বুনিয়াদি শিক্ষা হল গান্ধীজী প্রবর্তিত একটি নতুন শিক্ষানীতি। বুনিয়াদি শিক্ষা (Basic Education) অনুযায়ী হাতে-কলমে কাজ করার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা অনির্ভর ও স্বাবলম্বী হয়ে গড়ে উঠবে।
আধুনিক শিক্ষার লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীদের সর্বাঙ্গীন বিকাশ সাধন করা। আধুনিক শিক্ষার লক্ষ্যকে পরিপূর্ণ করার জন্য গান্ধীজি এক নতুন ধরনের শিক্ষা নীতি কথা বলেছেন। এটি বুনিয়াদি শিক্ষা নামে খ্যাত।
বুনিয়াদি শিক্ষা কি (Concept of Basic Education)
গ্রামীন কৃষিভিত্তিক ভারতবর্ষের উন্নতিকল্পে ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে গান্ধীজী সর্বপ্রথম বুনিয়াদি শিক্ষার প্রবর্তনের কথা বলেন। ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে গান্ধীজী ‘হরিজন পত্রিকা’-তে বুনিয়াদি শিক্ষা পরিকল্পনা নামক একটি আলোচনা প্রকাশিত হয়।
পরবর্তীকালে গান্ধীজীর এই নতুন শিক্ষানীতি পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত হয়ে বুনিয়াদি শিক্ষা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। তখন থেকে এই বুনিয়াদি শিক্ষা ব্যবস্থা ‘নঈতালিম’ নামে অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাই নঈতালিম শিক্ষা হল গান্ধীজীর প্রবর্তিত বুনিয়াদি শিক্ষার পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত শিক্ষা ব্যবস্থা।
বুনিয়াদি শিক্ষা কি
বুনিয়াদি শিক্ষা হল যে শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের স্বনির্ভর ও সাবলম্বী করে গড়ে তোলা সম্ভবপর হয়। তাই বুনিয়াদি শিক্ষার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধন সম্ভব পর হবে। তাই গান্ধীজি বলেছিলেন – শিক্ষা হল ব্যক্তির বা শিক্ষার্থীর দেহ, মন ও আত্মার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন।
বুনিয়াদি শিক্ষার বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Basic Education)
গান্ধীজী প্রবর্তিত বুনিয়াদি শিক্ষা (Basic Education) ব্যবস্থার যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়, সেগুলি হল নিম্নলিখিত –
i) বুনিয়াদি শিক্ষা সাত থেকে ১৪ বছর বয়সি ছেলেমেয়েদের জন্য শিক্ষা হবে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক।
ii) এই শিক্ষাব্যবস্থা কোন নির্দিষ্ট শিল্পকে কেন্দ্র করে গঠিত হবে। যার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা কর্মজগতে প্রবেশের প্রাথমিক পথ পাবে।
iii) বুনিয়াদি শিক্ষা হবে উৎপাদনমুখী। অর্থাৎ এই শিক্ষার মাধ্যমে উৎপাদন করা সম্ভব করা হবে।
iv) বুনিয়াদি শিক্ষা হবে আবশ্যিক প্রকৃতির। অর্থাৎ এই শিক্ষা শিশুর আবশ্যিক প্রয়োজনীয় বিষয় হিসেবে গণ্য হবে।
v) বুনিয়াদি শিক্ষা শিক্ষার্থীদের জীবনের সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত হবে।
vi) বুনিয়াদি শিক্ষা ব্যবস্থা হবে মাতৃভাষার উপর ভিত্তি করে। অর্থাৎ গান্ধীজী বুনিয়াদি শিক্ষা ক্ষেত্রে মাতৃভাষার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
vii) বুনিয়াদি শিক্ষা কেবলমাত্র শিশুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং এটিতে পিতা-মাতার শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত হবে।
viii) বুনিয়াদি শিক্ষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল অনুবন্ধ প্রণালীতে শিক্ষাদান করা।
বুনিয়াদি শিক্ষার কাঠামো
বুনিয়াদি শিক্ষার কাঠামো চারটি ভাগে বিভক্ত। যথা –
- প্রাক-বুনিয়াদি শিক্ষাস্তর (৭ বছরের আগে),
- বুনিয়াদি শিক্ষাস্তর (৭-১০ বছর),
- উত্তর বুনিয়াদি শিক্ষাস্তর (১১-১৪ বছর) এবং
- প্রাপ্তবয়স্ক স্তর (১৪ বছরের পর)।
বুনিয়াদি শিক্ষার সুবিধা (Advantages of Basic Education)
গান্ধিজির বুনিয়াদি শিক্ষাব্যবস্থার (Basic Education) ব্যবস্থার যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা পরিলক্ষিত হয়, সেগুলি হল –
1. সক্রিয়তা ভিত্তিক শিক্ষা
