ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্ব থেকে সমাজবিজ্ঞান শব্দটি ব্যবহার হতে শুরু হয়। সাধারণভাবে শিল্প বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে উদ্ভূত বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা আলোচনার জন্য বিভিন্ন সমাজতাত্ত্বিকগণ সমাজবিজ্ঞান (Definition of Sociology) নামক বিষয়ের কল্পনা করেন।
সমাজের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিভিন্ন সময় আলোচনা করা হয়ে থাকে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এবং অ্যারিস্টোটলের ‘Politics’ নামক গ্রন্থে। সমাজবিজ্ঞান হল বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজের বিভিন্ন সমস্যার উপর বা সমাজের বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলোকপাত করা। তাই সমাজবিজ্ঞান ১০০ বছরের বেশি একটি প্রাচীনতম সামাজিক বিজ্ঞান।
সমাজবিজ্ঞান কাকে বলে | Definition of Sociology
সমাজবিজ্ঞানের বুৎপত্তিগত অর্থ
সমাজবিজ্ঞানের ইংরেজি ‘Sociology’ শব্দটি এসেছে ‘ল্যাটিন’ শব্দ ‘Societus’ থেকে, যার অর্থ হল যথাক্রমে – সমাজ (Society) এবং ‘Logos’ যার অর্থ হল – বিজ্ঞান বা সমাজ (Science or Society)। অর্থাৎ সমাজবিজ্ঞান (Sociology) শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ হল – সমাজের বিজ্ঞান (Science of Society)।
ফ্রান্সের দার্শনিক ও সমাজবিদ্ Auguste Comte, 1837 সালে ‘সর্বপ্রথম সমাজবিজ্ঞান (Sociology) শব্দটির ব্যবহার করেন। এই জন্য Auguste Comte -কে ‘সমাজবিজ্ঞানের জনক’ (Father of Sociology) বলা হয়। তাছাড়া, স্পেনসার, এমিল দুর্খেইম, ম্যাক্স ওয়েবার প্রমূখ সমাজতাত্ত্বিকবিদগণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যারা সমাজতত্ত্বকে বা সমাজবিজ্ঞানকে উচ্চতার শিখরে নিয়ে যেতে সক্ষম হন।
সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞা
সমাজবিজ্ঞান কাকে বলে এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন সমাজতত্ত্ববিদ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজবিজ্ঞানকে ব্যাখ্যা করেছেন ও সংজ্ঞায়িত করেছেন। সমাজতত্ত্ববিদদের প্রদত্ত সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞা গুলি নিচে আলোচনা করা হল –
1. সমাজবিদ্ Auguste Comte বলেন – সমাজবিজ্ঞান হল একটি ইতিবাচক বিজ্ঞান। (“Sociology as a positive science.”)
2. সমাজতাত্ত্বিক Ogburn and Nimkoff বলেন – সমাজবিজ্ঞান সামাজিক জীবনধারাকে অধ্যয়ন করে। (“Sociology as the study of social life”.)
3. আবার, সমাজতাত্ত্বিক ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weaber) বলেছেন – সমাজবিজ্ঞান হল এমন এক বিজ্ঞান, যেখানে সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ব্যাখ্যার প্রচেষ্টা করে থাকে। (“Sociology is a science which attempts the interpretative understanding of social action.”)
4. সমাজবিজ্ঞানী পার্ক এর মতে – সমাজবিজ্ঞান হল মানবগোষ্ঠী বা সমষ্টির আচরণ সম্পর্কিত একটি বিজ্ঞান। (“Sociology is the science of collective behaviour.”)
