পরিনমন কাকে বলে | শিক্ষা ক্ষেত্রে পরিণমনের ভূমিকা | Definition of Maturation

মানুষের কাছে শিখন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিখন একটি জটিল সামাজিক প্রক্রিয়া। বিভিন্ন মনোবিদগণ শিখনের বিভিন্ন উপাদানের কথা বলেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হল পরিনমন (Maturation)।

শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশের একটি অন্যতম প্রক্রিয়া হল পরিনমন। এটি ছাড়া ব্যক্তির বা শিশুর সার্বিক বিকাশ সম্ভব নয়। এখানে পরিণমন কাকে বলে, পরিণমনের বৈশিষ্ট্য এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে পরিণমনের ভূমিকা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হল।

পরিনমন | Definition of Maturation

জন্মগত জৈবিক প্রবণতার প্রকাশ হল পরিণমন। অর্থাৎ শিশুর জীবন বিকাশের ক্ষেত্রে শিখন ব্যতিরেকে স্বাভাবিকভাবে বা জৈবিকভাবে যে ধরনের বিকাশ সম্পন্ন হয় সেটি হল পরিণমন। জন্মের পর শিশুর ওজন, উচ্চতা এবং দৈহিক সামর্থ্য থাকে না। সময়ের সাথে সাথে এগুলির বিকাশ সাধন হয়ে থাকে।

স্বাভাবিকভাবে শিশু ওজন, উচ্চতা এবং দৈহিক সামর্থ লাভের মাধ্যমে পরিবেশের সাথে অভিযোজন করতে পারে। এর জন্য শিশুকে কোনরকম অনুশীলন করতে হয় না। শিশুর বিকাশের এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হল পরিণমন।

বিভিন্ন মনোবিদ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পরিণমনকে ব্যাখ্যা ও সংজ্ঞায়িত করেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হল –

বিশিষ্ট মনোবিদ স্কিনারের মতে – পরিনমন হল এমন ধরনের বিকাশ যা পরিবেশ এবং পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটলেও মোটামুটি ভাবে নিয়মিত সংঘটিত হয়।

বিশিষ্ট মনোবিদ McGeoch বলেছেন – পরিনমন হল বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অনুশীলন ও অভিজ্ঞতার পরিবর্তে জৈবিক কারণে ব্যক্তির আচরণের পরিবর্তন।

পরিনমনের বৈশিষ্ট্য

পরিনমনের বৈশিষ্ট্য গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য গুলি হল, নিম্নলিখিত –

1. বিকাশের প্রক্রিয়া

পরিনমন হল একটি বিকাশের প্রক্রিয়া। অর্থাৎ পরিণমনের বৈশিষ্ট্য হল এটির ব্যক্তির বা শিক্ষার্থীদের শারীরিক বিকাশ সম্পন্ন হয়। উদাহরণস্বর বলা যায় – পরিনামনের ফলে হৃৎপিণ্ডের বৃদ্ধি, পাকস্থলীর বৃদ্ধি বা আয়তন বৃদ্ধি পায় ফলে এগুলির কর্ম ক্ষমতার বিকাশ ঘটে।

2. স্বাভাবিক প্রক্রিয়া

পরিনমনের বৈশিষ্ট্য হল স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ব্যক্তির সুস্থতা পরিণমনে সাহায্য করে। আবার অপরদিকে ব্যক্তির অসুস্থতা ব্যক্তির পরিণমনে বাধা সৃষ্টি করে থাকে। যেমন – পোলিও আক্রান্ত শিশুরা পরিনামনের ফলে হাঁটতে পারে না।

3. সহজাত প্রক্রিয়া ও জৈবিক প্রকৃতির

পরিণমন একটি সহজাত প্রক্রিয়া ও জৈবিক প্রকৃতির। অর্থাৎ পরিণমনের বৈশিষ্ট্য হল, এরই জন্মগত সূত্রে ব্যক্তি বা শিক্ষার্থীরা লাভ করে থাকে। তাই এটি সহজাত প্রক্রিয়া ও জৈবিক প্রকৃতির হয়ে থাকে।

4. সর্বজনীন প্রক্রিয়া

পরিনমন সর্বজনীন প্রক্রিয়া বিশেষ। কারণ পৃথিবীতে প্রতিটা মানুষের মধ্যে এই পরিণমনের প্রভাব বা পরিণমন পরিলক্ষিত হয়। যেমন – পৃথিবীর সব শিশুরা হামাগুড়ি দেয়, হাঁটতে পারে প্রভৃতি। তবে শারীরিক অসুস্থতা পরিণমনে বাধা সৃষ্টি করে। তাই অনেক ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী শিশুরা সঠিকভাবে পরিণমনের অভাবে চলাফেরা করতে পারে না।

5. ব্যক্তিভেদে পৃথক

পরিনমন ব্যক্তিভেদে পৃথক প্রকৃতির হয়ে থাকে। অর্থাৎ বিভিন্ন রকম ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম ভাবে পরিণমন সূচিত হয়। কারোও সঠিক বয়সে পরিনমন দেখা দেয় আবার অনেকের অনেক সময় লাগে।

