অষ্টাতক শতকের শিক্ষা ক্ষেত্রে একটি অন্যতম জ্যোতিষ্ক হলেন ফ্রয়েবেল। ফ্রয়েবেলের শিক্ষা দর্শন ও শিক্ষা চিন্তা (Froebel Contribution to Education) তৎকালীন শিক্ষাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল।
ফ্রয়েবেল ১৭৮২ সালে জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করেন। ফ্রয়েবেল ছিলেন স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ জন হার্বাট এর সমসাময়িক। তাই তার শিক্ষা চিন্তায় নিজস্ব মৌলিকতার সব লক্ষ্য করা যায়। এইজন্য তার শিক্ষা চিন্তায় দার্শনিক আদ্ধাত্ববাদ, বৈজ্ঞানিক অভিব্যক্তিবাদ এবং মনোবৈজ্ঞানিক কর্মবাদ প্রতিফলিত হয়েছে। ফ্রয়েবেলের জীবন দর্শন আধ্যাত্মিক প্রকৃতির ছিল। তাই তিনি বলেছিলেন – সবকিছু ঈশ্বর সৃষ্ট, ঈশ্বর মানুষের জীবনের সবকিছু ঘটনাকে এ এক নিয়মের মধ্যে গঠিত করে রেখেছেন।
ফ্রয়েবেলের শিক্ষা দর্শন বা শিক্ষা চিন্তা | Froebel Contribution to Education
ফ্রয়েবেলের শিক্ষা দর্শন বা শিক্ষা চিন্তা তাঁর জীবন দর্শনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। ফ্রয়েবেলের শিক্ষা দর্শন বা শিক্ষা চিন্তা বিশ্লেষণ করলে যে সমস্ত দিক পরিলক্ষিত হয়, সেগুলি হল নিম্নলিখিত –
ফ্রয়েবেলের শিক্ষা চিন্তা অনুযায়ী শিক্ষার লক্ষ্য
ফ্রয়েবেলের শিক্ষা চিন্তা অনুযায়ী শিক্ষার লক্ষ্য গুলি হল –
i) আধ্যাত্মিক উপলব্ধি। অর্থাৎ বিশ্ব জগতের মূল শক্তি এক ও অবিনশ্বর হল ঈশ্বর। আর শিক্ষার লক্ষ্য হবে এই আধ্যাত্মিক তত্ত্বকে উপলব্ধি করা।
ii) শিশুর মধ্যে সুপ্ত গুণাবলীর বিকাশ সাধন। অর্থাৎ শিশুরা বিভিন্ন গুণাবলী নিয়ে জন্মায়। আর শিক্ষার লক্ষ্য হবে শিশুর মধ্যে এই সমস্ত গুণের উন্মেষ সাধন।
iii) আত্মসক্রিয়তার শিক্ষা প্রদান। অর্থাৎ শিক্ষার লক্ষ্য হলো ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধন। তাই ফ্রয়েবেল বলেছেন – মানুষ সমাজে শিক্ষা অন্য মানুষের সহযোগিতার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে। তাই শিশুর অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশের জন্য শিশুকে সক্রিয় হতে সাহায্য করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ রচনা করা।
শিক্ষার পাঠক্রম
পাঠক্রম সম্পর্কে ফ্রয়েবেলের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সম্পূর্ণ বস্তু ধর্মী প্রকৃতির। অর্থাৎ তিনি আধ্যাত্মবাদী হলেও পাঠক্রমের মধ্যে তার বাস্তবধর্মী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। পাঠক্রম সম্পর্কে ফ্রয়েবেল যে সমস্ত বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন, সেগুলি হল –
i) ভাষা, ii) গণিত, iii) প্রকৃতি পরিচয়, iv) ধর্মীয় বিষয়, v) ইতিহাস ভূগোল, vi) বিজ্ঞান, vii) অঙ্কন, viii) হাতের কাজ প্রভৃতি।
পাঠক্রম সম্পর্কে ফ্রয়েবেল বলেছেন – শিশুর মধ্যে সৌন্দর্যবোধ জাগ্রত করার জন্য অংকন বিদ্যাকে পাঠক্রমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
তাছাড়া তিনি পাঠক্রমে গণিত শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাই তিনি বলেছেন – গণিত হল মানুষের জীবনের নিয়ম ধারার সর্বকৃষ্ট প্রকাশ।
ফ্রয়েবেলের শিক্ষা পদ্ধতি
ফ্রয়েবেলের শিক্ষা চিন্তার মধ্যে অন্যতম বিশেষ দিক হল শিক্ষা পদ্ধতি বা শিক্ষাদান পদ্ধতি। ফ্রয়েবেলের শিক্ষা পদ্ধতি কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা পদ্ধতি নামে অধিক পরিচিত। কিন্ডারগার্টেন কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল – শিশু উদ্যান বা শিশুদের জন্য বাগান। শিশুরা হল সেই উদ্যানের চারা গাছ স্বরূপ।
তিনি বলেন – শিক্ষকের কাজ হবে বাগানের মালির মতন। অর্থাৎ চারা গাছ স্বরূপ শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে যত্নে লালন পালনের মাধ্যমে বড় করে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে কেবলমাত্র শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জ্ঞানজগতের প্রবেশের ক্ষেত্রে সহায়কের ভূমিকা পালন করবে।