তাই সমাজবিজ্ঞান হল এমন একটি ইতিবাচক বিজ্ঞান যেটি সমাজের সমস্ত বিষয়কে নিয়ে অধ্যায়ন করে থাকেন। অর্থাৎ সামাজিক মানুষের জীবনধারার অধ্যায়নই হল সমাজবিজ্ঞান।
সমাজবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু আলোচনা কর
সমাজবিজ্ঞান হল সমাজের অধ্যায়নকারী বিজ্ঞান। সমাজবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়বস্তু বা পরিধি ব্যাপক ও বিস্তৃত। বিভিন্ন সমাজতাত্বিকগণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজতত্ত্বকে বা সমাজবিজ্ঞানকে ব্যাখ্যা করেছেন।
সমাজবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু বা পরিধি যে সমস্ত দিকে বিস্তৃত, সেগুলি হল –
1. সমাজ বা দলের বৈজ্ঞানিক আলোচনা
সমাজবিজ্ঞান সমাজ বা দলের বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা করে থাকে। অর্থাৎ সমাজ কিভাবে সৃষ্টি হয় এবং সমাজে কিভাবে গোষ্ঠী বা দলের জন্ম হয় ও তাদের কার্যাবলী প্রভৃতি সম্পর্কে বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা সমাজবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর অন্তর্গত।
2. পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা
দুই বা ততোধিক ব্যক্তিবর্গের মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্কের ফলে সমাজের সৃষ্টি হয়েছে। সমাজবিজ্ঞান সমাজের এই পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে আলোকপাত করে থাকে। যেমন – পরিবার কিভাবে সৃষ্টি হয় ও তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক কি প্রকৃতির প্রভৃতি। অর্থাৎ সমাজবিজ্ঞান সমাজের ব্যক্তিবর্গের যে পারস্পরিক সম্পর্ক সেই বিষয়ে সুস্পষ্ট ভাবে আলোকপাত করে থাকে।
3. সামাজিক সমস্যা
সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা যেমন – দারিদ্র, বেকারত্ব, জাতপাত সমস্যা, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী সমস্যা প্রভৃতি সম্পর্কে আলোকপাত করে থাকে। অর্থাৎ সমাজতত্ত্ব বা সমাজবিজ্ঞানে সামাজিক বিভিন্ন সমস্যার কারণ ও তার প্রতিকার যথাযথভাবে আলোচনা করা হয়ে থাকে।
4. সামাজিক কাঠামাে
প্রত্যেকটি সমাজের একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামো থাকে। আর সমাজবিজ্ঞানে সামাজিক কাঠামো কিরূপ তা আলোচনা করা হয়। বিভিন্ন সমাজের বিভিন্ন কাঠামো বা গঠন কাঠামো পরিলক্ষিত হয়। আর সমাজবিজ্ঞানে এই সমস্ত বিষয়গুলির প্রতি যথাযথভাবে আলোকপাত করা হয়।
5. সামাজিক পরিবর্তনশীলতা
সমাজ সতত পরিবর্তনশীল। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর এবং বিশ্বায়নের যুগে সমাজের মধ্যে নানা পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে আধুনিক কাল পর্যন্ত সমাজের পরিবর্তন কিভাবে সংঘটিত হয়েছে বা হচ্ছে সে সম্পর্কে যথাযথ আলোকপাত করা সমাজবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু বা পরিধির অন্তর্গত।
6. সামাজিক স্তরবিন্যাস এবং গতিশীলতা
প্রতিটি সমাজে জাতি-বর্ণ ও ধর্ম নির্বিশেষে সামাজিক স্তরবিন্যাস পরিলক্ষিত হয়। আবার ব্যক্তির প্রচেষ্টার ফলে তার সামাজিক পদমর্যাদার পরিবর্তন ও সাধিত হয়। যেটি গতিশীলতা নামে পরিচিত। আর সমাজবিজ্ঞানে এই সামাজিক স্তরবিন্যাস কিভাবে সংঘটিত হয়, এর উপাদান গুলি কি এবং সামাজিক গতিশীলতা কি? ও কিভাবে সংঘটিত হয় সেগুলি সম্পর্কে যথাযথভাবে আলোকপাত করে।
