্শন (Sankhya Philosophy of Education) ভারতীয় বৈদিক দর্শন সম্প্রদায়ের মধ্যে সবথেকে প্রাচীনতম দর্শন সম্প্রদায়।

ভারতীয় যোগ দর্শনের ন্যায় সাংখ্য দর্শন আস্তিক দর্শন সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। অর্থাৎ ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়ের মধ্যে সাংঘ দর্শন সম্প্রদায় সর্বাধিক প্রাচীনতম দর্শন বলে প্রচলিত। এখানে সাংখ্য দর্শনের ধারণা, মূলনীতি, ও শিক্ষাক্ষেত্রে তাৎপর্য আলোচনা করা হলো।

সাংখ্য দর্শন | Sankhya Philosophy of Education

ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীনতম এবং অন্যতম বৈদিক বা আস্তিক দর্শন হল সাংখ্য দর্শন। মহাভারত, উপনিষদ, ভগবত গীতা প্রকৃতির মধ্যে সাংখ্য দর্শনের উল্লেখ পাওয়া যায়।

সাংখ্য দর্শনের প্রবক্তা এবং প্রতিষ্ঠাতা হলেন মহর্ষি কপিল মুনি। যোগ দর্শনে ঈশ্বর স্বীকৃত হলেও সাংখ্য দর্শনে ঈশ্বরকে স্বীকার করা হয় না। অর্থাৎ শঙ্খ দর্শন হলো নিরিশ্বরবাদী দর্শন। কপিল মুনির সাঙ্গ দর্শনে ঈশ্বর স্বীকৃত হয়নি।

অনেক দার্শনিকগণের মতে সাংখ্য দর্শনের সূচনাকাল ৪৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। আবার অনেকে বলেন সাংখ্য দর্শনের উৎপত্তি খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ বা সপ্তম শতাব্দীতে। সাংখ্য দর্শন বেদ স্বতন্ত্র হলেও ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করে না।

সাংখ্য দর্শনের মূলনীতি

সাংখ্য দর্শনের কয়েকটি মূলনীতি হল – কার্যকারণবাদ, দ্বৈতবাদী দর্শন, পুরুষবহুত্ববাদ, মোক্ষলাভ, পরিনামবাদ প্রভৃতি।

এছাড়া সাংখ্য জ্ঞানবিদ্যা অনুযায়ী প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ প্রমানকে একমাত্র জ্ঞানলাভের উৎস হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

সাংখ্য দর্শন পুরুষ ও প্রকৃতি

সাংখ্য দর্শনে পুরুষ ও প্রকৃতি এই দুই প্রকার ধারণা পাওয়া যায়। অর্থাৎ সাংখ্য অধিবিদ্যা ( Sankhya Metaphysics) অনুসারে সৃষ্টির দুটি মূল পৃথক সত্তা রয়েছে। একটি হল পুরুষ এবং অপরটি হলো প্রকৃতি।

সাংখ্য দর্শনে পুরুষ নিষ্ক্রিয় কিন্তু চেতন এবং অপরদিকে প্রকৃতি হল অচেতন কিন্তু কর্মক্ষম। আর এই দুই মিলনের ফলে প্রকৃতি জগত রূপে অভিব্যক্ত হয়।

সাংখ্য দর্শনে পুরুষ

সাংখ্য দর্শন অনুযায়ী পুরুষ হল আত্মা। এই পুরুষ শুদ্ধ, নৃত্য এবং স্বভাব মুক্ত। পুরুষ হল নির্গুণ গুণের সমাহার। অর্থাৎ সাংখ্য দর্শনে পুরুষ নিষ্ক্রিয় কিন্তু চেতন। পুরুষকে অস্বীকার এর অর্থ হল নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা।

সাংখ্য দর্শনে প্রকৃতি

সাংখ্য দর্শন অনুসারে প্রকৃতি হল জগতের প্রধান উপাদান। সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিন গুণের সাম্যবস্থা হল প্রকৃতি অত্যন্ত সুক্ষ হওয়ার কারণে প্রত্যক্ষ করা যায় না।

সত্ত্বগুণ হল সুখদায়ক। অর্থাৎ এই গুণ সুখ প্রদান করে থাকে। এই গুণের জন্য আমাদের মধ্যে আনন্দ প্রশান্তি প্রকৃতি অনুভূতি হয়।

রজঃগুণ হল দুঃখদায়ক। অর্থাৎ এই গুণ মানুষকে দুঃখ দান করে থাকে। মানুষের জীবনে যাবতীয় দুঃখজনক ঘটনার কারণ হল রজঃগুণ।

তমঃগুণ হল বিষাদদায়ক। অর্থাৎ এই গুণ ব্যক্তির কামনা প্রদান করা থাকে। এই গুণের প্রভাবে ব্যক্তি নিদ্রা, আলস্য এবং আমদ প্রমোদে লিপ্ত থাকে। যার ফলে ব্যক্তির জীবন বিষময় হয়ে ওঠে।

সাংখ্য দর্শনের শিক্ষাগত তাৎপর্য

শিক্ষাক্ষেত্রে সাংখ্য দর্শনের প্রভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। সাংখ্য দর্শনের তাত্ত্বিক দিক গুলি শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন দিকে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। সাংখ্য দর্শনের শিক্ষাগত তাৎপর্য গুলি আলোচনা করা হলো।

শিক্ষার লক্ষ্য ও সাংখ্য দর্শন

সাংখ্য দর্শন অনুযায়ী বুদ্ধি, অহংকার ও মনের সুষম সমন্বয়ে গড়ে ওঠে মানুষের অন্তকরণ। পুরুষ হলো এই তিনটি উপাদানের সমষ্টি। দর্শন অনুযায়ী শিক্ষার লক্ষ্য হল এই তিনটি উপাদানের যথাযথ বিকাশ সাধন।