তিনি কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা পদ্ধতিতে বিভিন্ন উপহার ও বৃত্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের কথা বলেছেন। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সক্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে। ফলে শিক্ষার্থীরা সহজে কোনো বিষয় শিখতে পারবে।
তাই ফ্রয়েবেল বলেছেন – আদর্শ শিক্ষণ পদ্ধতি হল সেটি যেখানে শিশুরা আত্মসক্রিয়তার মাধ্যমে শিখতে পারবে।
বিদ্যালয় স্থাপন
ফ্রয়েবেলের শিক্ষা চিন্তার অন্যতম দিক হল বিদ্যালয় স্থাপন। তিনি শিশুদের শিক্ষার জন্য ১৮৩৭ সালে সুইজারল্যান্ডের ব্ল্যাকেনবুর্গ গ্রামে ৪ থেকে ৬ বছর বয়সী শিশুদের জন্য কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়ে শিশুরা আত্মসক্রিয়তার মাধ্যমে স্বাধীনভাবে খেলা, কাজ ও গানের মাধ্যমে শিক্ষনীয় বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে।
শিক্ষায় শৃঙ্খলা
ফ্রয়েবেল গতানুগতিক ও বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়ার শৃঙ্খলা বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি শিশুকে মুক্ত শৃঙ্খলা দেওয়ার পক্ষপাতি ছিলেন। তিনি বলেন – স্বতঃস্ফূর্ত শৃঙ্খলার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজেরা সমাজের বিভিন্ন বিষয়ের আয়ত্ত করতে শিখবে। ফ্রয়েবেলের শৃঙ্খলা তত্ত্বকে সামাজিক শৃঙ্খলা তত্ত্বও বলা হয়।
উপসংহার (Conclusion)
সর্বোপরি বলা যায়, ফ্রয়েবেলের শিক্ষা চিন্তা বিভিন্নভাবে সমালোচিত হলেও বর্তমানকালে তার শিক্ষা চিন্তার ফলশ্রুতি হিসেবে কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা পদ্ধতি তারা পৃথিবীতে অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। তাই তার শিক্ষা চিন্তা আধুনিকতার ছাপ লক্ষ্য করা যায়। ফলে তার শিক্ষা চিন্তা বা শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদান আধুনিককালে শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
তথ্যসূত্র (References)
- Ravi, S. Samuel, A Comprehensive Study of Education, Fourth Printing-May 2016, Delhi – 110092, ISBN – 978-81-203-4182-1
- Education in India-Past-Present-Future, Vol. I and II, J. P. Banerjee
- Landmarks in the History of Modern Indian Education, J. C. Aggarwal
- Internet Sources
প্রশ্ন – ফ্রয়েবেলের শিক্ষা পদ্ধতি বৈশিষ্ট্য
উত্তর – ফ্রয়েবেলের শিক্ষা পদ্ধতি বৈশিষ্ট্য হলো বাস্তব ধর্মী, সক্রিয়তা মূলক, স্বাধীন প্রকৃতির প্রভৃতি।
প্রশ্ন – শিক্ষা ক্ষেত্রে স্বাধীনতা সম্পর্কে ফ্রোবেলের দৃষ্টিভঙ্গি কি ছিল?
উত্তর – ফ্রয়েবেল গতানুগতিক ও বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়ার শৃঙ্খলা বা স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি শিশুকে মুক্ত শৃঙ্খলা বা স্বাধীনতা দেওয়ার পক্ষপাতি ছিলেন। তিনি বলেন – স্বতঃস্ফূর্ত শৃঙ্খলার বা স্বাধীনতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজেরা সমাজের বিভিন্ন বিষয়ের আয়ত্ত করতে শিখবে।
আরোও পড়ুন
- স্বামী বিবেকানন্দের মানুষ গড়ার শিক্ষা সংক্রান্ত ধারণাটি ব্যাখ্যা করো | Man Making Education
- মহাত্মা গান্ধীর শিক্ষা দর্শন | Mahatma Gandhi Philosophy of Education
- সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন শিক্ষা দর্শন | Contribution of Radhakrishnan in Education
- হার্বাট স্পেন্সারের শিক্ষা চিন্তা | Herbert Spencer Contribution to Education
- প্লেটোর শিক্ষা দর্শন ও শিক্ষা তত্ত্ব | Plato Philosophy of Education
- ফ্রয়েবেলের শিক্ষা দর্শন বা শিক্ষা চিন্তা | Froebel Contribution to Education