সমাজে সংস্কৃতি একটি প্রাচীন ধারণা। মানব সমাজে সংস্কৃতি সামাজিক জীবনযাত্রার দিক নির্দেশ করে থাকে। তাই মানব সমাজের একটি অন্যতম উপাদান হল সংস্কৃতি বা কৃষ্টি (Culture)।
সংস্কৃতি মানব সমাজের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। পৃথিবীর প্রতিটি সমাজের বিভিন্ন ধরনের সংস্কৃতি লক্ষ্য করা যায়। প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃতি মানুষের তৈরি বিভিন্ন নিয়ম-নীতি বা সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন ধারাকে বোঝায়। সংস্কৃতির মাধ্যমে কোনো মানব সমাজের গতিপ্রকৃতি কিরূপ ছিল তা পর্যালোচনা করা সম্ভব হয়। তাই সমাজে মানুষের জীবনযাত্রার মানকে সূচিত করে সংস্কৃতি।
সংস্কৃতি কাকে বলে | Definition of Culture
সংস্কৃতির ইংরেজি প্রতিশব্দ হল ‘Culture’ বা কালচার। বাংলায় এটিকে সংস্কৃতি বা কৃষ্টি বলে। এটি বুৎপত্তিগতভাবে ল্যাটিন শব্দ ‘Colere’ থেকে এসেছে যার অর্থ হল – কর্ষণ করা বা উৎপাদন করা।
সংস্কৃতির দুটি অর্থ পরিলক্ষিত হয় যথা –
i) সংকীর্ণ অর্থ – সংকীর্ণ অর্থে বা সাধারণ অর্থে সংস্কৃতি হল শিক্ষা বা চর্চা দ্বারা লব্ধ বিচারবুদ্ধি বা বিদ্যাবুদ্ধি, শিল্পকলা, রীতিনীতি, রুচিবোধ প্রভৃতি
ii) ব্যাপক অর্থ – ব্যাপক অর্থের সংস্কৃতি হল পার্থিব দিক এবং আধ্যাত্মিক দিক। এছাড়া ব্যাপক অর্থে সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
সংস্কৃতির সংজ্ঞা বা কৃষ্টির সংজ্ঞা
বিভিন্ন সমাজতাত্ত্বিক সংস্কৃতিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। সেগুলি হল –
1. সমাজতাত্ত্বিক ই. বি. টেলর (Taylor) বলেছেন – সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষ যে সমস্ত জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্পকলা, নৈতিক আচরণ, আইন, প্রথা ও অন্যান্য যে সমস্ত গুণ এবং অভ্যাস অর্জন করে তার জটিল সমন্বয় হল সংস্কৃতি।
2. ম্যাথু আর্নল্ড বলেছেন – সংস্কৃতি হল পরিপূর্ণতা।
3. সমাজবিদ্ বোগারডাস (Bogardus) – এর মতে, “Culture is composed of integrated Customs, traditions and current behaviour patterns of human group”. অর্থাৎ সংস্কৃতি মানব গোষ্ঠীর সমন্বিত রীতিনীতি, ঐতিহ্য এবং বর্তমান আচরণের নিদর্শনগুলির সমন্বয়ে গঠিত।
4. সমাজবিদ্ ওটওয়ে (Ottaway) বলেছেন – একটি সমাজের সংস্কৃতি মানে একটি সমাজের সামগ্রিক জীবনধারা।
5. সমাজবিদ্ Birstedt বলেছেন – সংস্কৃতি হল সেই জটিল সমগ্র যা সমাজের সদস্য হিসাবে আমরা যা ভাবি, করি এবং যা আছে সবই নিয়ে গঠিত।
6. ভারতীয় কৃষ্টির স্বরূপ সম্পর্কে শ্রী অরবিন্দ বলেছেন – “কৃষ্টি বা সংস্কৃতি এক ধরনের বৃদ্ধি।
7. শিক্ষাবিদ ম্যাকেঞ্জির মতে – বৃহত্তর অর্থে যে শিক্ষা জীবনের চরম লক্ষ্য, তার প্রস্তুতি মাত্র নয় তাই সংস্কৃতির পরিচয়। অর্থাৎ সংস্কৃতি আধ্যাত্মিক প্রকৃতির বিকাশ সাধন।
8. সমাজবিদ North বলেছেন – সংস্কৃতি হল মানুষের তৈরি সেই সব উপায়, যা তার প্রয়োজন মেটাতে সাহায্য করে।
9. বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন – শিক্ষা হল হীরক এবং সংস্কৃতি হল তার দ্যুতি বা দীপ্তি।
10. আবার বিশিষ্ট সমাজবিদ G. M. Foster বলেছেন – “Society means pupil and culture means the behaviour”.
