নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বিদ্যালয়ের ভূমিকা (10 Role of School as Medium of Formal Education)

নিয়ন্ত্রিত বা বিধিবদ্ধ শিক্ষা একটি অন্যতম মাধ্যম হলো বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের মধ্যে শিশুর শিক্ষা সম্পন্ন হয়ে থাকে। তাই নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বিদ্যালয়ের ভূমিকা (Role of School as Medium of Formal Education) বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

বিদ্যালয় হল সমাজের একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠান। সমাজ ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য এই বিদ্যালয়ের নামক প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয়েছে। এই বিদ্যালয়ের মধ্য দিয়ে শিশুকে সমাজ উপযোগী করে গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে ভবিষ্যৎ জীবনের উপযোগী করে গড়ে তোলা সম্ভব করা হয়। তাই বিদ্যালয় নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে সমাজের শ্রীবৃদ্ধির ঘটানোর সঙ্গে সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নানাভাবে সাহায্য করে থাকে।

বিদ্যালয়ের সংজ্ঞা

ইংরেজি ‘School’ শব্দটি বাংলা হলো বিদ্যালয়, এটি গ্রিক শব্দ ‘Skhole’ থেকে এসেছে যার অর্থ হল অবসর সময় তাত্ত্বিক জ্ঞানের আলোচনা.

শিক্ষাবিদ Carter Good বিদ্যালয়ের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেছেন – বিদ্যালয়ে হলো নির্দিষ্ট স্তরের একদল সংগঠিত ছাত্রসমষ্টি, যারা একটি বিদ্যালয় গৃহে কয়েকটি বিষয় অধ্যয়ন করে থাকে এবং যেখানে এক বা একাধিক শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষাকর্মীদের দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে।

তাই বলা যায়, বিদ্যালয় হলে এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে বিভিন্ন উপাদানের সমন্বয় পরিলক্ষিত হয়, সেগুলি হল –

  • শিক্ষার্থী বা শিশু,
  • শিক্ষক,
  • পূর্বনির্ধারিত পাঠক্রম,
  • শিক্ষা কর্মী,
  • বিদ্যালয়ের নিয়ম শৃঙ্খলা প্রভৃতি।

নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বিদ্যালয়ের ভূমিকা (Role of School as Medium of Formal Education)

নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বিদ্যালয়ের ভূমিকা বহুবিধ। যে সমস্ত দিক থেকে বিদ্যালয়ের ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়, সেগুলি হল নিম্নলিখিত –

1. ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধন

ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধনের ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। অর্থাৎ শিশুর সুপ্ত সম্ভাবনার বিকাশ সাধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধন করার ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

2. শিক্ষামূলক নির্দেশনা

বিদ্যালয় শিশুকে শিক্ষাদানের মাধ্যমে শিক্ষামূলক নির্দেশনা দানে বিশেষভাবে সহায়তা করে। তাই শিক্ষামূলক নির্দেশনা দান একমাত্র বিদ্যালয় মধ্যে সম্ভবপর হয়। শিক্ষার্থীদের আগ্রহ প্রবণতা ও সামর্থ্য অনুযায়ী শিক্ষা পরিকল্পনা ও শিক্ষামূলক নির্দেশনার ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের বিশেষভাবে শিশুকে সহায়তা করে থাকে।

3. বৃত্তিমূলক নির্দেশনা

বিদ্যালয় শিশুকে বৃত্তিমূলক নির্দেশনা দানের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যৎ উপযোগী করে গড়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তাই বিদ্যালয়ের একটি প্রধান কাজ হল শিক্ষার্থীদের বৃত্তিমূলক নির্দেশনা দানে সহায়তা করা। শিক্ষার্থীরা যাতে ভবিষ্যৎ জীবনে বৃত্তি জগতের সঙ্গে পরিচিতি লাভ করতে পারে ও বৃত্তি নির্বাচন করতে পারে, সে বিষয়ে বিদ্যালয় বিশেষভাবে শিক্ষার্থীদের বৃত্তিমূলক নির্দেশনা দান করে থাকে।

