শিক্ষা হল শিশুর জীবনব্যাপী ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। শিশুর যাবতীয় বিকাশের ক্ষেত্রে শিক্ষার অবদান গুরুত্বপূর্ণ। তাই সমাজ জীবনের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের যেমন লক্ষ্য থাকে তেমনি শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য (Aims and Objectives of Education) পরিলক্ষিত হয়।
প্রতিটি শিক্ষা ব্যবস্থার একটি নির্দিষ্ট শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে বর্তমান। তাই আদিম যুগ থেকে শুরু করে আধুনিক কাল পর্যন্ত শিক্ষার লক্ষ্য ও শিক্ষার উদ্দেশ্য কি তা নির্ণয় করা হয়েছে ও যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পরিবর্তন সাধন হয়েছে।
শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য | Aims and Objectives of Education
শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিবর্তনের ধারা অনুসারে পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিভিন্ন ধরনের পরিলক্ষিত হয়। এখানে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য গুলি আলোচনা করা হল –
আদিম বা প্রাচীন যুগের শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
আদিম বা প্রাচীন যুগের শিক্ষার লক্ষ্য ছিল খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের সংস্থান করা। অর্থাৎ জীবনের কয়েকটি মৌলিক চাহিদা পূরণ ও জীবন সংগ্রামে টিকে থাকাই ছিল শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
তাছাড়া প্রাচীনকালে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষার লক্ষ্য পরিলক্ষিত হয়। যথা –
প্রাচীন গ্রিসের (স্পার্টা) শিক্ষার লক্ষ্য ছিল ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের প্রয়োজন অনুযায়ী এবং রাষ্ট্রের অনুগত করে তোলা ছিল শিক্ষার লক্ষ্য।
প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষার লক্ষ্য ছিল আত্ম উপলব্ধির মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হওয়া বা মোক্ষ লাভ করা।
আবার প্রাচীন রোমের শিক্ষার লক্ষ্য ছিল ব্যবহারিক জীবনে সমৃদ্ধি লাভ করা। অর্থাৎ আদর্শ নাগরিক সৃষ্টি করাই হল শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।।
মধ্যযুগের শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
মধ্যযুগের ভারতীয় শিক্ষার লক্ষ্য ছিল ধর্ম কেন্দ্রিকতা। অর্থাৎ মধ্যযুগের ধর্মীয় রীতি নীতি কঠোরভাবে পালন করাই ছিল শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তাই মধ্যযুগের শিক্ষা ছিল কঠোর নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ।
আধুনিক যুগের শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
নগরায়ন, আধুনিকীকরণ, বিশ্বায়ন ও নবজাগরণের ফলে প্রাচীন ধ্যান-ধারণাযুক্ত সমাজ ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটে। ফলে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের মধ্যে আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। তাই আধুনিক যুগের শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীর বা শিশুর প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে তার সর্বাঙ্গীন বিকাশ সাধনের উপর গুরুত্ব দেওয়া।
তাই আধুনিককালের শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল ব্যক্তি, সমাজ তথা সমগ্র জাতির কল্যাণ ও সার্বিক বিকাশ সাধন করা।
আরোও পোস্ট পড়ুন – Click Here Now |
শিক্ষার চরম লক্ষ্য
এছাড়া আরো বিভিন্ন দিক থেকে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পরিলক্ষিত হয়, সেগুলি হল –
1. শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্য
ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে শিক্ষার যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ণয় করা হয় তাকে শিক্ষা ব্যক্তি তান্ত্রিক লক্ষ্য বলে। অর্থাৎ ব্যক্তির সর্বাঙ্গিন বিকাশ সাধন হলো ব্যক্তিতান্ত্রিক শিক্ষার অন্যতম লক্ষণ। এক্ষেত্রে ব্যক্তির নিজস্ব কিছু গুন বা বৈশিষ্ট্যের বিকাশ সাধন করা হয়ে থাকে। শিক্ষার ব্যাক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্যের সমর্থকদের মধ্যে অন্যতম হলেন – রুশো, লক্, হার্বার্ট দার্শনিকগণ।
শিক্ষার ব্যক্তিতান্ত্রিক লক্ষ্যের মধ্যে যে সমস্ত লক্ষ্য গুলি গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলি হল –
- দৈহিক বিকাশ,
- মানসিক বিকাশ,
- প্রাক্ষোভিক বিকাশ,
- মূল্যবোধের বিকাশ সাধন,
- সৃজনশীলতার বিকাশ প্রভৃতি।
2. শিক্ষার সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য
সমাজকে কেন্দ্র করে শিক্ষা যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়ে থাকে, তাকে শিক্ষার সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য বলে। সমাজতান্ত্রিকগণ বলেন সমাজ ছাড়া ব্যক্তির উন্নয়ন সম্ভব নয়। কারণ ব্যক্তি সমাজের অংশবিশেষ। সমাজের মধ্যে ব্যক্তির যাবতীয় ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে থাকে।
শিক্ষার সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যের মধ্যে অন্যতম লক্ষ্য গুলি হল –
- সামাজিক চেতনা বৃদ্ধি,
- ব্যক্তিকে সামাজিকীকরণে অংশগ্রহণ করানো,
- সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার,
- সামাজিক সমস্যা চিহ্নিত করণ ও সমাধান,
- সামাজিক মূল্যবোধ গঠন প্রভৃতি।
3. শিক্ষার বৃত্তিমূলক লক্ষ্য
