প্লেটোর শিক্ষা দর্শন ও শিক্ষা তত্ত্ব | Plato Philosophy of Education

শিক্ষা ক্ষেত্রে সব থেকে জনপ্রিয় নাম হল প্লেটো। আজ থেকে বহু বছর আগে তাঁর শিক্ষা দর্শন ও শিক্ষা তত্ত্ব (Plato Philosophy of Education) আধুনিককালের শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক সক্রেটিসের ছাত্র প্লেটো আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব 429 থেকে 423 অবধি এথেন্সের অভিজাত পরিবার জন্মগ্রহণ করেন। তৎকালীন যুদ্ধবিধ্বস্ত এথেন্স প্রতিবেশী রাষ্ট্র স্পার্টার দ্বারা বিধ্বস্ত হয়। এই সময় সত্যের জন্য সক্রেটিসকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। গুরুর মৃত্যুবরণ প্লেটোর মনে গভীর দাগ কাটে এবং তিনি তথাকথিত গণতন্ত্রের প্রতিও বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন। পরবর্তীকালে প্লেটোর শিক্ষায় সামাজিক ও নৈতিক বিষয়টি গুরুত্ব পায় এবং তিনি দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ হিসেবে জগতের কাছে আত্মপ্রকাশ করেন।

প্লেটোর শিক্ষা দর্শন ও শিক্ষা তত্ত্ব | Plato Philosophy of Education

প্লেটোর শিক্ষাদর্শন প্লেটোর শিক্ষা দর্শন ও শিক্ষা তত্ত্ব তাঁর জীবন দর্শন দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত। প্লেটো ছিলেন আদর্শবাদী বা ভাববাদী দার্শনিক। তাই তার শিক্ষা দর্শন ভাববাদ দ্বারা অধিকাংশ ভাবে প্রভাবিত হয়।

আবার অনেক ক্ষেত্রে তাকে বাস্তববাদী দার্শনিক বলা হয়ে থাকে। কারণ তার শিক্ষা দর্শন বাস্তবিক প্রয়োগের মধ্য দিয়ে সূচিত হয়েছিল।

প্লেটোর শিক্ষা দর্শন ও শিক্ষা তত্ত্ব বা শিক্ষা চিন্তা যে সমস্ত দিক থেকে পরিলক্ষিত হয়, সেগুলি হল নিম্নলিখিত –

শিক্ষার লক্ষ্য

প্লেটোর মতে – শিক্ষার লক্ষ্য হল ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে পরিপূর্ণভাবে বা সর্বাঙ্গীনভাবে বিকাশ সাধন করা এবং সমাজ উপযুক্ত করে গড়ে তোলা।

সক্রেটিসের মতো প্লেটো শিক্ষাকে বাস্তবমুখী ও জীবনমুখী করে তোলার পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি বলেন শিক্ষা কেবলমাত্র জ্ঞান আহরণ করা নয়। বরং শিক্ষা ব্যক্তিজীবনের নৈতিক আদর্শ ও তার ব্যক্তিত্বকে পরিপূর্ণভাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে এবং সেই সঙ্গে ব্যক্তি নিজেকে সমাজ জীবনের উপযোগী করে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।

এছাড়া প্লেটো বলেন – ব্যক্তির মধ্যে যে সমস্ত ভালো গুণ বা সম্ভাবনা লুকিয়ে রয়েছে, তাদের পূর্ণ প্রকাশ করা হল শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য।

শিক্ষার পাঠক্রম

Republic গ্রন্থে প্লেটো শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রাথমিক ও উচ্চ শিক্ষা এই দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। এই গ্রন্থ অনুযায়ী শিক্ষার পাঠক্রম সম্পর্কে প্লেটোর চিন্তা ভাবনা পাওয়া যায়।

অর্থাৎ শিক্ষার পাঠক্রম হিসেবে প্লেটো দুই ধরনের পাঠক্রমের কথা বলেন, যথা –

i) প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রম

প্লেটো প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার পাঠক্রম হিসেবে সংগীত, সাহিত্যচর্চা, শারীর শিক্ষা, নৃত্য প্রভৃতির কথা বলেছেন।

প্রাথমিক শিক্ষা পাঠক্রম সম্পর্কে প্লেটো বলেছেন – কেবলমাত্র শিক্ষার্থীদের মনের বিকাশ শিক্ষার প্রধান কাজ নয়। শারীরিক সুস্থতার জন্য শিক্ষায় শারীর শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। তাই তিনি পাঠক্রমের মধ্যে শরীরচর্চা বা ব্যায়ামের অন্তর্ভুক্তির কথা বলেছেন।

ii) মাধ্যমিক স্তর বা উচ্চ শিক্ষা স্তরের পাঠক্রম

প্লেটো বলেন মাধ্যমিক শিক্ষা বা উচ্চ শিক্ষার লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীদের চারিত্রিক, মানসিক, কর্তব্যপরায়ণতা প্রভৃতির বিকাশ সাধন করা। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের সর্বাঙ্গীন বিকাশ সাধন করা মাধ্যমিক বা উচ্চ শিক্ষার লক্ষ্য। তাই এই লক্ষ্য অনুযায়ী শিক্ষার পাঠক্রম নির্ণয় করা আবশ্যিক।

