বয়স্ক শিক্ষা কাকে বলে | বয়স্ক শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনীয়তা (Concept of Adult Education)

‘সকলের জন্য শিক্ষা’ – গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষের এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে নিরক্ষরতা অভিযান কর্মসূচি গৃহীত হয়। এই কর্মসূচির মধ্যে একটি অন্যতম কর্মসূচি হল 15 থেকে 35 বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করা। যেটি বয়স্ক শিক্ষার ধারণা (Concept of Adult Education) হিসেবে পরিচিত।

স্বাধীনতার পর ভারত সরকার আশা করেছিলেন যে শিক্ষার মাধ্যমে নিরক্ষরতাদূর করা সম্ভবপর হবে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সকলের মধ্যে শিক্ষা প্রচার ও প্রসার করা সম্ভবপর হয়নি। এই কারণে স্বাধীন ভারতের সমস্ত নাগরিককে সাক্ষরতা করার উদ্দেশ্যে বয়স্ক শিক্ষা কর্মসূচি গৃহীত হয়।

বয়স্ক শিক্ষা কাকে বলে (Concept of Adult Education)

স্বাধীনতার পর প্রথম কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতিতে বয়স্ক শিক্ষার গুরুত্বের কথা বলা হয়। আবার ১৯৪৮ সালের মোহনলাল সাক্সেনার নেতৃত্বে একটি উপকমিটি গঠিত হয় যার কাজ ছিল বয়স্ক শিক্ষা বিস্তারে সুপারিশ করা।

এই কমিটি একটি প্রকল্প গ্রহণ করেন যেটির নাম ছিল ‘বয়স্ক শিক্ষা ও স্বাক্ষরতা’। এই কমিটিতে ৭ জন ভারতীয় ছিলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এই প্রকল্পের জন্য এক কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলেন।

বয়স্ক শিক্ষা হল যে সমস্ত শিক্ষার্থীরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত বা অক্ষরজ্ঞানহীন তাদেরকে উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষিত করে তোলা।

তাই অক্ষর জ্ঞানহীন বয়স্ক মানুষদের জন্য যে শিক্ষার ব্যবস্থা করা ও শিক্ষা প্রদান করা তাকে বয়স্ক শিক্ষা বলে।

বয়স্ক শিক্ষা কাকে বলে এই সম্পর্কে ডি. এম. গিল বলেছেন – ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী মানুষের হাতেই কৃষি ও শিল্পের বিকাশের ভার। কিন্তু এদের মধ্যে সঠিক শিক্ষার অভাবে বিপুল পরিমাণ আর্থিক অপচয় ঘটে চলেছে। তাই এদের সঠিকভাবে পেশাগত শিক্ষাদান করাই মাধ্যমে আর্থিক উন্নয়নে সহায়তা করাই হল বয়স্ক শিক্ষা।

আবার, Earnest Barker বলেছেন – বয়স্ক নিরক্ষর মানুষদের জীবন দর্শন ও কাজকর্মের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আংশিক সময় ভিত্তিতে যে শিক্ষা, তাকে বয়স্ক শিক্ষা বলে।

সুতরাং বয়স্ক শিক্ষা হল –

  • বয়স্কদের সাক্ষরতায় অংশগ্রহণ করানো,
  • কারিগরি শিক্ষা অর্জন,
  • শিক্ষার প্রতি ভালোবাসা ও সচেতনতা জাগানো,
  • পেশাগত, ব্যক্তিগত শিক্ষা প্রদান এবং দক্ষতা অর্জন,
  • ব্যক্তির সামাজিক ও ব্যক্তিগত উন্নয়ন সাধন।

বয়স্ক শিক্ষার লক্ষ্য (Aims of Adult Education)

বয়স্ক শিক্ষার লক্ষ্য গুলি হল –

i) সকল শিক্ষার্থীদের স্বাক্ষর করে তোলা,

ii) গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা জাগানো,

iii) নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ সাধন,

iv) ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি জাগানো,

v) জনগণের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব গঠন,

vi) দেশের সাংস্কৃতিক মানের উন্নয়ন,

vii) পেশাগত দক্ষতার বিকাশ সাধন প্রভৃতি

বয়স্ক শিক্ষার উদ্দেশ্য (Objectives of Adult Education)