তাই সংস্কৃতি বাস্তব ও আধ্যাত্মিকতার সংমিশ্রনে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা যা মানুষকে তার জীবনের সার্থকতা সম্পর্কে সচেতন করে থাকে। অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে সামাজিক জীবনযাত্রার সমস্ত কিছুই হল ব্যক্তির সংস্কৃতি।
সংস্কৃতি বৈশিষ্ট্য
সংস্কৃতি বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন দিক থেকে পরিলক্ষিত হয়। সংস্কৃতির (Culture) বৈশিষ্ট্য গুলি নিম্ন আলোচনা করা হল –
1. সংস্কৃতি আচরণের সমষ্টি
সংস্কৃতি হল মানব সমাজের আচরণের সমষ্টি। সংস্কৃতির মাধ্যমে মানুষের আচার-আচরণ, বা রীতিনীতি প্রকৃতি প্রতিফলিত হয়। তাই সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য হল এটি আচরণের সমষ্টি।
2. সংস্কৃতি অভিযোজিত
সংস্কৃতি হল অভিযোজনমূলক। প্রতিটি মানব সমাজের বিভিন্ন ধরনের সংস্কৃতি পরিলক্ষিত হয়। ফলে সেই মানব সমাজের সংস্কৃতির সাথে ব্যক্তি সার্থক অভিযোজন করে থাকে।
3. সংস্কৃতি বিমূর্ত প্রকৃতির
সংস্কৃতির ধারণা ব্যক্তির মননে বা মানসিকতায় অবস্থান করে। অর্থাৎ এটি সম্পূর্ণ মানসিক প্রকৃতির। তাই সংস্কৃতি বিমূর্ত প্রকৃতির হয়ে থাকে। কারণ সংস্কৃতির সাথে মানুষের বিশ্বাস, লৌকিকতা প্রভৃতি সংযুক্ত থাকে। তাই সংস্কৃতি মানুষের মননশীলতায়, চিন্তাধারায় ও ধ্যানধারণার মধ্যে অবস্থান করে।
4. সংস্কৃতি শিখনের প্রক্রিয়া
সংস্কৃতি হল শিখনযোগ্য। প্রতিটি সমাজের বিভিন্ন রকম সংস্কৃতি পরিলক্ষিত হয় এবং ব্যক্তি সেই সংস্কৃতির সাথে পরিচিতি লাভ করে। তাই সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য হল এটি একটি শিখনের প্রক্রিয়া।
5. সংস্কৃতি পরিবর্তনযোগ্য
বিভিন্ন সমাজতত্ত্ববিদ সংস্কৃতিকে অপরিবর্তনীয় হিসাবে গণ্য করলেও অনেক সময় সংস্কৃতি পরিবর্তনযোগ্য হয়ে থাকে। কারণ পরিবর্তনশীল আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভরযোগে প্রাচীন সংস্কৃতি ও আধুনিক সংস্কৃতির সংমিশ্রণে নতুন সংস্কৃতির জন্ম নেয়। তাই সংস্কৃতি কিছু ক্ষেত্রে অপরিবর্তনীয় হলেও আধুনিক সমাজ ও জীবনধারায় সংস্কৃতি পরিবর্তনযোগ্য প্রকৃতির হয়ে থাকে।
6. সংস্কৃতি গতিশীল
সংস্কৃতিক গতিশীল প্রকৃতির। অর্থাৎ সংস্কৃতি কখনো স্থির নয়। তবে কিছু কিছু সমাজে সংস্কৃতি স্থির প্রকৃতির হয়ে থাকে বা সংস্কৃতির কোনো পরিবর্তন সূচিত হয় না। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংস্কৃতি গতিশীল প্রকৃতির হয়ে থাকে।
7. সংস্কৃতি জাতিকেন্দ্রিক
প্রতিটি সমাজে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ভাবধারা লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ সংস্কৃতি জাতি কেন্দ্রিক হয়ে থাকে। যেমন – আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে এক ধরনের সংস্কৃতি লক্ষ্য করা যায়, আবার অপরদিকে আধুনিক সমাজে সভ্য মানুষের মধ্যে অন্য ধরনের সংস্কৃতি লক্ষ্য করা যায়। তাই সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য হল এটি সর্বদা নির্দিষ্ট জাতি কেন্দ্রিক হয়ে থাকে।
8. সংস্কৃতি ক্রমাগত ও ক্রমবর্ধমান