গান্ধীজি প্রবর্তিত বুনিয়াদি শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের সক্রিয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করে গড়ে ওঠে। ফলে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সক্রিয়তা মূলক কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে। তাই বুনিয়াদি শিক্ষার (Basic Education) অন্যতম সুবিধা হল সক্রিয়তা ভিত্তিক শিক্ষা।
2. শ্রমের প্রতি মর্যাদা দান
বুনিয়াদি শিক্ষার অন্যতম সুবিধা হল এই শিক্ষার ফলে শিক্ষার্থীরা শ্রমের প্রতি মর্যাদা দান দিতে সক্ষম হবে। কারণ এই শিক্ষা সম্পূর্ণভাবে কায়িক পরিশ্রমের উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে।
3. শিক্ষার্থীদের নৈতিক গুণাবলীর বিকাশ
বুনিয়াদি শিক্ষার পাঠক্রম সত্য ও ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাই গান্ধীজীর প্রবর্তিত বুনিয়াদি শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নৈতিক গুণাবলীর বিকাশ সাধন সম্ভবপর হবে।
4. বৃত্তিমূলক শিক্ষার সম্প্রসারণ
বুনিয়াদি শিক্ষা অন্যতম সুবিধা হল বৃত্তিমূলক শিক্ষার সম্প্রসারণ। কারণ বুনিয়াদি শিক্ষার মূল ভিত্তি হল বৃত্তিমুখীনতা। তাই শিক্ষার্থীরা এই শিক্ষার মাধ্যমে বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে।
5. সৃজনশীলতার বিকাশ সাধন
বুনিয়াদি শিক্ষা শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা লালন-পালনের মধ্য দিয়ে সৃজনশীলতার বিকাশ সাধনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই সৃজনশীলতার বিকাশ সাধনের ক্ষেত্রে বুনিয়াদি শিক্ষা (Basic Education)-র সুবিধা অপরিসীম।
6. অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা বা শ্রীবৃদ্ধি
বুনিয়াদি শিক্ষার মূল ভিত্তি হল বৃত্তিমুখীনতা। শিক্ষার্থীরা এই বৃত্তিমুখী শিক্ষার মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা বা অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি লাভ করবে। ফলে গ্রাম বাংলার মানুষের মধ্যে আর্থিক দুর্দশা দূরীকরণ করা যাবে এই শিক্ষার মধ্য দিয়ে। তাই এদিক থেকে এটি বিশেষ সুবিধা জনক।
7. বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রদান
বুনিয়াদি শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে বিভিন্ন কাজ করার মধ্য দিয়ে (যেমন – চরকা কাটা, মাটির পুতুল তৈরি প্রভৃতি) বাস্তব অভিজ্ঞতা সহজে লাভ করতে সক্ষম হবে। তাই বুনিয়াদি শিক্ষা বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রদানে শিক্ষার্থীদের বিশেষ সুবিধা প্রদান করে থাকে।
8. কর্মজগতের প্রবেশের পথ সুগম
বুনিয়াদি শিক্ষা শিক্ষার্থীদের কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে বা কর্মজীবনে প্রবেশের পথকে সুগম করতে সহায়তা করে। তাই বুনিয়াদি শিক্ষা সুবিধা হল কর্মমুখীণতা বা কর্মজগতে প্রবেশের প্রাথমিক শিক্ষা পদ্ধতি।
বুনিয়াদি শিক্ষার অসুবিধা (Disadvantages of Basic Education)
গান্ধীজি প্রবর্তিত বুনিয়াদি শিক্ষা (Basic Education) ব্যবস্থার বিভিন্ন সুবিধা থাকা সত্ত্বেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই শিক্ষা ব্যবস্থার বিশেষ অসুবিধা পরিলক্ষিত হয়। সেগুলি হল –
1. গ্রামভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা
গান্ধীজী প্রবর্তিত বুনিয়াদি শিক্ষার প্রধান অসুবিধা হল এটি গ্রামভিত্তিক বা গ্রামকে কেন্দ্র করে গঠিত। শহরের শিক্ষার্থীরা এই শিক্ষা পদ্ধতির থেকে কিভাবে উপকৃত হবে তা গান্ধীজি পরিষ্কার করে উল্লেখ করেননি।
2. প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অভাব
গান্ধীজি প্রবর্তিত বুনিয়াদি শিক্ষার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অভাব এই শিক্ষাকে বিশেষ অসুবিধা জনক করে তুলেছিল। কারণ গান্ধীজী বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন তাই এক্ষেত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও দক্ষ শিক্ষকের অভাব এই শিক্ষার প্রধান অসুবিধা। ফলে এই শিক্ষাকে বাস্তবায়িত ও দীর্ঘস্থায়ী করা যায়নি।
3. শিল্পের প্রতি অতি সক্রিয়তা
