সামাজিক পরিবর্তন হল সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন। এই সামাজিক বা সমাজ পরিবর্তনের বিভিন্ন উপাদান পরিলক্ষিত হয়। তার মধ্যে অন্যতম হল শিক্ষা। বর্তমানে শিক্ষাকে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার (Education as an Instrument of Social Change) বলা হয়।
সমাজ বা সামাজিক পরিবর্তনের অন্যতম উপাদান শিক্ষা। সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে শিক্ষা ছাড়া আরো বিভিন্ন উপাদান প্রভাব বিস্তার করে থাকে। তবে সমাজকে সার্বিকভাবে পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে শিক্ষার ভূমিকা অগ্রগণ্য।
শিক্ষাকে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার বলা হয় কেন | Education as an Instrument of Social Change
সামাজিক পরিবর্তন সমাজের সামাজিক বিভিন্ন পরিবর্তনকে সূচিত করে। সমাজ পরিবর্তন একদিনে সম্পন্ন হয় না। এটি বিভিন্ন উপাদানের প্রভাবে ধীরে ধীরে বা অতি দ্রুত সংঘটিত হয়ে থাকে।
সামাজিক পরিবর্তনের বিভিন্ন উপাদান বর্তমান। যেমন – জৈবিক উপাদান, প্রাকৃতিক উপাদান, অর্থনৈতিক উপাদান, প্রযুক্তিগত উপাদান, ধর্মীয় উপাদান, শিক্ষাগত উপাদান প্রভৃতি। এদের মধ্যে শিক্ষাগত উপাদান একটি উল্লেখযোগ্য এবং অন্যতম।
সমাজ পরিবর্তনের বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে শিক্ষা একটি অন্যতম উপাদান। অর্থাৎ সমাজ পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং শক্তিশালী হাতিয়ার বা অস্ত্র হল শিক্ষা। তাই শিক্ষাকে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার বলা হয়।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ডক্টর সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ বলেছেন – শিক্ষা হল সামাজিক পরিবর্তনের একটি হাতিয়ার বা যন্ত্র।
বিভিন্ন সমাজবিদ এবং শিক্ষাবিদগন শিক্ষাকে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করেন বা চিহ্নিতকরণ করেন। শিক্ষাকে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার বলা হয়, এর অন্যতম কারণ গুলি হল নিম্নলিখিত –
1. উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ
শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যে উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটে। অর্থাৎ ব্যক্তিরা মুক্ত মনের প্রকৃতির হয়ে থাকে। যা সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
এই উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে জাতীয় সংহতি বোধ স্থাপন এবং সমাজের মধ্যে ঐক্যবোধ স্থাপন সম্ভব হয়। এইজন্য শিক্ষাকে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার বলা হয়।
2. জ্ঞানের বিকাশ
শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যে জ্ঞানের বিকাশ এবং প্রসার ঘটে। ফলে শিক্ষিত ব্যক্তি সমাজকে পরিবর্তনের দিকে অগ্রসর হয়। তাই জ্ঞানের প্রসার বা বিকাশ সামাজিক পরিবর্তনকে সূচিত করে।
3. গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঞ্চার
শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে। অর্থাৎ শিক্ষা ব্যক্তির মধ্যে সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রভৃতি স্থাপনের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনে সহায়তা করে।
4. সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও সঞ্চালন
শিক্ষা সমাজের প্রাচীন সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও সঞ্চালনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অর্থাৎ শিক্ষা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের মধ্যে সংস্কৃতির আদান-প্রদান বা সঞ্চালন এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তনের ধারাকে বজায় রাখে। তাই শিক্ষাকে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার বলা হয়।
5. অর্থনৈতিক ভিত্তি স্থাপন
শিক্ষার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি হয়। সাথে সাথে অর্থনৈতিক ভিত্তি স্থাপিত হয়। যে সমাজ অর্থনৈতিকভাবে যত উন্নত প্রকৃতির সেই সমাজের প্রগতি বা উন্নতি বা পরিবর্তন তত বেশি সূচিত হয়। আর শিক্ষা এই অর্থনৈতিক ভিত্তি স্থাপনের মাধ্যমে সমাজকে পরিবর্তন করে।