মানব জীবনে শিক্ষার একটি অন্যতম লক্ষ্য বৃত্তিমূলক লক্ষ্য। বৃত্তি শিক্ষার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যৎ জীবনে উপযোগী হয়ে গড়ে ওঠে। তাই কোঠারি কমিশন শিক্ষার্থীদের বৃত্তিশিক্ষার জন্য পাঠক্রমে কর্ম শিক্ষার অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করেছেন।
5. জাতীয় বিকাশ
শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হল জাতীয় বিকাশ সাধন। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শিক্ষার লক্ষ্য কেবলমাত্র ব্যক্তিগত ও সামাজিক দিকে সীমাবদ্ধ নয়। এর পাশাপাশ রাষ্ট্রের কল্যাণ বা জাতীয় বিকাশের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়ে থাকে।
শিক্ষা জাতীয় লক্ষ্যের মধ্যে যে সমস্ত লক্ষ্য গুলি পরিলক্ষিত হয়, সেগুলি হল –
- জাতীয় সংহতি বজায় রাখা,
- মানবসম্পদের বিকাশ সাধন,
- জাতীয় সংকট বা জাতীয় সমস্যা নিরসন প্রভৃতি।
6. শিক্ষা নৈতিক লক্ষ্য
শিক্ষা অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক মানের উন্নয়ন করা বা উন্নতি সাধন করা এবং আদর্শ চরিত্রে অধিকারী করে গড়ে তোলা। কারণ আধুনিক সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের বা নৈতিক চরিত্রের খুব অভাব পরিলক্ষিত হয়। তাই নৈতিক চরিত্র গঠনের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি কল্যাণ তথা সমাজ কল্যাণ সাধন করা সম্ভব হয়।
উপরিউক্ত শিক্ষার লক্ষ্য গুলি ছাড়াও আরো শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য গুলি হল –
- অতীত সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও সঞ্চালন।
- জীবন বিকাশের সহায়তা করা।
- সমাজ তাতা বিশ্বের উন্নয়ন।
- বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ জাগরণ,
- জাতীয় সংহতি রক্ষা,
- অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ প্রভৃতি।
উপসংহার (Conclusion)
পরিশেষে বলা যায়, শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সতত পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনশীল সমাজের সঙ্গে বা পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজন করার জন্য ব্যক্তির ক্ষেত্রে যা কিছু প্রয়োজন সবই শিক্ষার লক্ষ্যের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়ে থাকে। তাই বর্তমান আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে তাল মেলাতে হলে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কয়েকটি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকলে ব্যক্তি কল্যাণ তথা সমাজকল্যাণ কখনোই সম্ভব নয়।
তথ্যসূত্র (References)
- Aggarwal, J. C., Theory and Principles of Education. 13th Ed. Vikas Publishing House Pvt. Ltd.
- V.R. Taneja, Educational Thoughts & Practice. Sterling Publication Pvt. Ltd. New Delhi
- Nayak, B.K, Text Book of Foundation of Education. Cuttack, Odisha: KitabMhal
- Ravi, S. Samuel, A Comprehensive Study of Education, Fourth Printing-May 2016, Delhi – 110092, ISBN – 978-81-203-4182-1,
- Internet sources
প্রশ্ন – শিক্ষার লক্ষ্য কাকে বলে
উত্তর – যে কোনো শিক্ষা ব্যবস্থা কোনো লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিহীন হতে পারে না। তাই শিক্ষার যে সমস্ত লক্ষ্যকে সামনে রেখে সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত করা হয় তাকে শিক্ষার লক্ষ্য বলে। আধুনিক শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হলপরিবর্তনশীল সমাজের বা পরিবেশের সঙ্গে সার্থক অভিযোজন করার জন্য ব্যক্তিকে উপযোগী করে গড়ে তোলা।
প্রশ্ন – শিক্ষার লক্ষ্য পরিবর্তনশীল কেন
উত্তর – শিক্ষা সতত পরিবর্তনশীল, তাই স্বাভাবিকভাবে শিক্ষার লক্ষ্য ও পরিবর্তনশীল। কারণ পরিবর্তনশীলতার সঙ্গে সার্থক অভিযোজনই হল শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য।
প্রশ্ন – শিক্ষার যেকোনো দুটি লক্ষ্য লেখ
উত্তর – শিক্ষার যেকোনো দুটি লক্ষ্য হল –
1. শিক্ষার সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য এবং
2. শিক্ষাব্য ব্যক্তি তান্ত্রিক লক্ষ্য।
প্রশ্ন – শিক্ষার উদ্দেশ্য কি
উত্তর – শিক্ষা একটি পূর্বপরিকল্পিত ও ভবিষ্যৎ মুখী কর্মসূচি। তাই শিক্ষার নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বর্তমান। অর্থাৎ যে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত হয় তাকে শিক্ষার উদ্দেশ্যে বলে। শিক্ষার যেসমস্ত উদ্দেশ্য পরিলক্ষিত হয় তা হল – শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীন বিকাশ, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দান, ব্যক্তিগত বিকাশ, সামাজিক বিকাশ, ব্যক্তির আধ্যাত্মিক বিকাশ, নৈতিক বিকাশ, মূল্যবোধের বিকাশ প্রভৃতি।
আরোও পড়ুন
- শিক্ষা কি | শিক্ষার 15 টি সংজ্ঞা | Concept and Best Definition of Education
- Role of Television: গণমাধ্যম হিসেবে টেলিভিশনের ভূমিকা
- সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষা বলতে কী বোঝো | 2 টি সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য : Narrow Meaning of Education
- ব্যাপক অর্থে শিক্ষা কি | সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য : Broader Meaning of Education
- ডেলর কমিশনের শিক্ষার চারটি স্তম্ভ (Delors Commission in Bengali)
- শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা কি (Child Centered Education) : ধারণা, সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য