তাই সাংখ্য দার্শনিকদের মত অনুযায়ী শিক্ষার লক্ষ্য হলো জীবনের এই চরম লক্ষ্য অর্জনের সহায়তা করা। তাই শিক্ষা ব্যবস্থাকে এমনভাবে সংঘটিত করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা পুরুষ ও প্রকৃতির ভেদ জ্ঞান বা বিবেক জ্ঞান সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান অর্জন করতে পারে।

অর্থাৎ সাংখ্য দর্শনে পুরুষ ও প্রকৃতির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আর এই জন্য সাংখ্য দার্শনিকগণ নৈতিক আচরণবিধি ও যোগ অনুশীলনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

শিক্ষার পাঠক্রম ও সাংখ্য দর্শন

পাঠক্রম হলো দৌড়ের পথ বা কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথ. সাংখ্য দর্শন অনুযায়ী দৈহিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। অর্থাৎ এই দর্শন অনুযায়ী পুরুষ ও প্রকৃতিকে উপলব্ধি করার জন্য যা কিছু প্রয়োজন তা পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত হবে।

তাছাড়া সাংখ্য দর্শনে স্তর ভেদে পাঠক্রমের বৈচিত্রতা পরিলক্ষিত হয়, যথা –

i) শৈশবে শিশুর জ্ঞান ও কর্ম ইন্দ্রিয়ের বিকাশ সাধনের জন্য খেলাধুলা ও প্রকৃতি পাঠ বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

ii) বাল্যকালে শিক্ষার্থীদের বুদ্ধি বিকাশের জন্য পাঠক্রমে ভাষা সাহিত্য, সমাজবিদ্যা, গণিত প্রভৃতি বিষয় থাকবে।

iii) বয়সন্ধিকাল হল শিশুর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়। তাই সাংখ্য দার্শনিকগণ বলেন বয়সন্ধিকালে অহং সত্তা বিকাশের জন্য এমন বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে যাতে শিশু যুক্তি শক্তি এবং অহং সত্তা বিকশিত হয়।

সত্যি বৈষম্যের নীতি অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা যাতে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী বা আগ্রহ অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয় গ্রহন করতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখে পাঠক্রমকে পরিবর্তনশীল ও শিশু কেন্দ্রিক করতে হবে। তাই পাঠক্রম নির্বাচন এর ক্ষেত্রে সাংখ্য দর্শনের শিক্ষাগত তাৎপর্য গুরুত্বপূর্ণ।

শিক্ষাদান পদ্ধতি ও সাংখ্য দর্শন

শিক্ষাদান পদ্ধতির ক্ষেত্রে সাংখ্য দর্শনে ইন্দ্রিয় প্রশিক্ষণের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ সাংখ্য দর্শন অনুযায়ী – ব্যক্তির ইন্দ্রিয়গুলি জ্ঞান আহরণের অন্যতম দিক। তাই যাতে শিক্ষার্থীরা সহজে জ্ঞান লাভ করতে পারে তার জন্য ইন্দ্রিয়ের প্রশিক্ষণ আবশ্যক।

শৃঙ্খলা ও সাংখ্য দর্শন

সাংখ্য দর্শনে শৃঙ্খলার বিষয়টি যোগ দর্শনকে অনুসরণ করা হয়েছে। অর্থাৎ সাংখ্য দর্শনে যোগ দর্শনের যম বা সংযম নিয়মকে অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে।

তাছাড়া সাংখ্য দর্শন সুশৃংখলাকে সমর্থন করে থাকে। এক্ষেত্রে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক শিক্ষার্থীর মধ্যে কঠোর শৃঙ্খলা ও মুক্ত শৃংখলার মধ্যপন্থা অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে।

অর্থাৎ সাংখ্য দর্শন একদিকে কঠোর শৃঙ্খলা ও অপরদিকে নমনীয় শৃঙ্খলার বিরোধিতা করে সুশৃংখলাকে সমর্থন করে থাকেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে সাংখ্য দর্শনের শিক্ষাগত তাৎপর্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

উপসংহার (Conclusion)

পরিশেষে বলা যায়, সাংখ্য দর্শন (Sankhya Philosophy of Education) প্রাচীনতম বৈদিক দর্শন হিসেবে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সাংখ্য দর্শনের নীতিগুলি বর্তমানে শিক্ষার লক্ষ্য, শিক্ষার বিষয়বস্তু বা পাঠক্রম পদ্ধতি নির্বাচন প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

তথ্যসূত্র (References)

  • Aggarwal, J. C., Theory and Principles of Education. 13th Ed. Vikas Publishing House Pvt. Ltd.
  • V.R. Taneja, Educational Thoughts & Practice. Sterling Publication Pvt. Ltd. New Delhi
  • Nayak, B.K, Text Book of Foundation of Education. Cuttack, Odisha: KitabMhal
  • Ravi, S. Samuel, A Comprehensive Study of Education, Fourth Printing-May 2016, Delhi – 110092, ISBN – 978-81-203-4182-1,
  • Sankhya Philosophy of Education
  • Internet sources

প্রশ্ন – সাংখ্য দর্শনের জনক কে?

উত্তর – সাংখ্য দর্শনের প্রবক্তা বা জনক হলেন মহর্ষি কপিল মুনি। এই দর্শন আস্তিক সম্প্রদায় হলেও কপিলের সাংখ্য দর্শনে ঈশ্বর স্বীকৃত হয়নি।

আরোও পড়ুন

সাংখ্য দর্শন | সাংখ্য দর্শনের শিক্ষাগত তাৎপর্য | Sankhya Philosophy of Education সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

Leave a Comment

close