তাই মাধ্যমিক বা উচ্চ শিক্ষার পাঠক্রম হিসাবে প্লেটো গণিত, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিদ্যা, যুক্তিবিদ্যা, অর্থনীতি, আইন শাস্ত্র, নীতি শিক্ষা, দর্শন শাস্ত্র প্রভৃতি পাঠক্রমের মধ্যে অন্তর্ভুক্তি করার কথা বলেছেন।

শিক্ষণ পদ্ধতি

শিক্ষাদান পদ্ধতি হিসেবে প্লেটোর শিক্ষা চিন্তা অধিক প্রশংসার দাবি রাখে। কারণ তিনি শিক্ষাদান পদ্ধতি সম্পর্কে বলেন – শিক্ষার বিষয়বস্তু আকর্ষণীয়ভাবে শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। তবেই শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবে শিখতে পারবে।

তিনি জোর করে শিশুর উপর চাপিয়ে দেওয়ার শিক্ষার কথা বলেননি। প্লেটো আরো বলেন – শিক্ষাদান বা শিশুর শিক্ষা খুব কম বয়স থেকে শুরু হবে না।

প্লেটোর শিক্ষা চিন্তায় যে সমস্ত শিক্ষাদান পদ্ধতির তিনটি নীতির সন্ধান পাওয়া যায়, সেগুলি হল –

i) গল্পচ্ছলে শিক্ষা,

ii) খেলার ছলে শিক্ষা,

iii) অনুকরণের মাধ্যমে শিক্ষা।

শৃঙ্খলা

প্লেটো শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে শিক্ষা দানের কথা বলেছেন। এর ফলে শিক্ষার্থীরা শৃঙ্খলিত, ন্যায়বান ও কর্তব্যপরায়ণ হয়ে উঠবে।

নারী শিক্ষা

প্লেটো নারীদের শিক্ষার ব্যাপারে বিশেষভাবে উদ্যোগী ছিলেন। অর্থাৎ প্লেটো নারী শিক্ষার বিশেষ পক্ষপাতি ছিলেন। কারণ তিনি নারী ও পুরুষের শিক্ষার মধ্যে কোনো পার্থক্যকে সমর্থন করেননি।

প্লেটো বলেন – পুরুষের মতো নারীদেরকেও শারীরশিক্ষা, সংগীত শিক্ষা এমনকি যুদ্ধ বিদ্যার শিক্ষা দিতে হবে। তাই নারী শিক্ষা সংক্রান্ত সমস্ত চিন্তা-ভাবনা প্লেটোর শিক্ষা দর্শনের মধ্যে প্রতিফলিত হয়।

উপসংহার (Conclusion)

সর্বোপরি বলা যায়, প্লেটোর শিক্ষা দর্শন বা শিক্ষা চিন্তা (Plato Philosophy of Education) আধুনিক শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিকতা দাবি রাখে। তাঁর শিক্ষা চিন্তার বিভিন্ন দিক আধুনিক শিক্ষাবিদ – রুশো, ফ্রয়েবেল, মন্তেসরি, জন ডিউই, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ প্রমুখদের শিক্ষা চিন্তায় প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।

সুতরাং প্লেটোর শিক্ষা দর্শনের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও প্লেটোর শিক্ষা চিন্তার ব্যাপ্তি ও গভীরতা আধুনিককালের শিক্ষাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

তথ্যসূত্র (References)

  • Ravi, S. Samuel, A Comprehensive Study of Education, Fourth Printing-May 2016, Delhi – 110092, ISBN – 978-81-203-4182-1
  • Education in India-Past-Present-Future, Vol. I and II, J. P. Banerjee
  • Landmarks in the History of Modern Indian Education, J. C. Aggarwal
  • Internet Sources

প্রশ্ন – প্লেটোর দুটি গ্রন্থের নাম

উত্তর – প্লেটোর দুটি গ্রন্থের নাম হল – i) রিপাবলিক (Republic), ও ii) অ্যাপোলজি (Apology).

প্রশ্ন – প্লেটোর শিক্ষা পদ্ধতির তিনটি নীতি

উত্তর – প্লেটোর শিক্ষা পদ্ধতির তিনটি নীতি হল –
i) গল্পচ্ছলে শিক্ষা,
ii) খেলার ছলে শিক্ষা,
iii) অনুকরণের মাধ্যমে শিক্ষা।

প্রশ্ন – প্লেটোর শিক্ষা গুরু কে ছিলেন

উত্তর – প্লেটোর শিক্ষা গুরু ছিলেন বিশিষ্ট দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ সক্রেটিস।

প্রশ্ন – প্লেটোর শিষ্য কে ছিলেন

উত্তর – প্লেটোর শিষ্য ছিলেন বিশিষ্ট দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ অ্যারিস্টটল।

প্রশ্ন – প্লেটো কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম কি

উত্তর – প্লেটো কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম হল – একাডেমি (Academy)। এই একাডেমী প্লেটো খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৭ অব্দে প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি বয়স্কদের ও শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল।

প্রশ্ন – প্লেটোর বিখ্যাত গ্রন্থের নাম কি কি

উত্তর – প্লেটোর বিখ্যাত গ্রন্থের নাম হল – i) রিপাবলিক (Republic), ii) অ্যাপোলজি (Apology).

আরোও পড়ুন

Leave a Comment

close