Brystu বয়স্ক শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন – দৈনন্দিন জীবনে মানুষ তার প্রয়োজনে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যা কিছু শেখে ও বুদ্ধিবৃত্তির উন্নয়নে তাদের শক্তির যতটুকু অংশ ব্যয় হয় তার সবটুকুই বয়স্ক শিক্ষার সঙ্গে সংযুক্ত।

বয়স্ক শিক্ষার উদ্দেশ্য বিভিন্ন দিক থেকে পরিলক্ষিত হয়। সেগুলি হল নিম্নলিখিত। –

1. সাক্ষরতার প্রসার ঘটানো

দেশের সাংবিধানিক লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যে বয়স্ক শিক্ষার উদ্দেশ্য হল নিরক্ষর ব্যক্তিদের মধ্যে শিক্ষার মাধ্যমে সাক্ষরতার প্রসার ঘটনা। অর্থাৎ নিরক্ষর ব্যাক্তিদের মধ্যে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়া।

2. স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদান

স্বাস্থ্যই সম্পদ। নিরক্ষর মানুষদের মধ্যে স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবনাচিন্তা খুব বেশি পরিলক্ষিত হয় না। তাই স্বাস্থ্য রক্ষা সম্পর্কে জনগণের মধ্যে প্রাথমিক ধারণা গড়ে তোলা ও স্বাস্থ্য শিক্ষার মধ্য দিয়ে জনসংখ্যার বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করা বয়স্ক শিক্ষার উদ্দেশ্য।

3. অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কার দূরীকরণ

শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তিকে অন্ধকার জগতের মধ্যে থেকে আলোর জগতে নিয়ে আসে সম্ভবপর হয়। তাই বয়স্ক শিক্ষার মধ্য দিয়ে সমাজের যাবতীয় অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার দূরীকরণ করা সম্ভবপর হয়।

4. জাতীয় নিরাপত্তা ও জাতীয় সংহতি স্থাপন

বয়স্ক শিক্ষার উদ্দেশ্য হল জাতীয় নিরাপত্তা ও জাতীয় সংহতি স্থাপন করা। কারণ জাতীয় সংহতি ও জাতীয় নিরাপত্তা বজায় রাখার মধ্য দিয়ে জনগণের মধ্যে সামাজিক ও আর্থিক উন্নতি সাধন করা সম্ভবপর হয়।

5. গণতান্ত্রিক আদর্শ গড়ে তোলা

গণতান্ত্রিক আদর্শ ব্যক্তিকে সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তোলে। তাই বয়স্ক শিক্ষার মাধ্যমে উপযুক্ত গণতান্ত্রিক আদর্শ বা গণতান্ত্রিক পরিবেশ গঠন করাই হল বয়স্ক শিক্ষার উদ্দেশ্য। এই গণতান্ত্রিক আদর্শ ব্যক্তিকে ও দেশকে উন্নতির পথে নিয়ে যেতে সক্ষম করবে।

6. ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস গঠন

আত্মবিশ্বাস সমাজ উন্নতিতে বিশেষভাবে সহায়তা করে। বয়স্ক শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবলমাত্র নিরক্ষর মানুষকে সাক্ষর হিসেবে গড়ে তোলা নয় বরং ব্যক্তিকে আত্মবিশ্বাসী হতে বা ব্যক্তির মধ্যে আত্মবিশ্বাস গঠন করতে বিশেষভাবে সহায়ক।

আরোও পোস্ট পড়ুন – Click Here Now

বয়স্ক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা (Needs of Adult Education)

Needs of Adult Education
Needs of Adult Education

স্বাধীনতার পর ভারতবর্ষে বিভিন্ন কারণে বয়স্ক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বয়স্ক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা গুলি এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হল –

বয়স্ক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা দুটি দিক থেকে পরিলক্ষিত হয়, যথা –

1. ব্যক্তিগত প্রয়োজনীয়তা

বয়স্ক শিক্ষার প্রথম এবং অন্যতম প্রয়োজনীয়তা হল ব্যক্তিগত প্রয়োজনীয়তা। এই ব্যক্তিগত প্রয়োজনীয়তার মধ্যে যে সমস্ত বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, সেগুলি হল –