4. সামাজিকীকরণের সহায়তা

শিশু বড় হওয়ার সাথে সাথে সমাজের সঙ্গে পরিচিতি লাভ করে। অর্থাৎ শিশুর মধ্যে সামাজিক গুণাবলীর বিকাশ সাধন সম্ভবপর হয়। আর এক্ষেত্রে বিদ্যালয় শিশুকে সামাজিকীকরণে সহায়তা করার মধ্য দিয়ে শিশুকে সামাজিক জীব হিসেবে বিশেষভাবে গড়ে তোলে।

5. ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও সঞ্চালন

বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত শিক্ষার মধ্য দিয়ে প্রাচীন ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চালনের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এর ফলে পরবর্তী প্রজন্ম প্রাচীন ঐতিহ্য ও কৃষ্টিগুলি কি ছিল তা সম্পর্কে বিশেষভাবে ওয়াকিবহল হতে পারবে।

6. গণতান্ত্রিক বোধের বিকাশ সাধন

ভারতবর্ষে একটি গণতান্ত্রিক দেশ অর্থাৎ প্রত্যেক দেশের একটি গণতান্ত্রিক আদর্শ পরিলক্ষিত হয়। আর বিদ্যালয় গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে বিশেষভাবে সচেতন করে থাকে। তাই বিদ্যালয় শিশুর মধ্যে গণতান্ত্রিক বোধের বিকাশ সাধনের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সহায়তা করে।

7. সৃজনশীলতার বিকাশ

নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বিদ্যালয়ের ভূমিকা হল শিশুর মধ্যে থাকা সুপ্ত সম্ভাবনার বিকাশ সাধন। অর্থাৎ সৃজনশীলতার বিকাশ সাধন করা। তাই বিদ্যালয়ের বিভিন্ন কার্যপ্রণালী দ্বারা শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতার বিকাশ সাধন সম্পন্ন হয়ে থাকে।

8. মূল্যবোধের বিকাশ সাধন

নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বিদ্যালয়ের ভূমিকা হল শিশুর মধ্যে মূল্যবোধের বিকাশ সাধন করা। কারণ মূল্যবোধহীন শিক্ষা সৌরভ বিহীন ফুলের সমান। তাই বিদ্যালয়ে শিশুর মূল্যবোধের বিকাশের মধ্য দিয়ে সমাজের উপযুক্ত ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তোলে।

9. দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা

দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিদ্যালয় শিশুকে বিশেষভাবে সহায়তা করে থাকে। তাই আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য উন্নতমানের শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

10. জাতীয় সংহতি রক্ষা

জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান বিদ্যালয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। তাই বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত শিক্ষার মধ্য দিয়ে জাতীয় সংহতি রক্ষা করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আরোও পোস্ট পড়ুন – Click Here Now

বিদ্যালয়ের সীমাবদ্ধতা

নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বিদ্যালয়ের গুরুত্ব থাকলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয়। সেগুলি হল –

  • সামাজিক বিকাশে অসম্পূর্ণতা,
  • ব্যয়বহুল শিক্ষা ব্যবস্থা,
  • যান্ত্রিক শিক্ষা পদ্ধতি বা গতানুগতিক শিক্ষা পদ্ধতি,
  • পরীক্ষার নম্বর নির্ভর শিক্ষা পদ্ধতি,
  • প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অভাব,
  • উপযুক্ত পরিমাণে বিদ্যালয়ের অভাব,
  • সহ পাঠক্রমিক কার্যাবলীর অভাব প্রভৃতি।
সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষার ধারণা, 2 টি সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্যব্যাপক অর্থে শিক্ষার ধারণা, সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য
ভাববাদের ধারণা, সংজ্ঞা, মূলনীতি ও শিক্ষায় প্রভাবপ্রয়োগবাদের ধারণা, সংজ্ঞা, মূলনীতি ও শিক্ষায় প্রভাব
বাস্তববাদ বা বস্তুবাদের ধারণা, সংজ্ঞা, মূলনীতি ও শিক্ষায় প্রভাব প্রকৃতিবাদের ধারণা, সংজ্ঞা, মূলনীতি ও শিক্ষায় প্রভাব
শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা : ধারণা, সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্যডেলর কমিশনের আধুনিক শিক্ষার চারটি স্তম্ভ