আরোও পোস্ট পড়ুন – Click Here Now |
এগুলি ছাড়াও সমাজবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর মধ্যে অন্যতম হল –
- সমাজবিজ্ঞান সম্পূর্ণভাবে সমাজের অধ্যায়ন করে থাকে,
- সমাজবিজ্ঞান সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির অধ্যয়ন করে থাকে,
- সমাজবিজ্ঞান সামাজিক সম্পর্কসমূহের অধ্যায়নকারী বিজ্ঞান,
- বিভিন্ন সামাজিক প্রক্রিয়াসমূহ আলোচনা করা সমাজবিজ্ঞানের অন্তর্গত প্রভৃতি।
উপসংহার (Conclusion)
পরিশেষে বলা যায়, সমাজবিজ্ঞান হল একটি সামাজিক বিজ্ঞান। এটি সমাজের বিভিন্ন কার্যধারা বা সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের বিভিন্ন কার্যধারা বা জীবন চক্র যথাযথভাবে আলোকপাত করে থাকে। সামাজিক বিভিন্ন দিক যেমন – অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় প্রভৃতি সম্পর্কে যথাযথ আলোচনা সমাজবিজ্ঞানের অন্তর্গত বিষয়। তাই সমাজবিজ্ঞান থেকে সমাজের একটি সম্পূর্ণ প্রতিচ্ছবি যথাযথভাবে পরিলক্ষিত হয়।
প্রাথমিক গোষ্ঠীর ধারণা, সংজ্ঞা, বৈশিষ্ঠ্য ও শিক্ষাগত তাৎপর্য | সামাজিক গোষ্ঠীর ধারণা, সংজ্ঞা ও শ্রেণীবিভাগ |
শিশুর সামাজিকীকরণে পরিবারের ভূমিকা | শিশুর সামাজিকীকরণে বিদ্যালয়ের ভূমিকা |
তথ্যসূত্র (Reference)
- Brown, F. J. (1954). Educational Sociology. New York: Prentice-Hall.
- Bhattacharjee, Srinivas. (1996). Philosophical & Sociological Foundation of Education. Herald book service.
- Das, P. (2007). Sociological Foundation of Education. New Delhi: Authorspress
- Shukla, S & K Kumar. (1985). Sociological Perspective in Education. New Delhi, Chanakya
Publications - Sodhi, T.S & Suri, Aruna. (1998). Philosophical & Sociological Foundations of Education, H.P Bhargav Book House, Agra,
প্রশ্ন – সমাজবিজ্ঞান কি
উত্তর – সমাজবিজ্ঞান হল সমাজ এবং মানুষের সামাজিক সম্পর্কের বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা। তাই সমাজবিজ্ঞানী কোভালেভস্কি বলেছেন – সমাজবিজ্ঞান হল সামাজিক সংগঠন এবং সমাজ পরিবর্তনের বিজ্ঞান।
প্রশ্ন – সমাজবিজ্ঞান এর জনক কে
উত্তর – ফ্রান্সের দার্শনিক ও সমাজবিদ্ Auguste Comte, 1837 সালে ‘সর্বপ্রথম সমাজবিজ্ঞান (Sociology) শব্দটির ব্যবহার করেন। এই জন্য Auguste Comte -কে ‘সমাজবিজ্ঞানের জনক’ (Father of Sociology) বলে।
আরোও পড়ুন
- যোগাযোগ কাকে বলে | যোগাযোগ প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য | What is Definition of Communication
- যোগাযোগ প্রক্রিয়ার উপাদান | 8 Essential Components of Communication
- শিক্ষার সমাজতত্ত্বের পরিধি | Scope of Sociology of Education
- সামাজিক স্তরবিন্যাস কি | সামাজিক স্তরবিন্যাসের ধরন | Types of Social Stratification
- Social Mobility: সামাজিক সচলতা কাকে বলে | সামাজিক সচলতার বৈশিষ্ট্য
- Types of Social Mobility: সামাজিক সচলতার প্রকারভেদ