6. অনুশীল নিরপেক্ষ

শিখন অনুশীলন সাপেক্ষ। কিন্তু পরিণমন হল অনুশীলন নিরপেক্ষ। অর্থাৎ পরিণমনের ক্ষেত্রে অনুশীলনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় না। এটি স্বাভাবিকভাবেই ব্যক্তির মধ্যে সম্পন্ন হয়ে থাকে।

শিক্ষা ক্ষেত্রে পরিণমনের ভূমিকা আলোচনা

শিক্ষা ক্ষেত্রে পরিণমনের ভূমিকা বিষয়ে বিভিন্ন মনোবিদদের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন মনোবিদগণ মনে করেন পরিণমন যেহেতু স্বাভাবিক এবং জৈবিক প্রকৃতির সেই জন্য শিক্ষার উপর এর প্রভাব কিভাবে পরিলক্ষিত হয় তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

লোভেল, হিলগার্ড প্রমুখ মনোবিদগণ মনে করেন – পরিণমনের ফলে যে আচরণ গুলি সম্পন্ন হয় তা প্রশিক্ষণের প্রভাবে ত্বরান্বিত করা যায়। যেমন – স্বাভাবিকভাবে দেড় বছর বয়সে কোন শিশু স্বাভাবিক নিয়মে কোন কিছু সাহায্য ছাড়া হাঁটতে পারে। কিন্তু তাকে যদি প্রশিক্ষণ দেয়া যায় তাহলে তাকে ১২ মাস বয়সে হাঁটানো যেতে পারে। তবে এই কৌশল ব্যবহার করা উচিত কিনা তা নিয়ে মনোবিদদের মধ্যে দ্বিমত লক্ষ্য করা যায়।

আবার অনেক মনোবিদগণ মনে করেন – পরিণমনের অপেক্ষা করলে মানব জীবনের এই অল্প সময়ে অনেক কিছু শেখা বাদ যেতে পারে।

আবার বিভিন্ন মনোবিদ মনে করেন শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিণমন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারন শিক্ষা জানার আগে নিশ্চিত হওয়া উচিত শিক্ষা গ্রহণের জন্য শিক্ষার্থীর উপযুক্ত পরিণমন ঘটেছে কিনা। এই বিষয়টি প্রাচীন ভারতের শিক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হতো।

বিশিষ্ট মনোবিক থর্নডাইক তার শিখনের নীতিতে দৈহিক প্রস্তুতি বা ব্যক্তির পরিণমনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

তাই বলা যায়, শিক্ষায় পরিণমনের গুরুত্ব বর্তমান। কারণ শিক্ষার্থীর উপযুক্ত পরিনমন না হলে সে কোন কিছুই শিখতে পারবে না। তাই একটি নির্দিষ্ট বয়সে একটি নির্দিষ্ট বিষয় শেখানোর প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

অর্থাৎ কোনো দশ বছর বয়সী শিশুকে ক্লাস টেনে ভর্তি করা হয় না। তাই কোন বিষয়ে শিক্ষাদানের আগে শিক্ষার্থীর পরিণমনের স্তর সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা প্রয়োজন। উপযুক্ত পরিণমনের আগে জোর করে কিছু শেখাতে গেলে তা ভালোর থেকে মন্দ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, এ কথা বহু মনোবিদগণ স্বীকার করে নিয়েছেন।

উপসংহার (Conclusion)

পরিশেষে বলা যায়, পরিনমন (Maturation) হল মানব জীবন বিকাশের এবং শিখন এর এমন একটি উপাদান যেটি ব্যক্তিকে সমাজ উপযোগী করে গড়ে তোলে। ফলে ব্যক্তি বা শিক্ষার্থী সমাজের উপযোগী বা উপযুক্ততা লাভ করে।

তথ্যসূত্র (Reference)

  • A. Woolfolk – Educational Psychology – Pearson Education
  • J. W. Santrock – Educational Psychology – Mc Gray Hill
  • J. C. Aggarwal – Essentials of Educational Psychology – Vikas publisher
  • S. K. Mangal – Essentials of Educational Psychology – PHI Ltd.
  • S. K. Mangal – Advanced Educational Psychology – PHI Ltd
  • S. S. Chauhan – Advanced Educational Psychology – Vikas publisher
  • E. B. Hurlock – Child Development – Anmol Publication Pvt. Ltd
  • L. E. Berk – Child Development – PHI Ltd
  • Internet Sources

প্রশ্ন – পরিণমনের দুটি বৈশিষ্ট্য লেখো

উত্তর – পরিণমনের দুটি বৈশিষ্ট্য হল – স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ও ব্যক্তিভেদে পৃথক।

আরোও পড়ুন

1 thought on “পরিনমন কাকে বলে | শিক্ষা ক্ষেত্রে পরিণমনের ভূমিকা | Definition of Maturation”

Leave a Comment

close