  • ব্যক্তির আত্মসচেতনতা বৃদ্ধি,
  • পেশাগত দক্ষতার বিকাশ সাধন,
  • স্বাস্থ্য পালনের বা স্বাস্থ্য বজায় রাখার নীতি পালন করা,
  • বয়স্ক নিরক্ষরদের মধ্যে সাক্ষরতার প্রসার ঘটানো,
  • ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস গঠন করা,
  • সাংস্কৃতিক ও নৈতিক মূল্যবোধ গঠন,
  • শিক্ষার প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গঠন প্রভৃতি।

2. সামাজিক উন্নতি

বয়স্ক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা গুলির মধ্যে সামাজিক উন্নতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বয়স্ক শিক্ষার সামাজিক উন্নতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয় গুলি হল –

  • সাক্ষরতার মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা,
  • জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণকে কার্যকরী করা,
  • সমাজের মধ্যে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার দূরীকরণ,
  • জাতীয় সংহতি স্থাপন করা,
  • সামাজিক উন্নয়নের কাজে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে সক্ষম করে তোলা প্রভৃতি।
সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষার ধারণা, 2 টি সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্যব্যাপক অর্থে শিক্ষার ধারণা, সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য
ভাববাদের ধারণা, সংজ্ঞা, মূলনীতি ও শিক্ষায় প্রভাবপ্রয়োগবাদের ধারণা, সংজ্ঞা, মূলনীতি ও শিক্ষায় প্রভাব
বাস্তববাদ বা বস্তুবাদের ধারণা, সংজ্ঞা, মূলনীতি ও শিক্ষায় প্রভাব প্রকৃতিবাদের ধারণা, সংজ্ঞা, মূলনীতি ও শিক্ষায় প্রভাব
শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা : ধারণা, সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্যডেলর কমিশনের আধুনিক শিক্ষার চারটি স্তম্ভ

উপসংহার (Conclusion)

পরিশেষে বলা যায়, স্বাধীনতার পর গৃহীত অন্যতম কর্মসূচি হল বয়স্ক শিক্ষা। কিন্তু বিভিন্ন কারণে বয়স্ক শিক্ষার সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। বয়স্ক শিক্ষা নানা সমস্যা থাকা সত্ত্বেও স্বাধীন ভারতে বয়স্ক শিক্ষা কর্মসূচি জাতীয় সাক্ষরতা অভিযানের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

তাই এই কর্মসূচি পুরোপুরি সফল না হলেও আংশিকভাবে সফল হয়েছিল ও ভারতবর্ষকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

সুতরাং রাজনৈতিক, সামাজিক, জাতীয় ও শিক্ষাগত দিক থেকে বয়স্ক শিক্ষা প্রয়োজনীয়তা বর্তমান এবং এটি ব্যক্তির বিকাশে বিভিন্নভাবে সহায়তা করে থাকে।

তথ্যসূত্র (References)

  • V.R. Taneja, Educational Thoughts & Practice. Sterling Publication Pvt. Ltd. New Delhi
  • Nayak, B.K, Text Book of Foundation of Education. Cuttack, Odisha: KitabMhal
  • Ravi, S. Samuel, A Comprehensive Study of Education, Fourth Printing-May 2016, Delhi – 110092, ISBN – 978-81-203-4182-1
  • Aggarwal, J. C., Theory and Principles of Education. 13th Ed. Vikas Publishing House Pvt. Ltd.
  • Internet sources

প্রশ্ন – বয়স্ক শিক্ষার লক্ষ্য গুলি কি কি

উত্তর – বয়স্ক শিক্ষার লক্ষ্য গুলি হল – জাতীয় বিকাশ সাধন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ, ব্যক্তিগত দক্ষতার উন্নয়ন, পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি, জাতীয় সংহতি স্থাপন, আর্থিক বিকাশে সহায়তা, নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ সাধন প্রভৃতি।

প্রশ্ন – বয়স্ক শিক্ষাকে সামাজিক শিক্ষা বলে কে অভিহিত করেছেন

উত্তর – 1949 সালে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ সর্বপ্রথম বয়স্ক শিক্ষাকে সামাজিক শিক্ষা বলে অভিহিত করেছেন।

প্রশ্ন – বয়স্ক শিক্ষার অপর নাম কি

উত্তর – বয়স্ক শিক্ষার অপর নাম হল সামাজিক শিক্ষা।

আরোও পড়ুন

1 thought on “বয়স্ক শিক্ষা কাকে বলে | বয়স্ক শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনীয়তা (Concept of Adult Education)”

Leave a Comment

close