গান্ধীজীর প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থায় শিল্পের প্রতি অতি সক্রিয়তার ফলে অনেক শিক্ষার্থীরা শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কারণ শিক্ষার্থীরা অন্য কোন বিষয় নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ পেত না।
4. আর্থিক স্বনির্ভরতা
বুনিয়াদি শিক্ষায় বলা হয়েছে শিক্ষার্থীরা নিজেদের উৎপাদিত দ্রব্যের ভিত্তিতে যে পারিশ্রমিক পাবে সেই পারিশ্রমিকের মাধ্যমে শিক্ষার জন্য যাবতীয় ব্যয় করতে পারবে। কিন্তু এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের দ্বারা উৎপাদিত দ্রব্যের চাহিদা না থাকার কারণে আর্থিক স্বনির্ভরতা অনেকখানি হ্রাস হয়েছে।
6. সংগঠনের ত্রুটি
বুনিয়াদি শিক্ষার অন্যতম অসুবিধা হল সংগঠনের ত্রুটি। অর্থাৎ এই শিক্ষা ব্যবস্থার বাস্তবায়নের জন্য সঠিক পরিকল্পনার অভাব ছিল। যার ফলে এই শিক্ষা সুদূরপ্রসারী হতে ব্যর্থ হয়েছে।
এছাড়া গান্ধীজী বুনিয়াদি শিক্ষায় প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি অধিক গুরুত্ব করেছিল কিন্তু উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে এই শিক্ষার প্রকৃতি কেমন হবে তা ব্যাখ্যা করেননি। ফলে সঠিক নির্দেশ না থাকায় অনেক শিক্ষার্থী বুনিয়াদি শিক্ষা গ্রহণ করতে অনীহা প্রকাশ করেছিল।
উপসংহার (Conclusion)
পরিশেষে বলা যায়, গ্রামীণ অর্থনীতিকে ও গ্রামীণ জীবন যাপনকে উন্নতি করার লক্ষ্যে গান্ধীজীর প্রবর্তিত বুনিয়াদি শিক্ষা (Basic Education) বা নঈতালিম শিক্ষা অধিক প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু কিছু ত্রুটিজনিত কারণে গান্ধীজী প্রবর্তিত বুনিয়াদি শিক্ষা বিশেষ প্রসার লাভ করেনি।
তাই এই বুনিয়াদি শিক্ষার সুফল থেকে শিক্ষার্থীরা বর্তমানে বঞ্চিত। তাই অনেক সমালোচকগণ বলেন – গান্ধীজীর প্রবর্তিত এই বুনিয়াদি শিক্ষার যথাযথ বিকাশ লাভ হলে গ্রাম বাংলার চিত্র অনেকখানি পরিবর্তন হতো।
তথ্যসূত্র (References)
- V.R. Taneja, Educational Thoughts & Practice. Sterling Publication Pvt. Ltd. New Delhi
- Nayak, B.K, Text Book of Foundation of Education. Cuttack, Odisha: KitabMhal
- Ravi, S. Samuel, A Comprehensive Study of Education, Fourth Printing-May 2016, Delhi – 110092, ISBN – 978-81-203-4182-1,
- Internet sources
প্রশ্ন – বুনিয়াদি শিক্ষার পরিকল্পনা করেন কে?
উত্তর – জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী হরিজন পত্রিকায় বুনিয়াদি শিক্ষার পরিকল্পনার কথা ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করেন।
প্রশ্ন – বুনিয়াদি শিক্ষার অপর নাম কি?
উত্তর – বুনিয়াদি শিক্ষার অপর নাম হল – নঈতালিম শিক্ষাব্যবস্থা। কারণ গান্ধীজি বুনিয়াদি শিক্ষাকে সংস্করণ ও পরিমার্জিত করে প্রকাশ করেছিলেন। তাই এটি নঈতালিম বা নয়াতালিম শিক্ষা হিসেবে অধিক পরিচিত।
প্রশ্ন – মহাত্মা গান্ধীর মতে শিক্ষা কি?
উত্তর – মহাত্মা গান্ধীর মতে শিক্ষা হল – ব্যক্তির দেহ, মন ও আত্মার পরিপূর্ণ পিতার সাধন করা। (“By education, I mean all-around drawing out of the best in child and man-body mind and spirit.”)
আরোও পড়ুন
- শিক্ষার গণতান্ত্রিক লক্ষ্য বলতে কী বোঝো | Democratic Aim of Education
- মন্তেসরি শিক্ষা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য | Characteristics of Montessori Education System
- শিক্ষায় মূল্যবোধের গুরুত্ব | Importance of Values in Education
- মন্তেসরি শিক্ষা পদ্ধতির সুবিধা ও অসুবিধা | Montessori Education
- প্রকল্প পদ্ধতি কাকে বলে | এই পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য | Project Method
- কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতি কি | কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য | 8 Characteristics of Kindergarten Method
1 thought on “গান্ধীজীর বুনিয়াদি শিক্ষা | বুনিয়াদি শিক্ষার বৈশিষ্ট্য, সুবিধা ও অসুবিধা (Advantages and Disadvantages of Basic Education)”