উপসংহার (Conclusion)

পরিশেষে বলা যায়, নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বিদ্যালয়ের ভূমিকা বিভিন্ন দিক থেকে পরিলক্ষিত হয়। বিদ্যালয় হলো নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার এমন একটি মাধ্যম যেখানে শিক্ষার্থীরা একটি নির্দিষ্ট বয়সের মধ্যে বা শিক্ষা কালের মধ্যে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হয় ও তাদের ব্যক্তিত্বের সর্বাঙ্গীন বিকাশ সাধন সম্ভবপর হয়। অনেক শিক্ষাবিদগণ বিদ্যালয়কে দেবালয়ের মতো মর্যাদা বা সম্মান প্রদর্শন করে থাকেন। সমাজের সবথেকে উৎকৃষ্ট সংস্থা হিসেবে বিদ্যালয়ে তাই পরিগণিত হয়ে থাকে। বিদ্যালয়ের কার্যাবলী অসীম এর নির্দিষ্ট পরিধি নেই।

তথ্যসূত্র (References)

  • Aggarwal, J. C., Theory and Principles of Education. 13th Ed. Vikas Publishing House Pvt. Ltd.
  • V.R. Taneja, Educational Thoughts & Practice. Sterling Publication Pvt. Ltd. New Delhi
  • Nayak, B.K, Text Book of Foundation of Education. Cuttack, Odisha: KitabMhal
  • Ravi, S. Samuel, A Comprehensive Study of Education, Fourth Printing-May 2016, Delhi – 110092, ISBN – 978-81-203-4182-1,
  • Internet sources

প্রশ্ন – নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা কাকে বলে

উত্তর – যে শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে সুনির্দিষ্ট নিয়ম-শৃঙ্খলা পরিলক্ষিত হয় ও যেখানে পূর্ব নির্ধারিত পাঠক্রম ও নির্দিষ্ট শিক্ষক দ্বারা শিক্ষাদান কার্য পরিচালিত হয় তাকে নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা বলে।

প্রশ্ন – কর্মের জন্য শিক্ষার উদ্দেশ্য পূরণে বিদ্যালয়ের ভূমিকা

উত্তর – বিদ্যালয় শিশুকে বৃত্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ জীবনের উপযোগী করে গড়ে তোলে। অর্থাৎ বিদ্যালয়ে শিশুকে কর্মের উপযোগী শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে কর্মের জন্য শিক্ষার উদ্দেশ্য পূরণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। শিক্ষার্থীরা যাতে ভবিষ্যৎ কর্মজীবনে প্রবেশের সুযোগ সুবিধা পায় ও বৃত্তি নির্বাচন করতে পারে সে বিষয়ে বিদ্যালয় বিশেষভাবে সহায়তা করে।

প্রশ্ন – জ্ঞান অর্জনের জন্য শিক্ষার উদ্দেশ্য পূরণে বিদ্যালয়ের ভূমিকা

উত্তর – পরিবারের পর বিদ্যালয় শিশুকে জ্ঞানার্জনে প্রধান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জ্ঞানই শক্তি। জ্ঞান অর্জনের মধ্য দিয়ে শিশু সমাজ উপযোগী হয়ে গড়ে ওঠে, এ বিষয়ে বিদ্যালয় শিশুকে পরিপূর্ণভাবে সহায়তা করে থাকে। তাই যে শিক্ষা পরিবারের দ্বারা সম্ভবপর হয় না সেই শিক্ষাবিদ্যালয় দিয়ে থাকে।
বিদ্যালয় শুধুমাত্র শিক্ষার্থীকে তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জন করতে সহায়তা করে না। বরং বিদ্যালয় শিশুকে ব্যবহারিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে পেশাগত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলে। তাই জ্ঞান অর্জনের শিক্ষার জন্য বিদ্যালয়ের ভূমিকা অপরিসীম।

আরোও পড়ুন

1 thought on “নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বিদ্যালয়ের ভূমিকা (10 Role of School as Medium of Formal Education)”

Leave a Comment

close