সংস্কৃতি ক্রমাগত প্রকৃতির এবং ক্রমবর্ধমান প্রকৃতির হয়ে থাকে। তাই সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এটি একদিকে ক্রমাগত এবং অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান প্রকৃতির।
উপসংহার (Conclusion)
পরিশেষে বলা যায়, সংস্কৃতি হল মানব সমাজের একটি অনন্য দিক। অর্থাৎ সংস্কৃতি হল Way of Life বা জীবনধারার পথ। যেটি মানব সমাজকে চিহ্নিত করতে সহায়তা করে। তাই প্রতিটি মানব সমাজে আলাদা আলাদা সাংস্কৃতিক ভাবধারা লক্ষ্য করা যায়। সুদূর প্রাচীনকাল থেকে মানব সমাজে সংস্কৃতির জন্ম হলেও আধুনিক ক্ষেত্রে প্রতিটি মানব সমাজ তাদের নিজ নিজ সাংস্কৃতিক ভাবধারায় বিশেষভাবে প্রভাবিত।
প্রাথমিক গোষ্ঠীর ধারণা, সংজ্ঞা, বৈশিষ্ঠ্য ও শিক্ষাগত তাৎপর্য | সামাজিক গোষ্ঠীর ধারণা, সংজ্ঞা ও শ্রেণীবিভাগ |
শিশুর সামাজিকীকরণে পরিবারের ভূমিকা | শিশুর সামাজিকীকরণে বিদ্যালয়ের ভূমিকা |
তথ্যসূত্র (Reference)
- Brown, F. J. (1954). Educational Sociology. New York: Prentice-Hall.
- Bhattacharjee, Srinivas. (1996). Philosophical & Sociological Foundation of Education. Herald book service.
- Das, P. (2007). Sociological Foundation of Education. New Delhi: Authorspress
- Shukla, S & K Kumar. (1985). Sociological Perspective in Education. New Delhi, Chanakya
Publications - Sodhi, T.S & Suri, Aruna. (1998). Philosophical & Sociological Foundations of Education, H.P Bhargav Book House, Agra,
প্রশ্ন – কৃষ্টি অর্থ
উত্তর – সংস্কৃতি বা কৃষ্টি অর্থ হল মানব সমাজের বিভিন্ন রীতিনীতি, প্রথা, বিশ্বাস, লৌকিকতা, আনুষ্ঠানিকতা প্রভৃতির সমাহার।
প্রশ্ন – সংস্কৃতি কত প্রকার ও কি কি
উত্তর – সংস্কৃতি প্রধানত তিন প্রকারের হয়ে থাকে। যথা – আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি, জাতীয় সংস্কৃতি এবং উপসংস্কৃতি বা লৌকিক সংস্কৃতি।
প্রশ্ন – কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পার্থক্য
উত্তর – কৃষ্টি ও সংস্কৃতির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কারণ ইংরাজি Culture শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল সংস্কৃতি বা কৃষ্টি। অর্থাৎ কোন কোন সমাজতত্ত্ববিদ কালচার (Culture) শব্দটিকে কৃষ্টি বা সংস্কৃতি হিসেবে গণ্য করে থাকেন।
আরোও পড়ুন
- যোগাযোগ কাকে বলে | যোগাযোগ প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য | What is Definition of Communication
- যোগাযোগ প্রক্রিয়ার উপাদান | 8 Essential Components of Communication
- শিক্ষার সমাজতত্ত্বের পরিধি | Scope of Sociology of Education
- সামাজিক স্তরবিন্যাস কি | সামাজিক স্তরবিন্যাসের ধরন | Types of Social Stratification
- Social Mobility: সামাজিক সচলতা কাকে বলে | সামাজিক সচলতার বৈশিষ্ট্য
- Types of Social Mobility: সামাজিক সচলতার প্রকারভেদ
1 thought on “সংস্কৃতি কাকে বলে | 10 টি সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য | Definition and Characteristics of Culture”