6. প্রযুক্তির বিকাশ সাধন
আধুনিক উন্নত সমাজের অন্যতম দান হল প্রযুক্তি। প্রযুক্তি সমাজকে সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তনকে সূচিত করে । আর শিক্ষা মানুষকে নিত্য নতুন আবিষ্কার, প্রযুক্তিগত কৌশল আয়ত্ত করতে শেখায় এবং গবেষণায় উৎসাহিত করে।
তাই শিক্ষা মানুষকে সেই সমস্ত আবিষ্কার এবং নতুন নতুন প্রযুক্তিগত কৌশলকে আয়ত্ত করতে শেখায় যার মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তন দ্রুত ভাবে সংঘটিত হয়।
7. অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার দূরীকরণ
অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার আধুনিক সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে বাধা স্বরূপ। অর্থাৎ অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার সামাজিক পরিবর্তনকে বাধা প্রদান করতে পারে। তাই শিক্ষা মানুষের মধ্যে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার দূরীকরণের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
উপসংহার (Conclusion)
পরিশেষে বলা যায়, শিক্ষা হল সমাজ পরিবর্তনের অন্যতম হাতিয়ার (Education as an Instrument of Social Change)। এই শিক্ষায় সামাজিক কাঠামো পরিবর্তনকে সংঘটিত করে। তাছাড়া সমাজের মধ্যে সামাজিক স্তরবিন্যাসের পরিবর্তন, সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন, নেতৃত্বের বিকাশের মাধ্যমে সমাজের পরিবর্তনকে সূচিত করার ক্ষেত্রে শিক্ষার ভূমিকা অগ্রগণ্য। তাই শিক্ষাকে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার বলা হয় এ কথা বলা বিশেষভাবে যুক্তিসঙ্গত।
তাই বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ তথা শিক্ষা চিন্তক জন ডিউই যথার্থ বলেছেন – “শিক্ষা হল একটি হাতিয়ার, যদি সামাজিক প্রগতি নিয়ে আসতে পারে”। (Education is such a tool, which can take the society towards progress”.)
প্রাথমিক গোষ্ঠীর ধারণা, সংজ্ঞা, বৈশিষ্ঠ্য ও শিক্ষাগত তাৎপর্য | সামাজিক গোষ্ঠীর ধারণা, সংজ্ঞা ও শ্রেণীবিভাগ |
শিশুর সামাজিকীকরণে পরিবারের ভূমিকা | শিশুর সামাজিকীকরণে বিদ্যালয়ের ভূমিকা |
তথ্যসূত্র (Reference)
- Brown, F. J. (1954). Educational Sociology. New York: Prentice-Hall.
- Bhattacharjee, Srinivas. (1996). Philosophical & Sociological Foundation of Education. Herald book service.
- Das, P. (2007). Sociological Foundation of Education. New Delhi: Authorspress
- Shukla, S & K Kumar. (1985). Sociological Perspective in Education. New Delhi, Chanakya
Publications - Sodhi, T.S & Suri, Aruna. (1998). Philosophical & Sociological Foundations of Education, H.P Bhargav Book House, Agra,
প্রশ্ন – সামাজিক পরিবর্তন ও শিক্ষার মধ্যে সম্পর্ক
উত্তর – সামাজিক পরিবর্তন ও শিক্ষা একে অপরের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তন দ্রুতভাবে সংঘটিত হয়। অর্থাৎ যে সমাজ যত বেশি শিক্ষিত কুসংস্কার বর্জিত সেই সমাজের পরিবর্তন তত বেশি দ্রুত সংঘটিত হয়। তাই শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন পরিবর্তন যেমন – অর্থনৈতিক পরিবর্তন, প্রযুক্তিগত পরিবর্তন প্রভৃতি সূচিত হয়। তাই শিক্ষা সামাজিক পরিবর্তনের সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত।
আরোও পড়ুন
- যোগাযোগ কাকে বলে | যোগাযোগ প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য | What is Definition of Communication
- যোগাযোগ প্রক্রিয়ার উপাদান | 8 Essential Components of Communication
- শিক্ষার সমাজতত্ত্বের পরিধি | Scope of Sociology of Education
- সামাজিক স্তরবিন্যাস কি | সামাজিক স্তরবিন্যাসের ধরন | Types of Social Stratification
- Social Mobility: সামাজিক সচলতা কাকে বলে | সামাজিক সচলতার বৈশিষ্ট্য
- Types of Social Mobility: সামাজিক সচলতার প্রকারভেদ