প্রযুক্তির দ্রুত উন্নতির ফলে সারা বিশ্বে যে প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে সেটি হল বিশ্বায়ন (Globalization)। বিশ্বায়নের ফলে মানুষ ক্ষুদ্রতম গন্ডি থেকে বৃহত্তর গণ্ডির মধ্যে বিচরণ করতে সক্ষম হয়েছে।
বিশ্বায়ন হল আধুনিক সমাজ জীবনের একটি অন্যতম বিশেষ দিক। এর ফলে মানুষ আরো আধুনিক হয়ে উঠছে ও আধুনিকীকরণের সাথে নিজেকে অভিযোজন করে নিতে সক্ষম হচ্ছে। তাই বিশ্বায়ন মানুষের জীবনযাত্রা উন্নয়নের অন্যতম চাবিকাঠি।
বিশ্বায়ন কাকে বলে | Globalization
১৯৮০ সালে সমগ্র বিশ্বব্যাপী বৈজ্ঞানিক গবেষণার ধারাবাহিকতা বৃদ্ধি পায়। আর এই সময় থেকে ‘বিশ্বায়ন’ (Globalization) শব্দটি ব্যবহার শুরু হয় এবং জনপ্রিয়তা লাভ করে থাকে।
সাধারণত অর্থে বিশ্বায়ন হল সামাজিক, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত, রাজনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে সামগ্রিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া। যার ফলে কোনো দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত গোষ্ঠীর সাথে বা ব্যক্তির সাথে বা সমাজের সাথে পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া, ভাবের আদান প্রদান সম্ভব পর হয়। অর্থাৎ বিশ্বায়ন মানুষের মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্ব কমিয়ে দিয়েছে।
ভারতবর্ষে বিশ্বায়নের ধারণার ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখা যায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা ভাবনার মধ্যে। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয়তাবাদের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকতাবাদ বা বিশ্বায়নকে স্বাগত জানিয়েছে।
এছাড়া নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় এই বিশ্বায়নের অন্যতম নিদর্শন। যেখানে বিভিন্ন দেশ-বিদেশের গুণীজন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে আলোকিত করেছিল।
বিশ্বায়নের সংজ্ঞা
বিশ্বায়নের বিভিন্ন সংজ্ঞা বর্তমান তার মধ্যে অন্যতম হল –
i) Ronald Robertson বলেছেন – বিশ্বায়ন হলো একটি ধারণা, যা বিশ্বের মধ্যে সংযুক্তিকরণ এবং সামগ্রিকভাবে বিশ্বচে চেতনার দৃঢ়করণ করতে সহায়তা করে।
ii) A. Giddens বলেছেন – বিশ্বায়ন হল বিশ্বজুড়ে সম্পর্কগুলির সুদৃঢ়করণ, যা দূরবর্তী অঞ্চলগুলিকে সংযোগ করে। যার ফলে আঞ্চলিক ঘটনাগুলি বহু দূর অবস্থিত কোন দেশের ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হয়।
শিক্ষায় বিশ্বায়নের প্রভাব | Impact of Globalization on Education
শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের বিভিন্ন প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ শিক্ষা প্রক্রিয়ার সাথে বিশ্বায়ন ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। শিক্ষায় বিশ্বায়নের যে সমস্ত প্রভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়, সেগুলি হল –
1. শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন
শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের প্রভাব অনস্বীকার্য। অর্থাৎ শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। কারণ বিশ্বায়নের ফলে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন উচ্চ মেধা সম্পন্ন শিক্ষকদের পারস্পরিক সহযোগিতার ফলে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হয়।
2. শিক্ষাকে প্রয়োগযোগ্য ও ব্যবহারিক করে তোলা
বিশ্বায়নের ফলে শিক্ষাকে প্রয়োগযোগ্য ও ব্যবহারিক করে তোলা সম্ভবপর হয়। বিভিন্ন প্রযুক্তির শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তির ফলে এই কাজটি করা আরো সহজসাধ্য হয়ে উঠেছে। যা বিশ্বায়ন বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
3. শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ
আধুনিককালে শিক্ষা কেবলমাত্র একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। আর এটির ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের প্রভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়।
4. দূরাগত শিক্ষার বিস্তার
বিশ্বায়নের ফলে দূরাগত শিক্ষার বিস্তার সাধন সম্ভবপর হয়েছে। যার ফলে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীরা এই দূরাগত শিক্ষার মাধ্যমে উপকৃত হয়। তাই প্রযুক্তি উন্নতির সাথে সাথে এবং বিশ্বায়নের ফলে এই দূরাগত শিক্ষা বর্তমানে দেশের সকল স্থানে পৌঁছে দেয়া সম্ভবপর হচ্ছে।
এগুলি ছাড়াও শিক্ষাক্ষেত্রে বিশ্বায়নের যে সমস্ত প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, তা হল –
i) বিশ্বায়ন প্রথাগত, প্রথা বহির্ভূত শিক্ষার বিকাশকে বিশেষভাবে বিস্তার করে থাকে।
ii) বিশ্বায়নের ফলে যে সমস্ত দেশে শিক্ষার বিস্তার সাধন হয়নি সেখানে সহজে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়া সম্ভবপর হয়েছে।
iii) বিশ্বায়নের ফলে আগের তুলনায় বিভিন্ন দেশে উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান অনেক গুনে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থীরা সহজে শিক্ষা লাভ করতে পারছে।
iv) বিশ্বায়নের ফলে পাঠক্রমের মধ্যে বিভিন্ন পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। অর্থাৎ পাঠক্রম অনেক বেশি বিজ্ঞানসম্মত ও আধুনিকীকরণ যুক্ত হয়েছে। যা শিক্ষার্থীদের বিকাশ কে ও শিক্ষার আগ্রহকে ধরে রাখতে সহায়তা করে থাকে।
উপসংহার (Conclusion)
পরিশেষে বলা যায়, বিশ্বায়ন (Globalization) হল বহিঃবিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন বা সুসম্পর্ক স্থাপন। যার ফলে একটি দেশ বা জাতি বা সমাজব্যবস্থা সামগ্রিকভাবে উপকৃত হয় বা উন্নতিকরনের দিকে এগিয়ে চলে। অর্থাৎ বিশ্বায়নের ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, বাণিজ্য প্রভৃতির বিকাশ লাভ হয়ে থাকে। যা কোনো জাতির উন্নতির প্রাথমিক সোপান।
প্রাথমিক গোষ্ঠীর ধারণা, সংজ্ঞা, বৈশিষ্ঠ্য ও শিক্ষাগত তাৎপর্য | সামাজিক গোষ্ঠীর ধারণা, সংজ্ঞা ও শ্রেণীবিভাগ |
শিশুর সামাজিকীকরণে পরিবারের ভূমিকা | শিশুর সামাজিকীকরণে বিদ্যালয়ের ভূমিকা |
তথ্যসূত্র (Reference)
- Brown, F. J. (1954). Educational Sociology. New York: Prentice-Hall.
- Bhattacharjee, Srinivas. (1996). Philosophical & Sociological Foundation of Education. Herald book service.
- Das, P. (2007). Sociological Foundation of Education. New Delhi: Authorspress
- Shukla, S & K Kumar. (1985). Sociological Perspective in Education. New Delhi, Chanakya
Publications - Sodhi, T.S & Suri, Aruna. (1998). Philosophical & Sociological Foundations of Education, H.P Bhargav Book House, Agra,
প্রশ্ন – বিশ্বায়নের ফলাফল কি কি?
উত্তর – বিশ্বায়নের ফলাফল মানুষের উন্নত জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করে থাকে। অর্থাৎ বিশ্বায়নের ফলে মানুষ প্রযুক্তিগত, শিক্ষাগত, স্বাস্থ্যগত, বাণিজ্যিক প্রভৃতি সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকে। অর্থাৎ বিশ্বায়ন সারা বিশ্বব্যাপী মানুষকে এক সূত্রে গ্রথিত করেছে। মানুষ ক্রমশ আধুনিক মানুষে পরিণত হয়ে উঠছে।
আরোও পড়ুন
- যোগাযোগ কাকে বলে | যোগাযোগ প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য | What is Definition of Communication
- যোগাযোগ প্রক্রিয়ার উপাদান | 8 Essential Components of Communication
- শিক্ষার সমাজতত্ত্বের পরিধি | Scope of Sociology of Education
- সামাজিক স্তরবিন্যাস কি | সামাজিক স্তরবিন্যাসের ধরন | Types of Social Stratification
- Social Mobility: সামাজিক সচলতা কাকে বলে | সামাজিক সচলতার বৈশিষ্ট্য
- Types of Social Mobility: সামাজিক সচলতার প্রকারভেদ
1 thought on “বিশ্বায়ন কাকে বলে | শিক্ষায় বিশ্বায়নের প্রভাব | Impact of Globalization on Education”